স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর এবং আমাদের প্রাপ্তি

অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে পরিণত হয়েছে উন্নয়নশীল দেশে, যে সোনার বাংলার স্বপ্ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, যে অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন মানুষের, যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সে দিনগুলো আর বেশি দূর নয়।

প্রকাশ | ০৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

কাজী মো. হাসান
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। ৩০ লাখ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। শূন্য থেকে শুরু করা আমাদের অর্থনীতি আজ বহির্বিশ্বে ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতি। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ ২০৩৫ সালে ১৯৩ দেশের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশে পরিণত হবে। মাত্র ৫০৭ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করা দেশটির বাজেট আজ পাঁচ লাখ কোটিকেও ছাড়িয়ে গেছে। বেড়েছে অর্থনীতির আকার, জিডিপি'র প্রবৃদ্ধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে; সে সঙ্গে বাংলাদেশ আজ এশিয়ার 'টাইগার ইকোনমি' নামে খ্যাতি লাভ করেছে। দরিদ্রতার হার হ্রাস, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ, রপ্তানি পরিধি, নারীদের অর্থনীতিতে অবদান, গড় আয়ু, শিক্ষার হার, মেয়েদের উচ্চশিক্ষার হার আজ ঊর্ধ্বমুখী। টেকসই উন্নয়ন, বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্থনীতিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। ছিল ভাঙাগড়ার স্বপ্ন। বর্তমানে করোনা মহামারি বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কিছুটা প্রভাব ফেললেও, সব মন্দা কাটিয়ে আবারও আগের অবস্থানে ফিরতে পেরেছে। মহামারি করোনা মোকাবিলায় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। শুরুটা করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ব্যাংক প্রতিষ্ঠান, প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, মেয়েদের জন্য শিক্ষা বৃত্তি, নতুন নতুন কর্মসংস্থান। এক সময় বাংলাদেশকে বলা হতো সোনালি আঁশের দেশ। কৃষি খাতে বঙ্গবন্ধু নিয়ে আসে বিশাল পরিবর্তন। বাংলাদেশকে বলা হয় কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি খাত আজও জিডিপিতে এক বিশাল অবদান রেখে চলেছে। বর্তমানে কৃষি খাতের অবদান জিডিপি'তে ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ২০১৬-২০১৭ সালের জনশক্তি জরিপ অনুযায়ী ৪০ দশমিক ৬২ শতাংশ মানুষ কৃষি খাতের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। নিসন্দেহে বলা চলে, কৃষি এখনো বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কৃষির ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে আমাদের শিল্প খাত সে জায়গাটা দখল করতে যাচ্ছে। জিডিপিতে শিল্প খাতে অবদান উলেস্নখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর মধ্যে একাংশ জুড়ে আছে গার্মেন্টস। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে গার্মেন্টস শিল্প থেকে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমই)-এর তালিকাভুক্ত প্রায় চার হাজার কারখানায় ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে থাকে। ১৯৭২ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৭০ ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। মাথাপিছু গড় আয়ু ছিল ৪৬.৫১, বর্তমানে মাথাপিছু গড় আয়ু ৭২.৬ শতাংশ। ১৯৭২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমাদের জিডিপিতে আসে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২.৫ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। একই সংস্থার 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল (ডবিস্নউইএলটি)' প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে জিডিপির আকারের ভিত্তিতে বৃহৎ অর্থনীতির দেশের তালিকায় ৪১তম অবস্থানে উঠে এসেছে। পাকিস্তানের অবস্থান ৪৪তম। বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ এখন আকাশচুম্বী। ১৯৭২ সালে আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল ১১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে বদ্ধপরিকর সরকার। দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে বিভিন্ন অনুদান, ভাতা, শিক্ষা, বিনামূল্যে খাবার, কৃষি খাতে ভর্তুকিসহ নানা সমাজিক সচেতনামূলক প্রোগ্রামের আয়োজন করে যাচ্ছে সরকার। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করত। এখন তা কমে মাত্র ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। অতি দারিদ্র্যের হার কমে নেমেছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশে। ২০১৭ সালে দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২৩ দশমিক ১ শতাংশ, আর অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ১২ দশমিক ২ শতাংশ। শিক্ষা ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। তৈরি হচ্ছে উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাসহ বিশ্বমানের পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। পণ্য রপ্তানিতে নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের রপ্তানি রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশ ৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে। অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন বাংলাদেশ রপ্তানিতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত গড়ে ৭.১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বর্তমানে করোনা মহামারির কারণে রপ্তানি কিছুটা মন্থর হলেও খুব তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ তা কাটিয়ে উঠে আগের ধারাবাহিকতায় ফিরে যাবে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ২০৩০ সালে রপ্তানিতে ৭০০০ ডলারের অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে সুনাম অর্জন করবে। রেমিট্যান্স অর্জনে আজ বাংলাদেশ বিশ্বের ৭ম স্থানে অবস্থান করছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে রেমিট্যান্স প্রেরণে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে ২২ বিলিয়ন রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পেয়েছে। গেস্নাবাল নলেজ পার্টনারশিপ অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (নোমাড) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আসা প্রবাসী আয় কিছুটা কমলেও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে বেড়েছে। হ্রাস পেয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো। অবকাঠামোগত উন্নয়ন আজ চোখ ধাঁধানো, নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে দেশের ৬.১৫ কিলোমিটারের সর্ববৃহৎ স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে চলবে গাড়ি নিচ দিয়ে চলবে রেলগাড়ি। ঢাকাতে হচ্ছে ৩১.২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল। একসঙ্গে প্রায় ২ হাজার মানুষ চলাচল করতে পারবে এই মেট্রোরেল দিয়ে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ৬টি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সরকার। রূপপুরে তৈরি হচ্ছে ২০৪০ মেগাওয়াট সম্পন্ন পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র। মাতারবাড়ী কয়লা বিদু্যৎকেন্দ্র, ৬৬০ মেগাওয়াটের পায়রা বিদু্যৎকেন্দ্র। তৈরি হচ্ছে নদীবন্দর। আজ এইগুলো কেবল স্বপ্ন নয়, বাস্তবরূপ পেতে যাচ্ছে এই সব মেগা প্রকল্পগুলো। ডেল্টা পস্ন্যান তথা 'ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০'কে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করছে অর্থনীতিবিদরা। বন্যা, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে আলোচিত 'ডেল্টা পস্ন্যান-২১০০' ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। এর আওতায় সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ ৮০ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে পরিণত হয়েছে উন্নয়নশীল দেশে, যে সোনার বাংলার স্বপ্ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, যে অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন মানুষের, যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সে দিনগুলো আর বেশি দূর নয়। কাজী মো. হাসান : কলাম লেখক