রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাস

কাপুরুষতা দিয়ে যে ইতিহাসকে কলঙ্কিত করা হয়েছে তা লিখতে গেলে সত্যি সত্যি কলম থেমে যায়। ইতিহাস তাই ইতিহাস হয় না। হয় জাতীয় লজ্জার ডায়েরি।

প্রকাশ | ২৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

ওমর খালেদ রুমি
গঙ্গা। একটি নদী। হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র। মুসলমানদের কাছে ধর্মীয় বিবেচনায় এর কোনো মূল্য নেই। তবে একটি নদী হিসেবে এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। গুরুত্ব যে আছে তা আলোচনার মাধ্যমেই ফুটে উঠবে। হাজার হাজার বছর ধরে বইছে এ নদী। এর উপনদী আর শাখানদীও কম নয়। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে জন্মলাভ করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া নদীটি হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে এনেছে পলি। সেই পলি জমে এর মোহনায় সৃষ্টি হয়েছে একটি বদ্বীপ। বদ্বীপটি সৃষ্টিতে অবদান গঙ্গার একার নয়। আরও একটি নদী আছে। নাম ব্রহ্মপুত্র। হিমালয়ের মানস সরোবরে জন্মলাভ করে এটিও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে এনেছে পলি মাটি। এই বদ্বীপটি গঠনের পেছনে তাই এর অবদানও কম নয়। প্রবন্ধটি নদী বিষয়ক নয়। তাছাড়া আমি কোনো নদী বিশেষজ্ঞও নই। তবুও নদীর কথা এলো। কারণ আমরা যারা বাঙালি আমাদের জীবনযাত্রায় নদী মিশে আছে এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে। মূলত, নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত যে বদ্বীপ তার বুকেই আমাদের বেড়ে ওঠা, জীবন, যৌবন, বিকাশ। টেকটোনিক পেস্নটের সীমানা শেষ হয়ে গেছে মূলত বাংলাদেশের সীমান্তের ধার ঘেঁষে। আমাদের যে ভূখন্ডটুকু মূলত যা একটা আলগা পাললিক গঠন তা দুটো বড় নদীর মোহনায় গড়ে উঠেছে। এই জনপদের মানুষের জীবন ও তার বৈচিত্র্য তাই মূল ভূখন্ডের মানুষের চাইতে আলাদা। এদের বুঝতে হলে তাই এদের প্রাকৃতিক অবস্থানও বুঝতে হবে। কারণ আর কিছু নেই। ভৌগোলিক এই অবস্থান, এখানকার জলবায়ু, এর মাটি, পানি, বাতাসই এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়ই আমরা আমাদের আসল চেহারাটা দেখিয়ে দিলাম। অবশ্য বিদ্বেষের ইতিহাস এই উপমহাদেশে নতুন কিছু নয়। এখানকার সবচেয়ে বেশি অনুসারীদের যে ধর্ম তার নাম হিন্দু ধর্ম বা সনাতন ধর্ম। এটা মূলত আর্যদের ধর্ম বিশ্বাস। এর সঙ্গে মিশে গেছে এই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষের অতি দুর্বল ধর্ম বিষয়ক আচার-আচরণ। মূলত এই চরাঞ্চলটির সমৃদ্ধ ইতিহাস কখন থেকে শুরুতা এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তাই চৈনিক সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা বা মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার মতো এর কোনো হাজার হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস নেই। মূলত আজও চরের মানুষের কোনো সমৃদ্ধ ইতিহাস নেই। সভ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করলে এর ইতিহাস ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর অন্ধকারের ইতিহাস। জীবন সংগ্রামে অন্যান্য প্রাণিকুলের মতো কিংবা তাদের সঙ্গেই পাশপাশি থেকে কোনোমতে টিকে থাকার ইতিহাস। আজ যদি আমরা বাংলাদেশকে মূল ভূখন্ড ধরি তবে এর চরগুলোর দিকে তাকালে আমরা যে অবস্থা দেখতে পাই উপমহাদেশের মূল ভূখন্ডের কাছে আমরা অনুরূপই ছিলাম। আমাদের তাই বিভ্রান্ত হয়ে লাভ নেই। আমাদের ইতিহাস খুঁজতে গেলে যা পাই তা মূলত অন্যের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে যায়। এই যেমন ধরুন মৌর্য বা গুপ্তদের ইতিহাসের সঙ্গে কিংবা আরও পরে তুর্কি বা আফগানদের ইতিহাসের সঙ্গে। এতে অবশ্য লজ্জার কিছু নেই। পলিবাহিত একটি অঞ্চলের বয়সই বা আর কত হবে? বৃক্ষের ফল নিশ্চয়ই তার চেয়ে বয়সে বেশি হবে না। তবে হঁ্যা। আশার কথা হলো আমাদেরও ইতিহাস হবে। অবশ্য হতো না। হবেও বা কেমন করে? যা অস্থির প্রকৃতির আমরা। আর তাও তো নদী আর পলিমাটির কারণে। পায়ের তলায় শক্ত মাটি থাকলে মনটাও শক্ত হয়। কেন বললাম ইতিহাস হবে। সে প্রসঙ্গে পরে যাব। তার আগে যেটুকু ইতিহাস আছে তা বলতে চাই। অবশ্য অন্যভাবে। কারণ আমি কোনো ঐতিহাসিক নই। আর ইতিহাসের ধারাবাহিক গৎবাঁধা আলোচনাও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এটি একটি ভিন্ন ধরনের আলোচনার বিষয় যেখানে বিগত দিনগুলোতে যে ইতিহাসটুকু আমরা সঞ্চয় করতে পেরেছি সেখানেও আমাদের আচরণ কিংবা অংশগ্রহণ কেমন ছিল আর তা কেমন করেই বা আমাদের প্রভাবিত করেছিল তার ওপর সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। পাল রাজারা ছিল গুপ্ত এবং মৌর্যদের সমসাময়িক। আমাদের যেটুকু ইতিহাস তা মূলত এখান থেকেই শুরু। তবে ইতিহাস বদলে যেতে থাকে মুসলমানদের আগমনের পর থেকে। ১২০২ খ্রিষ্টাব্দে রাজনৈতিক বিজয় হলেও এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগে। ইসলামের আবির্ভাবের পরে সুফি, দরবেশ কিংবা ধর্ম প্রচারকদের আগমনের মাধ্যমে এখানকার সামাজিক পরিবেশ বদলে যেতে থাকে। সনাতন ধর্ম ও ইসলামের এই পাশাপাশি চলার যে মিথস্ক্রিয়া মূলত এটাই আমাদের ইতিহাসের মূল উপাদান। এর বাইরে কিছু খুঁজতে যাওয়া অন্তত আমি মনে করি সময়ের অপচয়। এটা শুধু এই বদ্বীপেই নয়। আমরা যদি পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলেও দেখব পৃথিবীর ইতিহাস মূলত তাওহীদপন্থি ও বহুত্ববাদীদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ইতিহাস। মূলত পৃথিবীর ইতিহাস হলো ধর্মের ইতিহাস। এর বাইরে যা কিছু দৃশ্যমান তা এরই উপজাত। এই যেমন ধরুন অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সামরিক বিদ্যা ইত্যাদি। দিন শেষে আপনাকে এই উপসংহারে আসতে হবে। মাঝখানে থানিকটা সময়ের অপচয় আর কি? উপমহাদেশের ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে তাই দুই ভাগে বিভক্ত। মুসলমানদের আগমনের পূর্ববর্তী সময়ের ইতিহাস। মুসলমানদের চলে আসার পরবর্তী সময়ের ইতিহাস। ওদিকটায়, গুপ্ত, মৌর্য, পাল- এদিকটায় আফগান আর তুর্কি। মূলত বাংলায় যাকে বলা হয় এদের কেউই এই জনপদের না। বর্তমান ভারতের মূল ভূখন্ডের বাসিন্দারা, যারা আর্য-সম্ভূত, আর