বানুর বীরত্বগাথা

প্রকাশ | ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

মোহাম্মদ মাসুদ খান
বানু একজন গৃহকর্মী। বানুর প্রকৃত নাম আনোয়ারা বেগম হলেও সবাই তাকে 'বানু' নামেই ডাকে। আমাদের পরিবারের সঙ্গে 'বানু' আছে চলিস্নশ বছরেরও অধিক সময় ধরে। সে আমাদের পরিবারের একজন অপরিহার্য সদস্য। আমাদের সুখ-দুঃখের বহু ঘটনার সাক্ষী এই বানু। আমার আম্মার এবং আপার অন্যতম সাহায্যকারী বানু এখনও অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বোকাসোকা নিরক্ষর বানুর শ্রবণশক্তি দুর্বল। তার সঙ্গে তাই আমাদের উঁচুস্বরে কথা বলতে হয়। কখনো কখনো আমরা বলি এক কথা সে বোঝে আরেক কথা। নিত্যদিনের কাজে ভুলভ্রান্তি তাই অতি সাধারণ ঘটনা। তবে বানুর মতো সৎ ও নির্লোভ মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। আনোয়ারা বেগম ওরফে বানুর বাবা বাসাই হাওলাদার ছিলেন একজন কৃষক। ১৯৭০ সালে তিনি মারা যান। তখন বানুর বয়স দশ-এগারো, ওদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদী থানার অন্তর্গত চরমালিয়া গ্রামে। চরমালিয়া গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা আড়িয়াল খাঁ নদী। মূলত গ্রামটি নদীবেষ্টিত একটি জনপদ। আড়িয়াল খাঁ নদীর করাল গ্রাসে বানুদের অনেক জমি বিলীন হয়ে যায়। নদী ভাঙনের শিকার বানুর মা জোলেখা বিবি তার পাঁচ সন্তানের চারজনকে নিয়ে ১৯৭৩ সালে ঢাকায় পাড়ি জমান। তাদের আশ্রয় হয় প্রথমে ধানমন্ডির নিকটবর্তী একটি এলাকা ও পরে সেকেন্ড ক্যাপিটাল খ্যাত শেরেবাংলা নগর কলোনির মাঝে একটি খোলা স্থানে। সেখানে ঝুপড়ি ঘরে শুরু হয় তাদের বেঁচে থাকার মানবেতর জীবন সংগ্রাম। ঢাকায় এসে বানুর মা-বোন সবাই গৃহকর্মীর কাজ নেয়। একমাত্র ছোট ভাই হেলাল। সেও পাকা মার্কেট ও আগারগাঁও বাজারে বোঝা বহনের কাজে লেগে পড়ে। কিছু দিন পরে অবশ্য বানুর মা তার ছোট ভাই হেলালকে আগারগাঁও হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করান। পাঁচ সন্তানের (চার বোন-এক ভাই) মধ্যে বানু তৃতীয়। নিরক্ষর বানুর পুরো জীবনটাই ট্র্যাজেডিপূর্ণ। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সে তার প্রথম বিয়ে হয়। সে বিয়ে টেকেনি। অতি অল্প দিনের মাথায় বানুকে তালাক দেয় তার ১ম স্বামী। ১৯৮০ সালে পুনরায় বানুর বিয়ে হয়। নতুন স্বামী একজন বিবাহিত বয়স্ক মানুষ, নাম মঙ্গল মিয়া। ১৯৮২ সালে বানুর কোলজুড়ে আসে একটি পুত্র সন্তান। পুত্র সন্তানের মা হয়ে আশায় বুক বাঁধে বানু। সন্তানের নাম রাখে আলমগীর। সন্তান আলমগীরের কারণে মঙ্গল মিয়ার কাছে বানুর কদর বেড়ে যায়। কিন্তু বিধিবাম। বানুর কদর আর সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো একদিন বানুর একমাত্র সন্তান আলমগীর পুকুরে ডুবে মারা যায়। সেদিন বানুর স্বামী মঙ্গল মিয়া ছেলেকে নিয়ে কৃষি কলেজের পুকুরে গোসল করতে গিয়েছিল। সেখানেই ছয় বছরের আলমগীরের সলিলসমাধি ঘটে। একমাত্র সন্তানের অকাল মৃতু্যতে বানু তখন পাগলপ্রায়। শোকে স্তব্ধ বানুর শোক কাটতে না কাটতেই মঙ্গল মিয়া তালাক দেয় বানুকে। ওই বছরই বানুর বড়ো বোন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গ্রামের বাড়িতে মারা যায়। তিন-চার বছরের ব্যবধানে বানুর মা জোলেখা বিবিও মারা যান। সন্তানহারা স্বামী পরিত্যক্তা বানুর মাতৃবিয়োগের পর পুরোপুরি আশ্রয় হয় আমাদের পরিবারে। আমাদের বেড়ে ওঠা-শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, বিয়েশাদি, আব্বার মৃতু্য আমাদের সন্তানদের জন্ম ইত্যাদি বহু ঘটনার সাক্ষী বানু। ঠিক তেমনি বানুর প্রায় সব ঘটনাই আমরা দেখেছি এবং জেনেছি। গত পঞ্চাশ বছরে রাজধানীতে আমাদের বাসস্থানের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে তিনবার। শেরেবাংলা নগর সরকারি বাসা থেকে শেওড়াপাড়ার ভাড়া বাসা, সেখান থেকে মিরপুরের সেল পার্কের বাসা। কিন্তু বানু আছে আমাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক। বয়সের কারণে বানু আগের মতো কাজকর্ম করতে পারে না। অবসরে টিভি দেখে। দেখতে দেখতে কখনোবা আলাপচারিতায় মশগুল হয়। গ্রামের কথা বলে, অতীত স্মৃতিচারণ করতে করতে হারিয়ে যায় পঞ্চাশ বছর আগের সেই যুদ্ধের দিনগুলোতে। বানু তখন বারো বছরের একটি কিশোরী মাত্র। পাকিস্তানি হানাদার পাঞ্জাবি আর্মি বানুদের চরমালিয়া গ্রামেও হানা দিয়েছে। দুরন্ত কিশোরী বানু তখন ওর সখীদের নিয়ে এবাড়ি-ওবাড়ি চষে বেড়ায়। রাজাকারদের খবর পৌঁছে দেয় মুক্তিবাহিনীর কাছে। একদিনের ঘটনা। তখন বর্ষাকাল। চারদিকে অথই জলরাশি। বানুদের হাওলাদার বাড়ির পাশের বাড়ি 'মুন্সীবাড়ি'। সেই বাড়িতে পাঞ্জাবিরা হানা দিয়েছে। দুপুর বেলা দূরন্ত বানু খবরটি পায়। সঙ্গে সঙ্গে সে তার সখীদের নিয়ে মুন্সীবাড়িতে দৌড়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় পাঞ্জাবি আর্মি সেনারা মুন্সীবাড়িতে তান্ডব চালিয়ে কেবল চলে গেছে। তবে ওর সখী 'নাসিমা'র বাবা মা-ভাই ঘরের বাইরে বিলাপ করছে। ঘরের ভেতরে দল থেকে বিচ্ছিন্ন এক পাঞ্জাবি সেনা নাসিমাকে আটক করে রেখেছে। উদ্দেশ্য নাসিমার ইজ্জত হরণ। ঘরের বাইরে অসহায় দাঁড়িয়ে আক্রান্ত নাসিমার ভাই হারুন, মানিক ও বোন আমেনা। নাসিমার পরিবারের এই করুণ অসহায়ত্ব এবং নাসিমার আর্তচিৎকার শুনে বানু এবং ওর সখী ফাতেমা দৌড়ে দরজা ভেঙে নাসিমার ঘরে ঢুকে পড়ে। বানু দেখতে পায় পাঞ্জাবি সেনা তার সখী নাসিমার ইজ্জত হরণের চেষ্টারত। এমন অবস্থা দেখে বানুর মাথায় রক্ত উঠে যায়। হাতের পাশে থাকা বৈঠা দিয়ে নাসিমাকে রক্ষা করতে পাঞ্জাবি সেনাকে বানু পুরো শক্তি দিয়ে আঘাত করে। প্রথমে ঘাড়ে ও পরে মাথায়। পাঞ্জাবি সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বানু উদ্ধার করে তার বান্ধবী নাসিমাকে, বাঁচায় তার প্রাণ, ইজ্জত ও সম্ভ্রম। বৈঠার আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়া পাঞ্জাবি সেনা পরে মারা যায়। সেদিন সন্ধ্যা বেলা বানু ও তার সাথিরা ওই পাঞ্জাবি সেনার মরদেহ পাশের আড়িয়াল খাঁ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। বান্ধবী নাসিমার জীবন ও ইজ্জত রক্ষাকারী 'বানু' ওই ঘটনায় গর্ববোধ করে না। 'বানু' জানে না সে কি কাজ করেছে। পাকসেনার হাত থেকে বান্ধবী নাসিমার ইজ্জত ও জীবন রক্ষা করাই তার কাজ মনে করেছে সে। পাঞ্জাবি আর্মি সেনাকে হত্যা করে যে, সে বীরত্বপূর্ণ কাজ করেছে বানু তা বোঝে না। মহান মুক্তিযুদ্ধে আনোয়ারা বেগম বানুর এই বীরত্বগাথা লিপিবদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাকে উপযুক্ত পুরস্কার ও খেতাবে ভূষিত করলে জাতি ধন্য হবে। বানুকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। \হ মোহাম্মদ মাসুদ খান : সংগঠক ও লেখক সধংড়ড়ফংঁঢ়ঃর@মসধরষ.পড়স