পাঠক মত

এইডস প্রতিরোধে করণীয়

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
এইডস একটি সংক্রামক রোগ, যা এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণের মাধ্যমে হয়। এটি মানুষের দেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। এইচআইভি সংক্রমণের ফলে অন্যান্য রোগ যেমন-নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস এমনকি ক্যানসারও হতে পারে। এইচআইভি সংক্রমণের পরের ধাপকেই এইডস বলা হয়। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৭ কোটি ৮ লাখ মানুষ মরণব্যাধি এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ কোটি ৯০ লাখ আক্রান্ত রোগী মারা যায়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দাবি করেছেন, গত ৩০ বছরেরও বেশি সময়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত ঠিক কোথা থেকে এইচআইভি ভাইরাস এসেছে, তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। গবেষকরা বলেন, আফ্রিকার বেলজিয়ান কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসা থেকে ১৯২০ সালের দিক প্রথম এইচআইভি ছড়ানোর প্রমাণ মিলেছে। হাজারো মানুষের জেনেটিক বিশ্লেষণ করে এই প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছেন তারা। মধ্য আফ্রিকার দেশ বেলজিয়ান কঙ্গো ১৯০৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বেলজিয়ানদের ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। এখান থেকে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক মাধ্যমে মধ্য আফ্রিকায় এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ে বলে গবেষকরা দাবি করেন। গবেষকরা বলছেন, 'ঔপনিবেশিক একটি শহর থেকে মারাত্মক এইডসের উৎপত্তি হয়। এখনকার কিনসাসা তখন লিওপোল্ডভিল নামে পরিচিত ছিল, পরে মধ্য আফ্রিকার বৃহত্তম শহুরে এলাকা হয়ে দাঁড়ায়। এখানে নিকটস্থ বন থেকে সংগৃহীত বন্য পশুর মাংস বিখ্যাত ছিল। অক্সফোর্ডের গবেষকরা দাবি করেছেন, এইচআইভি-১ ভাইরাস আবিষ্কারের ৩০ বছর পর মানুষের মধ্যে ব্যাপক আকারের এইচআইভি ছড়িয়ে পড়া, স্থানান্তরিত হওয়ার কারণ অজানাই ছিল। মধ্য আফ্রিকার এইচআইভি-১ সংক্রান্ত তথ্য-পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯২০ সালের দিকে কিনসাসা থেকেই উৎপত্তি হয়েছিল এই ভাইরাসের। মানুষের মধ্যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে সামাজিক পরিবর্তন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ভূমিকা রয়েছে। গবেষকরা বলছেন, নতুন ধরনের পদ্ধতিতে এইচআইভি ভাইরাসের জেনেটিক বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে। শিম্পাঞ্জি, গরিলা ও বানর থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ১৩টি ঘটনা নথিভুক্ত রয়েছে। কিন্তু এইচআইভি-১ এর এম গ্রম্নপটিই মানুষের মধ্যে বেশি ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। এইচআইভি-১ ভাইরাসের গ্রম্নপ 'এম' এবং আরেকটি গ্রম্নপ 'ও' ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একই হারে বাড়লেও পরে এম গ্রম্নপটি তিন গুণ হারে বেড়েছে। এর কারণ হতে পারে সুচের একাধিকবার ব্যবহার ও যৌনকর্মীদের কাছে যাওয়ার হার বেড়ে যাওয়া। গবেষক অলিভার পাইবাস এ প্রসঙ্গে বলেন, 'আমরা প্রথমবারের মতো সব সহজলভ্য প্রমাণ ফাইলোজিওগ্রাফিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করি। এতে ভাইরাসটি কোথা থেকে এসেছে তা পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ধারণা করা সম্ভব হয়। এর অর্থ ভাইরাসের উৎপত্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেই বলা সম্ভব। গবেষক নুনো ফারিয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, কিনসাসা ওই সময় দ্রম্নত এগিয়ে চলছিল। মধ্য আফ্রিকার বৃহত্তম শহর হিসেবে পুরো কঙ্গোর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ঔপনিবেশিক আমলের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৪০ সালের শেষ নাগাদ প্রতি বছর রেলে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ কিনসাসায় যেতেন। জেনেটিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কঙ্গোতে দ্রম্নত এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ে। এইডসের লক্ষণ: জ্বর, মাথাব্যথা, ফুসকুড়ি,পেশি বা যৌথব্যথা, গলাব্যথা। এইডস প্রতিরোধে করণীয়: এইচআইভির প্রতিরোধের মূল উপাদান হলো শিক্ষা, সচেতনতা, ঝুঁকির মাত্রা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও ধারণা। মানুষের চিন্তায় ও আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এইডস প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে হবে। বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে হবে। একাধিক যৌন সঙ্গী পরিহার করতে হবে। নিরাপদ যৌনক্রিয়ার অভ্যাসের মাধ্যমে অসংক্রামিত মানুষ এইচআইভি সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে। নিয়মিত ও সঠিকভাবে কনডম ছাড়া যৌন মিলন থেকে বিরত থাকতে হবে। অবাধ ও অবৈধ যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকাই হলো এইচআইভি সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। যারা শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ নেয়, তাদের বেলায় উৎকৃষ্ট উপায় হলো ইনজেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ না নেওয়া। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে এইচআইভি সংক্রমিত রোগীর সঙ্গে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য সুচ, সিরিঞ্জ, বেস্নড বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার পরিহার করতে হবে। একবার ব্যবহার করা যায় এমন জীবাণুমুক্ত সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে। শরীরে রক্ত বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণের প্রয়োজন হলে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে সে রক্ত বা অঙ্গ- প্রত্যঙ্গে এইচআইভি রয়েছে কিনা। যৌন রোগ বা প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই কারও যৌন রোগ বা প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে দ্রম্নত চিকিৎসা করাতে হবে। এইচআইভি আক্রান্ত মায়ের থেকে সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকখানি। তবে যে সব মায়েরা প্রয়োজনীয় থেরাপি গ্রহণ করেন, তাদের ক্ষেত্রে গর্ভস্থ সন্তান আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৮৫ ভাগ। জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রতিরোধমূলক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। হোমিও সমাধান : রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। এইডস নিয়ে হোমিওপ্যাথির অবস্থান আমরা জানি, এইচআইভি সংক্রমণ ঘটে থাকে রক্ত, বীর্য, ভেজাইনাল বা সার্ভিক্যাল গ্রাব এবং মায়ের দুধের মাধ্যমে। প্রাথমিকপর্যায়ে এর লক্ষণ প্রকাশ নাও হতে পারে। তবে একিউট রেট্রোভাইরাল সিনড্রম দেখা দিতে পারে। ক্লিনিক্যাল স্টেজ-১, এতেও লক্ষণ তেমন প্রকাশ পায় না; কিন্তু লসিকাগ্রন্থি অনেক দিন ধরে ফোলা থাকতে পারে, বিশেষভাবে ইঙ্গুইনাল লসিকাগ্রন্থি। ক্লিনিক্যাল স্টেজ-২, এতে ওজন হ্রাস পেতে থাকে। বারবার সাইনোসাইটিস, টনসিলাইটিস, ওটাইটিস মিডিয়া ও ফ্যারিনজাইটিস হতে পারে। এ পর্যায়ে হার্পস জোস্টার, মুখে ঘা ও নখে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হতে পারে। ক্লিনিক্যাল স্টেজ-৩, এতে ওজন হ্রাস অব্যাহত থাকে। এক মাসের বেশি ডায়রিয়া থাকতে পারে। নিয়মিত জ্বর থাকতে পারে। মুখে ঘা অব্যাহত থাকে। ফুসফুসে যক্ষ্ণা দেখা দিতে পারে। অথবা নিউমোনিয়া, এমপায়েমা ও জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা হতে পারে। এ সময় রক্তশূন্যতা ও নিউট্রোপেনিয়ার লক্ষণও দেখা যায়। ক্লিনিক্যাল স্টেজ-৪, এতে নিউমোসিস্টাইটিস নিউমোনিয়া কিংবা বারবার ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া লিম্পোমা, ক্যাপোসিস সারকোমা, ইনভেসিভ সার্ভিক্যাল কার্সিনোমাও এ পর্যায়ে হতে পারে। ক্রনিক ডায়রিয়া এ ধরনের রোগীদের নিত্যসঙ্গী। এসব বর্ণিত লক্ষণাগুলো বয়স্ক রোগীদের জন্য প্রযোজ্য। আরও অনেক লক্ষণ এ ধরনের রোগীদের মধ্যে পাওয়া যায়। এইডসের প্রধান কারণ হলো অনিরাপদ যৌনতা। তাই মানুষকে এই নির্ঘাত মৃতু্য থেকে বাঁচাতেই ব্যভিচার ও সমকামিতার মতো অনিরাপদ যৌনতার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইসলাম। ইরশাদ হচ্ছে, 'তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না।' (সুরা বনি ইসরাইল : ৩২) যারা নিজ চরিত্র হেফাজত করবে, তাদের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা করেছে ইসলাম। রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থান (জিহ্বা) এবং দুই ঊরুর মধ্যবর্তী স্থান (যৌনাঙ্গ) এই দুটি জিনিসের হেফাজতের দায়িত্ব নেবে, আমি তার জান্নাতের দায়িত্ব নেব।' (বুখারি: ৮/১০০) আর আলস্নাহ মানুষকে রোগ-ব্যাধি দিয়ে থাকেন। কিন্তু কোনো কোনো রোগ মানুষের পাপ তথা সীমা লঙ্ঘনের কারণেও হয়ে থাকে। যা মানুষের জন্য অভিশাপ। এইডসের মতো মরণব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে এবং জাতিকে মুক্ত রাখতে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার বিকল্প নেই। এইডস সম্পর্কিত তথ্য সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। সচেতনতা সৃষ্টি করা- এইডস কী? কেন এবং কীভাবে এ রোগের সৃষ্টি হয়? কীভাবে তা দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে? এর পরিণাম কী? এ বিষয়গুলো মানুষকে অবহিত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলেই এইডসের মতো মরণব্যাধি থেকে সমগ্র জাতি মুক্তি লাভ করতে পারবে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা- যারা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে তুলনামূলকভাবে তাদের এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে ৫০% এইডস রোগীর বয়স ১৫-২৪ বছরের মধ্যে। সুতরাং প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত তার সন্তান কোথায় যায়, কি করছে। ১৫ বছরের আগে সন্তানরা সাধারণত বাবা-মায়ের সঙ্গেই বেশি থাকে। তাই তাদের ধর্মীয় জীবন-যাপনের প্রতি জোর দেওয়া বাবা-মায়ের একান্ত কর্তব্য। রাসুল সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া সালস্নাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থান (জিহ্বা) আর দুই ঊরুর মধ্যবর্তী স্থানের (যৌনাঙ্গের) দায়িত্ব নেবে, আমি তার জান্নাতের দায়িত্ব নেব।' অবাধ যৌনাচার এইডস রোগ হওয়ার একটি মাধ্যম। তাই আলস্নাহর নির্দেশ মেনে অবাধ যৌনাচার থেকে মুক্ত থাকাই কোরআন ও হাদিসের অকাট্য নির্দেশ। ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি