অংশগ্রহণমূলক নিবার্চন হোক উৎসবমুখর

এবার আমরা এমন একটা নিবার্চন চাই যা হবে অবাধ সুষ্ঠু প্রশ্নবিদ্ধহীন। যার কারণে নিবার্চনে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। বিএনপি জোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যে নিবার্চনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা একটি ভালো দিক, দেশের রাজনীতি ও সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য এক উজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ নিবার্চনের বাইরে থেকে তারা যদি আন্দোলন চালিয়ে যেত তাহলে আর যাই হোক দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আনত না। আগের মতো দেশব্যাপী নাশকতা অরাজকতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতো। তাদের এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ও দূরদশীর্। এর আগে বিএনপি নিবার্চন না করে যে ভুল করেছিল, সে ভুল এবার করতে চায়নি। তাই দলটি আন্দোলনের হুমকি দিয়েও নিবার্চনে আসতে বাধ্য হয়েছে।

প্রকাশ | ১৪ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
দেশব্যাপী একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং দেশের মানুষ এখন নিবার্চনমুখি। সবচেয়ে সুখের খবর হচ্ছে, সব দল নিবার্চনে অংশগ্রহণ করছে। ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে অংশ নিতে যাচ্ছে বাম গণতান্ত্রিক জোটও। ফলে রাজনীতির গুমোট হাওয়া দ্রæত অপসারিত হয়েছে। জোট গঠিত হওয়ার প্রায় এক মাসের মাথায় নিবার্চনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানালো জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে নিবার্চনের জন্য আন্দোলনের অংশ হিসেবেই ঐক্যফ্রন্ট একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে অংশ নিচ্ছে। অথচ কিছুদিন আগেও নিবার্চন নিয়ে বিপরীতমুখি অবস্থানে ছিল দেশের দুটি প্রধান দল বা দুটি জোট। আওয়ামী লীগ বলেছিল সংবিধান অনুযায়ী নিবার্চন হবে। অন্যদিকে নিবার্চন নিয়ে সংলাপ আয়োজন ও তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের পদত্যাগসহ বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বেশ কিছু শতর্ দিয়েছিল। তারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিবার্চন এবং নিবার্চন কমিশন পুনগর্ঠনের কথাও বলেছিল। তারা এখন সব শতর্ শিথিল করে নিবার্চনে এসেছে। তাদের এই ইতিবাচক মনোভাব সুস্থ রাজনীতির জন্য মাইলফলক। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা সকলে মিলে নিবার্চন করব। জনগণ যাকে চাইবে তাকে ভোট দেবেÑ সেটাই আমরা করব। সবাই যেহেতু নিবার্চন করবে সে জন্য সবাইকে ধন্যবাদ ও স্বাগত জানাচ্ছি।’ তার এ মন্তব্যও গণতন্ত্রের জন্য আশা জাগানিয়া। আমরা দেশবাসী গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা দেখতে চাই। আমরা সব সময় চেয়েছি একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন হোক অংশগ্রহণমূলক, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে এবং নিবার্চন হবে সহিংসতামুক্ত উৎসবমুখর। কারণ দশম জাতীয় সংসদ নিবার্চন নানা কারণে বিতকির্ত হয়েছিল। বিশেষ করে ভোটারবিহীন ১৫৩ আসন এই বিতকের্র জন্ম দেয়। ওই নিবার্চন ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল চেতনার পরিপন্থী। এই নিবার্চন নিয়ে দেশবাসীর অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বিএনপিকে বাদ দিয়ে এক তরফা নিবার্চন করলে সে নিবার্চন জনগ্রহণযোগ্যতা পেত না, ঠিক তেমনি জাতীয় ও আন্তজাির্তকভাবেও গৃহীত হতো কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল। বিএনপি ১৯৯৬ সালে প্রধানবিরোধী দল আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে একতরফা নিবার্চন করেছিল কিন্তু এক মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। এই কঠিন ও ঐতিহাসিক সত্যটি আমরা ভুলে যাই কী করে। সুতরাং একটি অবাধ সুষ্ঠু নিবার্চন করা, দেশ ও জনগণকে সংঘাত সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারেরই সবচেয়ে বেশি। এটা সত্য, বতর্মান সরকার ভোটারবিহীন ১৫৩ আসন পেয়েও ৫ বছর দাপটের সঙ্গে ক্ষমতায় থাকল। এই সরকারের আমলেই দেশ সমৃদ্ধি অজর্ন করেছে, দাড়িয়েছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। তবে ওই নিবার্চন যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ বিরোধী পক্ষ ওই নিবার্চনকে ভোটারবিহীন বলে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ওই নিবার্চন ভোটারবিহীন নয়।’ যদিও আন্তজাির্তক বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছিল ওই নিবার্চন। এবার আমরা এমন একটা নিবার্চন চাই যা হবে অবাধ সুষ্ঠু প্রশ্নবিদ্ধহীন। যার কারণে নিবার্চনে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। বিএনপি জোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যে নিবার্চনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা একটি ভালো দিক, দেশের রাজনীতি ও সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য এক উজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ নিবার্চনের বাইরে থেকে তারা যদি আন্দোলন চালিয়ে যেত তাহলে আর যাই হোক দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আনত না। আগের মতো দেশব্যাপী নাশকতা অরাজকতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতো। তাদের এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ও দূরদশীর্। এর আগে বিএনপি নিবার্চন না করে যে ভুল করেছিল, সে ভুল এবার করতে চায়নি। তাই দলটি আন্দোলনের হুমকি দিয়েও নিবার্চনে আসতে বাধ্য হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তাদের যে বক্তব্য বা দাবির কথা তা সংসদের বাইরেই বলতে হয়েছে। দল হিসেবে বিএনপি ছিল দুবর্ল ও অসহায়। তাদের নেত্রী এখন কারাগারে। বিএনপির অনেক নেতানেত্রীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা হয়েছে। এই অবস্থায় প্রায়-অস্তিত্বহীন বিএনপির ঘুরে দঁাড়ানোর দরকার ছিল। নিবার্চনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো ঠুনকো কারণে নিবার্চন বজর্ন করা ঠিক হবে না। তা হলে তারা আবার বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে, এই সহজ কথাটি বিএনপির নীতি-নিধার্রকদের মাথায় রাখা উচিত। মনে রাখতে হবে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি ছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যান্য দলের কোনো মূল্য নেই। বাংলাদেশে ব্যক্তি একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া কঠিন। নিবার্চনে সবসময়েই কমবেশি সহিংসতা হয় এবং মানুষ মারা যায়। এ বিষয়টি সরকারও নিবার্চন কমিশনকে মাথায় রাখতে হবে। কোনোভাবেই নিবার্চনী সহিংসতা কাম্য নয়। এ কথা সত্য, ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় এলে বিভীষিকা আর অন্ধকার নেমে আসে, সনাতন ধমার্বলম্বীরা সারা বাংলায় নিপীড়িত হয়, নিযাির্তত হয়, ধষির্ত হয়, ফাহিমা-পূণির্মা। কত হিন্দু রমণীকে পৈশাচিকভাবে ধষর্ণ করেছে ওই ববর্র শক্তি। নিরীহ মানুষের ওপর নিযার্তন চালিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা যাদের মনে আছে তারা হিসাব করেই ভবিষ্যৎ পথ চলবে। এ ছাড়া জঙ্গিবাদের উত্থান যে ওই সময়ে হয়েছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে হাসিনা সরকার আন্তজাির্তকভাবে প্রশংসা পেয়েছে। আমরা চাই একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে। দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ থাকবে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই নিবার্চন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূণর্। বাংলাদেশের যে উন্নয়নের ধারাটা সূচিত হয়েছে, আমরা মেগা প্রকল্পগুলো নিয়েছি, দারিদ্র্য বিমোচনের যে অঙ্গীকার করেছি। দারিদ্র্য ৪০ ভাগ থেকে ২১ ভাগে নামিয়ে এনেছি। আরেকটাবার ক্ষমতায় আসতে পারলে আরও চার থেকে পঁাচ ভাগ কমাতে পারব। তাহলে বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত ঘোষণা করতে পারব। আমরা না থাকলে কেউ করবে না। প্রধানমন্ত্রীর আশাবাদ অযৌক্তি নয়। এটা মেনে নিতেই হবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নিবার্চন হয়। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও। ওই সব দেশে নিবার্চন নিয়ে এত বিতকর্ ওঠে না, সৃষ্টি হয় না অরাজকতা। আমাদের দেশের মতো সহিংস পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয় না। আমাদের দেশে তত্ত¡াবধায়ক সরকার পদ্ধতির জন্ম হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর নিবার্চনকেন্দ্রিক পরস্পরের প্রতি অনাস্থা থেকে। তত্ত¡াবধায়ক সরকার পদ্ধতি উঠে গেলেও সেই অনাস্থা রয়েই গেছে। ওই পদ্ধতি বাংলাদেশে পুনবর্হাল হওয়া কঠিন। কারণ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের নামে টানা দুই বছর ক্ষমতায় থেকেছে এক এগারোর সরকার। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেনÑ ‘ক্ষমতা থেকে সরে গেলে যারা একবার ক্ষমতায় বসে তারা আর ছাড়তে চায় না। মাশার্ল ল, সামরিক শাসন ও কেয়ারটেকার সরকারের এমন উদাহরণ রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেছিলেন, ইলেকশন ঠেকানোর মতো শক্তি কারও নেই। ষড়যন্ত্র আছে, ষড়যন্ত্র থাকবে, জনগণ সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করবে। এর সরল কথা হচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী নিবার্চন হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক দৃঢ়তাই বাস্তবে রূপ নিল। আমরা জানি ক্ষমতার পরিবতর্ন হলে দেশের উন্নয়ন গতিও থেমে যায়। আগামীতে যে দল বা জোটই ক্ষমতায় আসুক, প্রথমেই তাকাতে হবে দেশ ও জনগণের দিকে, নিজেদের দিকে তাকালে দেশ রসাতলে যাবে। উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এটা আমরা কোনোভাবেই প্রত্যাশা করি না। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতার থেকে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে দঁাড়াক সেটাই হোক সবার প্রত্যাশা। আর এটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু নিবার্চনের মাধ্যমে। আমরা আশাবাদী। সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক