পাঠক মত

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় পদক্ষেপ নিন

প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি আমাদের সুন্দরবন। চিরসবুজ-নিস্তব্ধ এই বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী। এই বৃক্ষের নামানুসারে সুন্দরবনের নামকরণ। সুন্দরবন সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধশালী হওয়ায় ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সুন্দরবনকে স্বীকৃতি দেয়। দিন দিন সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদ কমে আসছে, কমে আসছে বনের পরিমাণ। মানবকল্যাণের স্বার্থে সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখা অতীব জরুরি। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সুন্দরবন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশকে রক্ষা করে আসছে। সুন্দরবন বাংলাদেশের ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব পরিচিতিও দিয়েছে। কিন্তু আমরা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে পারছি না। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন থেকে শুরু করে বাঘ নিধন এবং হরিণ শিকার করে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছি আইন অমান্য করে। মানুষের আগ্রাসনে দূষণ বাড়ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে। বন-সংলগ্ন এলাকায় শিল্প-কারখানা স্থাপন, বনের মধ্যদিয়ে ভারী নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকার এবং নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটনের কারণে ঘটছে এসব দূষণ। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের গাছপালা, বন্যপ্রাণী ও জলজপ্রাণীর ওপর। তবে এ নিয়ে এখনো পূর্ণাঙ্গ কোনো গবেষণা করেনি বন বিভাগ, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো সংস্থা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বনটি দূষণ ও শিল্প-কারখানার চাপে হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জন্য আটটি হুমকি চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো, সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ রক্ষা করতে হলে এসব হুমকি মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করলেও সেই এলাকার মধ্যে গড়ে উঠছে শিল্প প্রতিষ্ঠান। গত ৮-১০ বছরে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক ভারী শিল্প-প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, এলপি গ্যাস পস্ন্যান্ট, অয়েল রিফাইনারি, বিটুমিন, সি ফুড প্রসেসিং ফ্যাক্টরি প্রভৃতি। বনের খুব কাছেই বিশালাকৃতির খাদ্যগুদাম নির্মাণ করেছে খাদ্য বিভাগ। বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পশুর নদে, যা চলে যাচ্ছে বনের মধ্যে নদী ও মাটিতে। সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে দীর্ঘদিন ধরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে একটি চক্র। এর ফলে বিভিন্ন মাছের পোনা, কাঁকড়া, সাপসহ জলজপ্রাণী মারা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে পাচারের উদ্দেশ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে বাঘ ও কুমির। প্রতি বছর সুন্দরবন ভ্রমণে যাচ্ছেন অসংখ্য পর্যটক। সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেছিলেন ১ লাখ ৭৩ হাজার পর্যটক। কিন্তু সচেতনতার অভাবে অনেক পর্যটক চিপসের প্যাকেট, পলিথিন, পানি ও কোমল পানীয়ের বোতল, খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ, খাবারের প্যাকেট, ওয়ানটাইম পেস্নট ও গস্নাস ফেলছেন বনের মধ্যে মাটি ও নদীতে। এ ছাড়া উচ্চ শব্দে গান বাজানো হচ্ছে পর্যটকবাহী কিছু কিছু জলযানে। বনের মধ্যে বুঝে কিংবা না বুঝে হৈচৈ করেন কিছু পর্যটক। এর সবকিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের ওপর। এতে পশুপাখির বিচরণে অনেক সমস্যা হচ্ছে। সুন্দরবন থেকে অনিয়ন্ত্রিত বনজ সম্পদ আহরণ, বাঘ ও বন্যপ্রাণী হত্যা এবং নানা ধরনের অবৈধ তৎপরতা চলছে উলেস্নখ করে আইইউসিএন বলছে, অনেক বছর ধরেই সুন্দরবনের মধ্যে এ ধরনের তৎপরতা চলছে। এ ছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব, সুন্দরী ও গেওয়াগাছের আগা মরা রোগও সুন্দরবনের জন্য হুমকি। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২-এর ৬ ধারা মোতাবেক 'এই আইনের তফসিলে উলিস্নখিত বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী শিকার বা বন্যপ্রাণী, মাংস, বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ অথবা এ সব থেকে উৎপন্ন দ্রব্য দান, বিক্রয় বা কোনো প্রকারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা হস্তান্তর করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।' আইনের ৪১ ধারা মোতাবেক আরও উলেস্নখ রয়েছে, 'কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করলে বা উক্ত অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা প্রদান করে থাকলে এবং ওই সহায়তা বা প্ররোচনার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হলে, ওই সহায়তাকারী বা প্ররোচনাকারী তাহার সহায়তা বা প্ররোচনা দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য নির্ধারিত দন্ডে দন্ডিত হইবেন।' বাংলাদেশের গৃহীত পরিবেশ নীতি, আইন ও বাংলাদেশের সমন্বিত উপকূল ব্যবস্থাপনা কৌশলের আলোকে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এবং এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও কনভেশনের আলোকে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ সব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও বিভাগের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা ও সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সুন্দরবনকে সংরক্ষণ ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের যে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা এবং এ লক্ষ্যে সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করা আশুকরণীয়। সুন্দরবন অঞ্চলকে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা যায় ও বনের বৈচিত্র্য রক্ষা করে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায় তার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আবির হাসান ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়