পাঠক মত

মুক্তিযুদ্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভূমিকা

প্রকাশ | ১২ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মহান মুক্তিযুদ্ধে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সমাজের ভিতরে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষের অভাব ছিল না। বিভিন্ন সমাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তখন সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এবং সমমনা মানুষের সমন্বয়ে অনেক সংগঠনের সৃষ্টিও হয়েছিল তখন। যেমন- সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা ঐক্য পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা ঐক্যজোট, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ এমন কয়েকটা সংগঠন ছিল। এরা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন যুব সংগঠন বা ক্লাব ছিল এবং তৎকালীন সময়ে কিছু সংগঠন গড়ে উঠেছিল যে সব সংগঠনের কেউ কেউ সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং অনেকে নিজ এলাকায় থেকে এলাকার সাধারণ মানুষকে রক্ষা করেছিল। রাজাকারের আগমন টের পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করে দিতেন। অনেক আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তারা গোপনে চিকিৎসা সেবা দিতেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, সংখ্যালঘু পরিবারকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রাজাকার এবং পাকবাহিনীর খবর সরবরাহ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কথা বলতে গেলে রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের কথাও চলে আসে। এ সব সংগঠনের অমানুষ আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল। তারা পাকিস্তানি পশুদের সাহায্য করত, পথ দেখাত। পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে স্বেচ্ছায় শ্রম দিত।তারাই জাতির শ্রেষ্ঠ কুলাঙ্গার। অনেক সময় এই রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা একই ঘরে থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা ভাই রাজাকার ভাইকে ক্ষমা করেনি। বাগেরহাট জেলায় এমনই একটি যুব সংগঠন ছিল। সংগঠনের পরিচালক ছিলেন এক যুবক এবং তার শ্বশুর। ৭১'এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা এবং তাদের সংগঠনের সদস্যরা গ্রামের সাধারণ জনগণকে সর্বদা রক্ষা করেছিলেন। সংখ্যালঘুদের নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে একজনের ভাই রাজাকার ছিল। সে তার ভাইকেও ক্ষমা করেনি। অন্য রাজাকারদের মতো তার ভাইকেও মেরে ফেলা হয়েছিল তারই আদেশে। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সাংগঠনিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা নিজেদের মতো করে স্বাধীনতার পক্ষে বাহিনী গঠন করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী পরে যার নাম হয়েছিল বাঘা সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত অনেক বাহিনীর মধ্যে এটা ছিল বৃহৎ সংগঠন। এ ছাড়া অনেক সামাজিক সংগঠন ছিল যা তখন পরিচিতি পায়নি। প্রতিটি গ্রামে এমন সংগঠন না থাকলে পাকিস্তানিদের হাত থেকে কেউ রেহাই পেত না। দেশের সাধারণ মানুষকে রক্ষায় এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংগঠনগুলো অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিল। তৎকালীন সময়ে অনেকে বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিয়েছে। গানের মাধ্যমে, কবিতার মাধ্যমে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেছিল। সাংস্কৃতিককর্মীদের কাছে সংস্কৃতিই হয়ে উঠেছিল হাতিয়ার। মুক্তিযুদ্ধের সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেই সময়ের দেশাত্মবোধক ও জাগরণী গান। কোটি কোটি মুক্তিকামী মানুষ এবং রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল এ সব গান। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, ফুল খেলিবার দিন নয় অদ্য, জনতার সংগ্রাম চলবেই, মানুষ হ মানুষ হ, 'জয় বাংলা বাংলার জয়, হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়', মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে। এ সব কালজয়ী গান তৎকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো। শিক্ষক, শিল্পী, কবি, সাংবাদিক, নাট্যকার, সাংস্কৃতিককর্মীদের অবদান অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন সংবাদসহ যে অনুষ্ঠানগুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করে তার মধ্যে চরমপত্র এবং জলস্নাদের দরবার অন্যতম। এম আর আক্তার মুকুলের পাঠ করতেন চরমপত্র। ব্যঙ্গাত্মক এবং রঙ্গ-রসের মাধ্যমে বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করেছিল এই অনুষ্ঠানটি। যে সব ব্যক্তির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এত জনপ্রিয়তা লাভ করে তারা হলেন জিলস্নুর রহমান এমএনএ, ড. আনিসুজ্জামান, সিকান্দার আবু জাফর, কল্যাণ মিত্র, আবদুল গফফার চৌধুরী, কামাল লোহানী, সৈয়দ হাসান ইমাম, কবি নির্মলেন্দু গুণ, আব্দুল জব্বার খান, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ঔপন্যাসিক জহির রায়হান, হাসান ইমাম, আতাউর রহমান, কালজয়ী গান 'জয় বাংলা বাংলার জয়' গানটির লেখক গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সোহেল রানা, চাষী নজরুল ইসলাম, আলী জাকেরসহ প্রমুখ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গেয়েছেন সমর দাস, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, অরুণ গোস্বামী, মান্না হক, মাধুরী চ্যাটার্জি, এম চান্দ, ইয়ার মোহাম্মদ, প্রবাল চৌধুরী, লাকী আকন্দ, তিমির নন্দী, মিতালী মুখার্জি, মলয় গাঙ্গুলি, রফিকুল আলম প্রমুখ শিল্পীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ্তুঈড়হপবৎঃ ঋড়ৎ ইধহমষধফবংয্থ ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল সমগ্র বিশ্বে নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে প্রায় ৪০০০০ দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত জর্জ হ্যারিসন এবং ভারতীয় সেতার বাদক রবিশঙ্করের কর্তৃক সংগঠিত হয় দুটি কনসার্ট। এই কনসার্টের মাধ্যমে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষের কানে পৌঁছে দেয় বাঙালির উপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের ঘটনা। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ তার কাব্যে ফুটে ওঠা বাঙালির দুর্দশা মুক্তিযুদ্ধে আলোড়ন তুলেছিল। তিনি কবিতার মাধ্যমে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার লেখা কবিতার নাম 'সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড'। কবিতার সূত্র ধরে মৌসুমী ভৌমিকের গাওয়া গান 'যশোর রোড' বাঙালির মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। সংগঠনগুলো জাতির দুর্দিনে সর্বদা সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছে। এখনো সব সময় বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে এ সব সংগঠনের অবদানের কথা বাঙালি জাতি চিরজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। সুকান্ত দাস শিক্ষার্থী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া