দেশের বর্তমান পরিস্থিতি

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তো শুধু আমদানি করেই দেশের চাহিদা মেটানো হয় না, তার বড় অংশ দেশেই উৎপাদিত হয়। এ দপ্তর আবার কৃষিমন্ত্রীর। তিনি অহরহ বলে থাকেন- বাংলাদেশ খাদ্যপণ্য উপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমনকি বেশ কিছু পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করা হয় দেশের চাহিদা মিটিয়ে। দেশে কাদের চাহিদা মেটানো হয়? কারণ চালের দাম তো হুহু করে বাড়ছে। বেড়েছে মাছের দামও। ভুগছে মানুষ, লাভবান হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

রণেশ মৈত্র
কিছুদিন আগে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা হঠাৎ করেই সরকার বাড়াল সম্পূর্ণ বিনা কারণে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম দ্রম্নত নিম্নমুখী জেনেও- যা হোক সবাই মিলে দাবি জানান হলো তেলের দাম কমানোর। কে শোনে কার কথা। হুঁশিয়ারি দিলেন পরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা অবিলম্বে মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহার না করলে বাংলাদেশে কোনো পরিবহণ চলবে না। পরিবহণ অর্থাৎ যাত্রী ও পণ্য সব রকম পরিবহণেই বন্ধ করে দেওয়া হলো অনির্দিষ্টকালের জন্য। দেশের ভয়াবহ অচলাবস্থা- সবকিছু স্থবির, অচল জনজীবন বিপর্যস্ত। দ্রব্যমূল্য সিন্ডিকেট এ সুযোগ ছাড়বে কেন? তারা পরিবহণ সংকটের অভিযোগে তেল, নুন, চাল, ডাল শাকসবজি, মাছ-মাংস প্রভৃতির দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিল। মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী মালিক-শ্রমিক সমিতির নেতাদের বৈঠকে ডাকলেন নির্দিষ্ট দিন ও সময় দিয়ে। সমিতির নেতারা জানালেন তারা ওইদিন বসবেন না পরদিন বসতে রাজি। মন্ত্রী মহোদয় তাতেই সম্মত। পরদিন বৈঠক; খানাপিনা সব হলো। মালিক-শ্রমিকরা ভাড়া যে পরিমাণ বৃদ্ধির দাবি জানালেন, বুঝিয়ে সুঝিয়ে মন্ত্রী তার কিছু কমে রাজি করালেন। ভাড়া বাড়াল। বাড়ল সবকিছুরই দাম। ডিজেল চালিত নয়, এমন যানবাহন (গ্যাস চালিত) এর সংখ্যা প্রায় সমান সমান। সুযোগটি হাতছাড়া না করে তারাও সমভাবে ভাড়া বাড়ালেন একই সঙ্গে। যেমন ডাকাতি- তাও আবার দিনে দুপুরে এবং সর্বত্র। সরকার গ্যাস চালিত পরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধি না করতে বললেন। মালিকরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাল। ডিজেল চালিত পরিবহণ মালিকরা সরকারের কাছে স্বীকৃতি মতে না বাড়িয়ে অনেক বেশি বাড়ালেন তাদের পরিবহণের ভাড়া। সরকার হুঁশিয়ারি জানাল। এটাও অমান্য হলো। বসানো হলো মোবাইল কোর্ট। তারা বাড়তি ভাড়া নেওয়ায় জরিমানা দিল কিন্তু বাড়তি ভাড়ায় পরিবহণ চালানো অব্যাহত রাখল। মানুষের পকেট কাটা যাচ্ছে কিন্তু তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সরকার ও মালিকদের ডবল লাভ হচ্ছে। বিশ্ব কমদামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করায় আগের তুলনায় বেশি লাভবান হচ্ছেন এবং হতেই থাকবেন- কারণ এ দেশে দাম একবার বাড়লে তা সরকারই হোক বা ব্যবসায়ীই হোক আর কমান না। পরিবহণ মালিকরা সরকারের সঙ্গে আলাপ করে একদফা ভাড়া বাড়ালেন আর এক দফা তার ওপর নিজেরা বাড়ালেন। মন্ত্রী মহোদয়ের হুমকি ও মোবাইল কোর্টের কাজও চলছে। তেলের দাম বাড়ায় কতই না সুযোগ সৃষ্টি করল। অথচ বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে। এই একটা ব্যাপার যার কোনো বাপ-মা নেই নেই কোনো অভিভাবকও। পরিবহণের দ্বিগুণ বাড়ল আর দ্রব্যমূল্য বাড়ল তিনগুণ। দেশে বৃষ্টিপাত হলো; দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হলো বৃষ্টির অজুহাতে। দেশে খরা হলো দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হলো সেই অজুহাতে। ভারত রপ্তানি বন্ধ করল পেঁয়াজ কাঁচামরিচের দাম দিগুণ বাড়ল। সরকার তেলের দাম (খারাপ তেল) লিটারে পাঁচ টাকা বাড়াল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সেই সুযোগে আরও ১০-১৫ টাকা বাড়িয়ে দিল। এ ব্যাপারে একজন মন্ত্রী আছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি ট্যাক্স কমানো হলো। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দাম আরও বাড়াল। সরকার বলল টিসিবি সারাদেশে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি চালু করবে বাজারে সবকিছুর দাম স্থিতিশীল রাখতে। টিসিবির ওই ট্রাকের সাক্ষাৎ জনগণ পায় না ট্রাকগুলো কোথা দিয়ে কখন আসে তাও কেউ জানে না। সম্ভবত, বৃহৎ ব্যবসায়ীরা ট্রাকগুলো থেকে পণ্য কিনে খালি করে দিয়ে নিশ্চিন্তে লাভের মাত্রা বাড়াতে থাকেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তো শুধু আমদানি করেই দেশের চাহিদা মেটানো হয় না, তার বড় অংশ দেশেই উৎপাদিত হয়। এ দপ্তর আবার কৃষিমন্ত্রীর। তিনি অহরহ বলে থাকেন- বাংলাদেশ খাদ্যপণ্য উপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমনকি বেশ কিছু পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করা হয় দেশের চাহিদা মিটিয়ে। দেশে কাদের চাহিদা মেটানো হয়? কারণ চালের দাম তো হুহু করে বাড়ছে। বেড়েছে মাছের দামও। ভুগছে মানুষ, লাভবান হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ডাল, তরিতরকারি, শাকসবজির দাম শীতকালেই কম থাকে। কিন্তু এবার? এবার ঠিক উল্টোটা। এবার বেড়েছে, আজও বাড়ছে কৃষিপণ্যের দাম সব নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে। মন্ত্রী আছেন আর তার বিশাল কর্মী বাহিনী আছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজে বা খাঁটি জিনিস বিক্রির কাজ দেখাশুনা করতে কাউকে কখনো দেখা যায় না। মন্ত্রী মহোদয় ঢাকায় থাকেন- সংবাদ সম্মেলন করেন, ট্যাক্স কমান, ট্যাক্স বাড়ান। ব্যস। জনগণ ভুগছে ভুগুক। রয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা। দীর্ঘদিনের এই সমস্যার সমাধানের দাবি সবারই এবং তা দীর্ঘদিনের। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা সর্বস্ব হারিয়ে দেশ ছাড়তে এবং সর্বাধিক নিকটবর্তী দেশ বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বর্বর মিয়ানমার শাসকরা জঘন্য সাম্প্রদায়িক মনোভাবে তাড়িত হয়ে লাখ লাখ অসহায় রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকৃতি জানাল। তাদের দাবি, রোহিঙ্গারা বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাঙালির মতোই তাদের জীবনাচরণ, তাই তারা বাংলাদেশি। কিন্তু উত্তর দিতে ওই শাসকগোষ্ঠী অপারগ যদি তারা বাংলাদেশের নাগরিকই হয় তবে তাদের জমি-জমা, বাড়িঘর, প্রার্থনা গৃহ, স্কুল-কলেজের পড়াশুনা কীভাবে শত শত বছর ধরে পূর্ণ স্বীকৃতি নিয়ে বসবাস করল। উগ্র ধর্মান্ধ বৌদ্ধ শাসকরা বস্তুত দেশটাকে রোহিঙ্গা শূন্য করে তাদের বাড়িঘর, দোকান-পাট, সহায়-সম্বল দখল করার লক্ষ্যে তাদের উচ্ছেদ সাধন করেছে- যা একবিংশ শতাব্দীর সব নৃশংসতা- সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। এই রোহিঙ্গাদের মধ্যেও উগ্রবাদীর অস্তিত্ব ছিল যারা 'আরসা' নামে সংক্ষেপে পরিচিতা মিয়ানমারের শাসককে তারাও নানা হঠকারিতা দ্বারা তাদের বিরোধী করে তুলেছিল। সেই সময় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে বসে 'আরসার' অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের নানা ক্যাম্পে খুনাখুনির পর থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। যাতে রোহিঙ্গারা দেশে ফিরতে না চায় তাই প্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক রোহিঙ্গা নেতাদের হত্যার অভিযান শুরু করে। বাংলাদেশের পুলিশও আরসার অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং ব্যাপক তলস্নাশি চালিয়ে রোহিঙ্গাদের নানা ক্যাম্প থেকে চোরাই অস্ত্র, মাদক, ইয়াবা প্রভৃতি উদ্ধার করে। কাজেই পরিস্থিতি জটিল। কয়েক মাস আগে জাতিসংঘ বলেছিল রোহিঙ্গারা যেন বাংলাদেশি নাগরিকের মতো জমি কেনাবেচা, ব্যবসাবাণিজ্য, বিয়েশাদি এবং বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার পায় তা দেখা উচিত। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং এই তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। ইদানীং ওই জাতিসংঘ সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এগিয়ে আসতে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। তদুপরি আসিয়ানও দিন কয়েক আগে অনুষ্ঠিত তাদের সভারও অনুরূপ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করেছে। পৃথিবীব্যাপী, বাংলাদেশে তো বটেই, এর ফলে যথেষ্ট আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমার সরকারের ওপর এতে অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে চাপ সৃষ্টি হয়েছে- কিন্তু এত কিছুর পরেও মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সর্বসম্মত প্রস্তাব এবং তাদের এতদিনকার দৃঢ় সমর্থক চীন ও রাশিয়াও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার পরেও আজ পর্যন্ত তাদের মুখ না খোলায় সব মহলেই সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কূটনীতিও এযাবৎ কোনো সাফল্যের আলো দেখাতে পারেনি। অপরদিকে সমগ্র রোহিঙ্গা একাকার হয়ে দাঁড়িয়েছে নানা বিপদাশংকার প্রতীক। সেখানে চোরাকারবারি অত্যন্ত ব্যাপক এবং তা ছাড়াও নানা বে-আইনি পন্থায় অনেকে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট প্রভৃতি সংগ্রহ করে এ দেশে নানা কিছুর মালিকানা অর্জন করেছে। এ ব্যাপারগুলো ঘোর দায়িত্ব পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। ব্যর্থতার কারণে তাদের মুখ খুলতে দেখা যায় না। আরসা প্রতিরোধে ও নির্মূলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাফল্যও সন্দেহমুক্ত নয়। তবুও চলছে এ দেশ মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। মারাত্মক অসুবিধা ভোগ করছেন আজ কয়েকটি বছর ধরে কক্সবাজার, রাঙ্গামাটির আদি বাংলাদেশি বাসিন্দারা। তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন, রোহিঙ্গাদের চাপে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশাল সৌন্দর্যময় ওই এলাকার পরিবেশও নিরাপত্তা এতটাই বিপন্ন হচ্ছে যে, বিদেশি পর্যটকরাও আসতে দ্বিধা বোধ করছেন। ওখানকার হোটেল শিল্প, পরিবহণ শিল্প প্রভৃতি হচ্ছে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রা অর্জনও হচ্ছে চরমভাবে বিঘ্নিত। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আজ নানা অত্যাচারে জর্জরিত। দুর্গাপূজার শুরুতে নতুন করে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয় তখন রীতিমতো সোরগোল উঠেছিল। প্রতিবাদ অতীতেও হয়েছে কিন্তু ক্ষীণকণ্ঠে যা সবাই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। কিন্তু এবারে কুমিলস্না দুর্গামন্দিরে ঘটনার পর পরই তা যেভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল তা পাকিস্তানি আমলকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে আশার কথা, এবারে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে দেশব্যাপী সাংবাদিকরা লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ দেশব্যাপী সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করেছে শিল্পী, সাহিত্যিক প্রমুখরা সদলবলে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, নানা বিরোধী রাজনীতিক দল মিছিল করেছে- সরকারি দলও একদিন মিছিল সমাবেশ করেছে। প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনাবলিতে যারাই দায়ী তারা দলেরই হোক আইন তাদের রেহাই দেবে না- সবাই কঠোরভাবে শাস্তি পাবেন। অতঃপর নানাস্থানে কতিপয় গ্রেপ্তারের খবর এলো কিন্তু সে সময়কার সংঘটিত, পূর্ব পরিকল্পিত পরিকল্পনাগুলোর কোনো সুরাহা না হতেই বহু বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেশের নানা অঞ্চলে ঘটে চলেছে। অনেক মন্দিরে সন্দেহভাজন লোকজনের আনাগোনা দেখে পুলিশ প্রহরায়ও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু কথাতো ছিল দ্রম্নত তদন্ত শেষ করার, দ্রম্নত চার্জশিট প্রদানের এবং বিশেষ ট্রাইবু্যনাল গঠন করে অভিযুক্ত সবার দ্রম্নত বিচারের ব্যবস্থা করে উপযুক্ত শাস্তি বিধানের। কোথায় সেই দ্রম্নততা? কোথায় সেই কঠোরতা? রণেশ মৈত্র : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক