একজনের ওপর অন্যজনের চাপিয়ে দেওয়া যৌন আচরণকে যৌন নির্যাতন বা উৎপীড়ন বলা হয়। যখন প্রত্যক্ষভাবে স্বল্প সময়ের জন্য অথবা পরোক্ষভাবে জোর করা হয় তখন তাকে বলা হয় যৌন লাঞ্ছনা। যদি হানিকর হয় তাহলে অপরাধীকে যৌন নির্যাতক বা উৎপীড়ক বলে অভিহিত করা হয়। যদি কোনো প্রাপ্তবয়ষ্ক লোক বা তরুণ কোনো শিশুকে যৌন কাজে লিপ্ত হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দেয় তাকেও যৌন নির্যাতন বলা হবে। শিশু বা নাবালকের সঙ্গে অনুপ্রেরণা দিয়ে যৌন কাজে লিপ্ত হলে তাকে শিশু যৌন নির্যাতন বা বিশেষ আইনের আওতায় ধর্ষণ বলা হয়। যৌন হয়রানিমূলক আচরণের মধ্যে রয়েছে ক) অযাচিত যৌন আচরণ, শরীরের সংস্পর্শ বা ধাবিত হওয়া, খ) প্রশাসনিক, কর্তৃত্ব বা পেশাগত ক্ষমতাবলে কোনো ধরনের শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন বা যৌনতা সম্পর্কিত আচরণের চেষ্টা করা,
গ) অযাচিতভাবে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কোনো কিছু দেখানো বা প্রদর্শন করা, ঘ) যৌন সুবিধা গ্রহণের দাবি বা অনুরোধ করা, ঙ) অশ্লীল বা কুরুচিপূর্ণ কোনো কিছু দেখানো, চ) যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য বা অঙ্গভঙ্গি করা, ছ) কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি, অকথ্য ভাষার ব্যবহার করা, ধোঁকা দেওয়া, যৌন উপাদান মিশ্রিত হাস্যরস, জ) চিঠি, ফোনালাপ, মোবাইল ফোন, ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ, নোটিশ, ব্যঙ্গচিত্র, চেয়ার, টেবিল, নোটিশ বোর্ড, দেয়াল, কারখানা, শ্রেণিকক্ষে, টয়লেটে বা গোসলখানায় আলপনা আঁকা বা এমন কিছু লেখা যার মধ্যে যৌনতাসংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রকাশ ঘটে, ঝ) চরিত্র হনন বা চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ছবি বা ভিডিও করা, ঞ) যৌন হয়রানির উদ্দেশ্যে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে বাধা প্রদান, ট) ভালোবাসার প্রস্তাব দেওয়া বা সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ বা ভয়ভীতি দেখানো এবং ঠ) মিথ্যা আশায়, ছলনা বা প্রতারণার মাধ্যমে কারো সঙ্গে যৌন সম্পর্কের চেষ্টা করা।
\হযৌন হয়রানি বিষয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ এবং গুণগত মানসম্পন্ন তথ্য বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যায়। তবে অ্যাকশন এইড পরিচালিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদন- 'উইমেন অ্যান্ড দ্য সিটি-৩: সাত দেশে নারী ও মেয়েদের ওপর সহিংসতার প্রাথমিক তথ্যের সার সংক্ষেপ'- এ দেখা যায়, বাংলাদেশে যৌনতা প্রকাশ পায় এমন অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করা, কটূকথার মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা এবং যৌন তাৎপর্যপূর্ণ কৌতুক করার মতো ঘটনাগুলোই সাধারণভাবে ঘটে থাকে এবং ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির শিকার নারীদের এ ধরনের অভিজ্ঞতাই সবচাইতে বেশি। নারীদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সব পাবলিক পেস্নসের মধ্যে রাস্তায়ই সব থেকে বেশি সহিংসতার মতো ঘটনাগুলো ঘটে অথবা সেখানেই নারীরা সব থেকে অনিরাপদ বোধ করে।
সমীক্ষাটি সাতটি জেলা সদরে পরিচালনা করা হয়। সেখানে দেখা যায়, ৮৪% নারী জানিয়েছেন তারা কটূকথা বা যৌন মন্তব্য, ৫৬% জানিয়েছেন তারা যৌন হয়রানি/ইভটিজিং এবং ২২% জানিয়েছেন তারা যৌন আক্রমণ, ধর্ষণ বা ধর্ষণ আতঙ্কের শিকার। এসব অভিজ্ঞতা হয়েছে এক মাসে বা বছরে। রাস্তায় আলোর স্বল্পতা, রাতে কাজ করা বা যাতায়াত করা এবং উত্তরোত্তর ভয়ের অনুভূতি বৃদ্ধি বা প্রকৃত সহিংসতার চিত্র ব্যাপক প্রচার পাওয়ার মতো বিষয়গুলোর মধ্য দিয়েই নিরাপত্তার ঘাটতি তৈরি হয় বলে নারীরা মনে করেন। যেসব কারণে নারীরা যৌন হয়রানি বা যৌন আক্রমণের অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকেন সেগুলো হলো- এ ধরনের অভিযোগ করে কোনো লাভ হয় না, অভিযোগ করার প্রক্রিয়াটি খুব জটিল ও বিরক্তিকর, সামাজিক অপবাদ বা কলঙ্কের ভয় এবং আরও নিপীড়নের আশঙ্কা।
শিশু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে শিশুরা কোনো প্রাপ্তবয়স্ক বা বড় শিশুর দ্বারা যৌনতামূলক আচরণের শিকার হয়। এক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন বলতে বুঝায় কোনো শিশুর যৌনতামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা যার উদ্দেশ্য কোনো ব্যক্তির শারীরিক সন্তুষ্টি লাভ বা বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া। এই ধরনের যৌন নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে কোনো শিশুকে যৌনতামূলক কাজ করতে বলা বা চাপ দেওয়া, যৌনাঙ্গের প্রদর্শন করতে বলা বা বাধ্য করা, শিশুকে পর্নো দেখানো, কোনো শিশুর সঙ্গে সত্যিকার অর্থে যৌন সঙ্গীর মতো আচরণ করা, শিশুর যৌনাঙ্গ স্পর্শ করা বা দেখা বা শিশু পর্নো তৈরি করা এবং শিশুদের কাছে যৌনতামূলক সেবা বিক্রয় করা।
শিশু যৌন নির্যাতনের প্রভাবের মধ্যে লজ্জা ও আত্মগস্নানি, হতাশা, দুশ্চিন্তা, ট্রমাপরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, আত্মসম্মানের অভাব, যৌন অক্ষমতা, প্রজনন অঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, আসক্তি, নিজেকে আঘাত করা, আত্মহত্যার প্রবণতা, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, পরবর্তী সময়ে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর পুনরায় ওই ঘটনা ঘটানো/ঘটনার শিকার হওয়ার প্রবণতা, বুলিমিয়া নার্ভোসা এবং শিশুর শারীরিক আঘাতও হতে পারে অন্যান্য সমস্যাগুলোর একটি। আত্মহত্যার প্রচেষ্টার ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাবক হলো শিশু যৌন নির্যাতন। নির্যাতিত হওয়ার অনেক বছর পরেও নির্যাতিতের মাঝে অধিকাংশ ক্ষতিই দৃশ্যমান থাকে। পারিবারিক সদস্যদের মাধ্যম দ্বারা যৌন নির্যাতিত হলে লম্বা সময়ের জন্যে মানসিক ট্রমাসহ ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে।
\হযে সমস্ত শিশু যৌন হেনস্তা বা নির্যাতনের শিকার হয়, তারা যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে কারণ তাদের ওই সমস্ত রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা তৈরি হয়নি এবং জোরপূর্বক যৌন মিলনের ফলে তাদের শ্লৈষিক ঝিলিস্ন ছেড়ার মতো ক্ষতি হতে পারে। কম বয়সে যৌনতার শিকার হওয়াকে এইচআইভির মতো রোগ ছড়ানোর ঝুঁকির সঙ্গে বিবেচনা করা হয় কারণ যৌনতা সমন্ধে কম জ্ঞান, এইচআইভির দ্রম্নত বৃদ্ধি, যৌন মিলনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রয়োগ, কনডম ব্যবহার না করা, নিরাপদ যৌন মিলনের পন্থা না জানা, ঘন ঘন যৌন সঙ্গী বদল, অনেক বছর ধরে যৌন কর্মকান্ডে জড়িত থাকা।
বিশ্বে ১৮-১৯% মহিলা এবং ৮% পুরুষ তাদের শৈশবকালে যৌন নির্যাতিত হওয়ার কথা প্রকাশ্যে এনেছে। মেয়েদের উচ্চমাত্রায় নির্যাতিত হওয়া বা ছেলেদের যৌন নির্যাতনের কথা প্রকাশ্যে না আনার প্রবণতা বা উভয় কারণের জন্য লিঙ্গ বৈষম্যই মূলত দায়ী। অধিকাংশ শিশু যৌন নির্যাতনকারী নির্যাতিতের পূর্ব পরিচিত। ৩০% নির্যাতনকারী খুব নিকটাত্মীয় এমনকি কাকা, মামা অথবা কাজিনও হতে পারে। অন্যান্য ৬০% পরিচিতের মধ্যে পারিবারিক বন্ধু অথবা প্রতিবেশী হতে পারে। এছাড়া মাত্র ১০% নির্যাতনকারী অপরিচিত হয়ে থাকে। অধিকাংশ শিশু যৌন নির্যাতন পুরুষের দ্বারা হয়ে থাকে তবে মহিলাদের দ্বারা সংঘটিত নির্যাতনের ১৪% মেয়েদের প্রতি এবং ৬% ছেলেদের প্রতি হয়ে থাকে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। গবেষণা অনুযায়ী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ বোধশক্তির অভাবে যৌন লাঞ্ছিত বা নির্যাতিত হওয়ার বড় ঝুঁকিতে আছে। বয়স্ক মানুষ বিশেষ করে যাদের মানসিক সমস্যা আছে তারাও যৌন নির্যাতনের ঝুঁঁকিতে আছে। অনেক সময় নির্যাতিতদের বিশ্বাস করা হয় না কারণ মানসিক সমস্যার কারণে তাদের বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। অপরাধীরা বারবার এদের টার্গেট করে কারণ তারা জানে, এরা বিশ্বাসের অনুপযোগী।
রক্ষণাবেক্ষণকারীদের দ্বারা নির্যাতনও একটি অপরাধ। নির্যাতিতরা আত্মসম্মানের ভয়ে বা অনিচ্ছার জন্য নির্যাতনের কোনো রিপোর্ট করে না বা তদন্তকারীকে সহায়তা করে না।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো মহিলা কর্মীর সঙ্গে তার পদমর্যাদা বা অবস্থান নির্বিশেষে, একই প্রতিষ্ঠানে কোনো ব্যক্তি এমন কোনো ব্যবহার করতে পারবে না- যা অশোভনীয় বা সেই মহিলা শ্রমিকের শালীনতাকে হানি করে। ২০০৯ সালের মে মাসে পূর্ববর্তী ২০০৮ সালের পিটিশন নং ৫৯১৬ এর শুনানিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট যৌন হয়রানি বিষয়ক বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করে এবং নিয়োগকর্তাদের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। যৌন হয়রানি বিষয়ক নির্দেশিকা সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা আবশ্যক এবং যৌন হয়রানি বিষয়ে শুরু থেকে শেষ অবধি এবং শ্র্রমিককে ধারণা প্রদান করতে হবে। এই নির্দেশিকা যৌন হয়রানি অপরাধের প্রতিরোধ সংক্রান্ত পদক্ষেপসহ সচেনতা বৃদ্ধি এবং যৌন অপরাধ সম্পর্কে আইনি বিধানমালা প্রচার করার কাজ চিহ্নিত করে থাকে। এছাড়াও এই নির্দেশিকার মধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, অভিযোগ প্রক্রিয়াসহ কর্মস্থলে একটি অভিযোগ কমিটির প্রতিষ্ঠা এবং ফৌজদারি মামলাসমূহের বিবরণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন-২০০৩ অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তার শরীরের যে কোনো অঙ্গ বা কোনো বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করেন তা হলে তার এই কাজ হবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য ওই ব্যক্তি অনধিক ১০ বছর কিন্তু অনু্যন তিন বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন যৌন নির্যাতন ও হয়রানি রোধসহ একটি সুরক্ষিত ও নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনসাধারণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকরি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের এ সম্পর্কে সচেতন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার-প্রচারণা চালানো ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন বছরে আগত শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিক পাঠ শুরুর পূর্বে এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ ধারণা প্রদান করা এবং মানসিকতা পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিশেষ সহায়তা প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে। যৌন হয়রানি বন্ধে সংবিধান এবং বিদ্যমান আইন ও বিধির সংশ্লিষ্ট ধারা ও উপধারার আলোকে নীতিমালা প্রণয়ন ও পুস্তিকা আকারে তা প্রকাশ ও যৌন হয়রানিমূলক কর্মকান্ড ও অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে সবাইকে যথাযথভাবে ধারণা প্রদানের স্বার্থে সঠিকভাবে প্রচার করা এবং যৌন হয়রানি ও সহিংসতা বলতে যা বোঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে সবাইকে যথাযথ ধারণা প্রদান করতে উপযুক্ত স্থানে নোটিশ আকারে ঝুলিয়ে রাখা, প্রকাশ করা এবং সবার মধ্যে সঠিকভাবে বিতরণ করতে হবে।
আরাফাত রহমান : কলাম লেখক