অন্যরাও, আর্যই বটে, তবে তারা দূরের অর্থাৎ এশিয়ার মধ্য পূর্ব পশ্চিম কিংবা উত্তর দিক থেকে আসা। এর মধ্যে আমরা তবে কোথায়? আমরা মূলত তেমন কোথাও নেই। আমাদের ইতিহাসের শুরু হয় আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। আর এই ইতিহাসের যারা জন্ম দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেক কুশীলব থাকলেও সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিলিস্নর সুলতানি আমলই হোক, মোগল আমলই হোক কিংবা ইংরেজ শাসন- সবশেষে পাকিস্তানি শাসনামল- যা কিছুই বলি না কেন, আমাদের ইতিহাস মূলত গস্নানিরই ইতিহাস। আমাদের সম্মান আর সার্বভৌমত্বের ইতিহাস মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বাঙালি বরাবরই অস্থিরমতি। এই উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বৈচিত্র্য, চিন্তাচেতনা ও বাস্তবতা বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন তাতে সহাবস্থান ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে একটি চমৎকার জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার একটা নিদারুণ সুযোগ ছিল। কিন্তু বরাবরের মতো প্রতিক্রিয়াশীল আমরা আমাদের বালসুলভ আচরণের মাধ্যমে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলি। একদল ক্ষমতা লোভী আরেক দল নির্বোধ অতি উৎসাহীর উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে তাদের স্বার্থ সিদ্ধিতে সফল হয়। ওই যে প্রথমেই নদীর কথা বলেছিলাম, বলেছিলাম পলির কথা, বদ্বীপের কথা, এর আবহাওয়া, জলবায়ু, বাতাস, বৃষ্টি, শীত, গরম ইত্যাদি ইত্যাদি অতঃপর বারো বছরে মেয়েদের সাবালিকা হওয়া আর চৌদ্দ বছরে ছেলেদের ধর্ষণের উপযোগী হয়ে যাওয়াই এই সব চঞ্চল আচরণের নেপথ্যে। এসব ফাঁকফোকর দিয়েই তাই বার বার ধান্দাবাজরা পথ খুঁজে নেয়। কেউ নামে সামরিক উর্দিকে পুঁজি করে, কেউ আগায় ধর্মকে পুঁজি করে অথচ এসব মানুষকেই যদি বলা হয় পরিপূর্ণ ইসলামী শাসন কায়েম হবে তাহলে হয়তো এদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর প্রমাণ তো দেখাই গেল। যারা রিসোর্টে ধরা পড়লো শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র হলে তো তাদের মাথাটাই গিয়েছিল প্রায়। আলস্নাহ্‌ সবকিছু ভালো জানেন। ইতিহাস কি লিখব? ইতিহাস কিছু নেই। সত্যিকারের ইতিহাস তো ত্রিশ লাখ শহীদের ইতিহাস। দু'লাখ মা-বোনের ইজ্জতের ইতিহাস। সেই ইতিহাস লিখতে বা বলতে আমাদের অনেক জড়তা, অনেক লজ্জা, দারুণ সংকোচ। পাছে যদি ধর্ম নষ্ট হয়। কারণ হত্যা আর ধর্ষণ- এর দুটোই তো আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমান ভাইয়েরা করেছে। আমাদের ওপর তাদের এই এহসানের কথা কি করে মুখে আনব? তাছাড়া দায় তো আমাদেরও কম নয়। সেদিন তো আমরাও প্রাণ বাঁচাতে আমাদের স্ত্রী আর যুবতী মেয়েদের তাদের খেদমতে পেশ করেছিলাম। তাই এই ইতিহাসও যে আমাদের লজ্জা আর ভীরুতার ইতিহাস। কাপুরুষতা দিয়ে যে ইতিহাসকে কলঙ্কিত করা হয়েছে তা লিখতে গেলে সত্যি সত্যি কলম থেমে যায়। ইতিহাস তাই ইতিহাস হয় না। হয় জাতীয় লজ্জার ডায়েরি। ওমর খালেদ রুমি : কলাম লেখক