মাকির্ন অবরোধ ও ইরানের ভবিষ্যৎ গতিপথ

জাতিসংঘের তদন্ত কমর্কতার্রা বলেছেন, ইরান ২০১৫ সালে করা চুক্তির শতর্ মেনে চলছে। আমেরিকার মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া বলেছে, তারা ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখতে পারবে। জাপানও তেল কিনতে পারবে বলে জানিয়েছে। ইরানের ওপর মাকির্ন নিষেধাজ্ঞার প্রতি সমথর্ন জানানো একমাত্র দেশ হলো ইসরাইল।

প্রকাশ | ১২ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মো. মাঈন উদ্দিন
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শিয়া ধমার্বলম্বী দেশ ইরানের সঙ্গে ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তিতে সই করেন। কিন্তু আমেরিকার বতর্মান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প শুরু থেকেই এই চুক্তির বিরোধিতা করে আসছেন। অবশেষে তিনি ইরানের সঙ্গে করা চুক্তি থেকে বের হয়ে আসেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধের ঘোষণা দেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে নতুনভাবে ও নতুন পযাের্য় অথৈর্নতিক অবরোধ আরোপের মাধ্যমে নতুন যুদ্ধ শুরু করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো ইরানের তেল রপ্তানি কমিয়ে একেবারে শূন্যে নিয়ে আসা। তারা মনে করেন, এ ধরনের উদ্যোগ ইরানকে দেউলিয়া করে দিতে পারে। ফলে সরকার জনগণের সেবা করার সামথর্্য বা সক্ষমতাও হারাবে। আর সরকার জনগণকে সেবা দিতে ব্যথর্ হলে সেখানে সরকারবিরোধী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোলটন ট্রাম্প প্রশাসনের এই উদ্যোগের পেছনে যুক্তি প্রদশর্ন করে বলেন, তিনি ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুভাবাপন্ন একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে কেবল অথৈর্নতিক যুদ্ধ নয়, বরং একটি সামরিক ও কৌশলগত জোট গঠন করে ইরানকে ধ্বংস করতে চায়। এ জন্য ম্যাটিস সুন্নি আরব রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে আরব ন্যাটো গঠন এবং মধ্যপ্রাচ্যের এই কৌশলগত জোটের সঙ্গে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ইসরাইলকেও সংযুক্ত করার কাযর্কর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রাথমিকভাবে বাইরে থেকে এ জোটকে সমথর্ন দিয়ে যাবে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। কিন্তু এই দ্বিমুখী সামরিক-অথৈর্নতিক কৌশল ব্যথর্তায় পযর্বসিত হলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অবমাননাকর। পযের্বক্ষকদের অভিমত হচ্ছেÑ এই দ্বিমুখী সামরিক-অথৈর্নতিক কৌশল ব্যথর্ হলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপমানজনকভাবে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে। মাঝারি মেয়াদে তথা মাঝামাঝি পযাের্য় এসে এটা বুমেরাং হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ক্রমেই প্রভাব হারিয়ে ফেলবে। অন্যদিকে, ইরান আস্থা ও ক্ষমতা অজর্ন করবে। সবচেয়ে খারাপ দৃশ্যপট হিসেবে দেখা যাবে একটি যুদ্ধÑ যে যুদ্ধের ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী। তাদের মতে, ট্রাম্পের অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞার নীতি নানা অসঙ্গতিতে ভরা। এই অবরোধনীতি কাযর্কর হবে না। এর প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ্য করা যায়, ফ্রান্স এবং জামাির্ন সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেনও যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইরানের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য অব্যাহত রাখার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। তারা একটি স্পেশাল পারপাস ভেহিকল সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছেÑ যেটা তাদের মাকির্ন ডলারের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে ব্যবসায় অব্যাহত রাখার সুযোগ দেবে। ইরানি তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীনের বিষয়টিও অধিক গুরুত্বপূণর্। চীনের দুটি বড় রাজ্যের তেল কোম্পানি ইরান থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দিলেও প্রকৃতপক্ষে চীন ইরান থেকে বিপুল পরিমাণ তেল কেনা অব্যাহত রাখতে চায়। ইরান থেকে তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আটটি দেশের ক্ষেত্রে শিথিল করছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এই আটটি দেশের মধ্যে রয়েছে। তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এসব দেশকে ইরান থেকে তেল কিনতে দিতে রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় দেশগুলো, রাশিয়া ও চীন ইরানকে তেল ও গ্যাস রপ্তানি অব্যাহত রাখার অনুমতি দেয় ৬ জুলাই। চীনের একজন কমর্কতার্ সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তেল কেনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে আলোচনা চলছিল এবং কয়েক দিনের মধ্যে এর ফলাফল প্রত্যাশা করছি। একজন চীনা কমর্কতার্ জানান, আমরা মনে করি, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো চীনকেও কিছু ইরানি তেল আমদানি করতে দিতে সম্মত হবেন ট্রাম্প। অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা অথবা অন্য কোনো উপায়ে চীনকে শাস্তি দেয়ার অপশন ট্রাম্পের জন্য খোলা আছে। তবে এমনকি তিনি সম্ভবত চীনের সঙ্গে অথৈর্নতিক যুদ্ধের দ্বিতীয় কোনো ফ্রন্ট খুলবেন না। নরেন্দ্র মোদির ভারতের সঙ্গেও একই বিবেচনায় হয়তো ইরানি তেল আমদানিতে বাধা দেবেন না। ট্রাম্প কি ভারতকে তার শত্রæর দলে ঠেলে দেবেন? এর অথর্ হচ্ছেÑ ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে নিয়ে হিসাব-নিকাশে ভুল করছে। ট্রাম্প মনে করছেন, তিনি আন্তজাির্তক সম্প্রদায়কে ইরানকে শায়েস্তা করার জন্য পাশে পাবেন। তার এই ভুল হিসাব যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। ট্রাম্প অত্যন্ত বড় ঝুঁকি নিয়ে খেলছেন। তিনি ব্যথর্ হলে বা হেরে গেলে আমেরিকার আন্তজাির্তক ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইরানের সবোর্চ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের দেশের মযার্দা ক্ষুণœ করেছেন। ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনবর্হাল করায় শেষ পযর্ন্ত তার পরাজয়ই ঘটবে। এক টুইটে গত শনিবার তিনি এ কথা বলেন। তেহরানে শিক্ষাথীের্দর এক সভায় দেয়া বক্তৃতার কিছু অংশ খামেনি ওই টুইটে তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার মযার্দার অবশিষ্টাংশও ক্ষুণœ করেছেন। একই সঙ্গে ধ্বংস করেছেন উদার গণতন্ত্রকে। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার ঘোষণা দিয়েছে ইরান। গত সোমবার ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি দেশের অথর্নীতিবিদদের সঙ্গে এক আলোচনায় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি, ব্যাংকিং খাতসহ ইরানের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার দেশ সেটি মানবে না। ইরান জ্বালানি তেল বিক্রি অব্যাহত রাখবে। আমরা জানি, পারমাণবিক কমর্সূচি স্থগিত রাখার শতের্ ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় পশ্চিমা দেশের চুক্তি হয়। চলতি বছরের মে মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং আগস্ট মাসে ইরানের ওপর প্রথম দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনবর্হালের ঘোষণা দেয়। ৫ নভেম্বর এই নিষেধাজ্ঞা কাযর্কর হয়। তবে চুক্তিতে সই করা বাকি পঁাচ দেশÑ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জামাির্ন, রাশিয়া ও চীন চুক্তিটি টিকিয়ে রাখার পক্ষে। নিষেধাজ্ঞা পুনবর্হালের পর আন্তজাির্তক সম্প্রদায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জাতিসংঘের তদন্ত কমর্কতার্রা বলেছেন, ইরান ২০১৫ সালে করা চুক্তির শতর্ মেনে চলছে। আমেরিকার মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া বলেছে, তারা ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখতে পারবে। জাপানও তেল কিনতে পারবে বলে জানিয়েছে। ইরানের ওপর মাকির্ন নিষেধাজ্ঞার প্রতি সমথর্ন জানানো একমাত্র দেশ হলো ইসরাইল। মো. মাঈন উদ্দিন: কলাম লেখক