পাঠক মত

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকেও সমান সুযোগ দিন

প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার, অথবা তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটি মাথায় এলেই যে ধারণা চলে আসে তা হলো অস্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে টাকা আদায়, অপ্রস্তুতভাবেই গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা অথবা যে কোনো সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা ইত্যাদি। আপনি হয়তো বৃহন্নলা দেরকেই দায়ী করবেন এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্য। কিন্তু গভীর থেকে চিন্তা করে দেখুন আমরাই দায়ী এমন পরিস্থিতির জন্য, আমাদের সমাজই দায়ী এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য। আমরা প্রায়ই রাস্তা-ঘাটে হিজড়াদের মুখোমুখি হই আমারা তাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আমরা কখনোই চিন্তা করি না তারা কেন এমন কাজ করছে। আমরা কখনোই ভাবি না যে সমস্যাটা তাদের নয়, বরং আমাদেরই। আমাদের জন্যই তারা আজ বাধ্য হয়েই আমাদের বিরক্ত করছে। হিজড়া সম্প্রদায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ হওয়া সত্তে¡ও অতি প্রাচীনকাল থেকেই তারা অবহিত, বঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সরকারের সমাজকলাণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার কিন্তু হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের দেওয়া তথ্য মতে, প্রায় ১৫ হাজার বা তারও বেশি। আমাদের সমাজ এদের সহজে গ্রহণ করে না। এদের সামাজিকভাবে গ্রহণ না করার কারণেই চিকিৎসা, শিক্ষা, কমর্সংস্থানসহ নানা স্থানে বিভিন্নভাবে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয় তাদের। পৃথিবীতে তারা হিজড়া হয়েই জন্মগ্রহণ করে না। তাদের আচরণ ও দৈহিক গঠনে পরিবতর্ন আসার আগ পযর্ন্ত তাদের স্বগীর্য় দিন কাটে মা-বাবার ভালোবাসায়, ভাই-বোনের সোহাগ, আদর আর খুনসুটি এবং কম বয়সেই গড়ে ওঠা কিছু সম্পকের্র মায়াজালে। কিন্তু একটা সময় আসে যখন বোঝা যায় যে তারা আমাদের একটু আলাদা, তখনই তাদের প্রতি পরিবারের সদস্যদের একটা ভিন্নরকম ধারণা চলে আসে। তাদের আবেকগুলোকে আর আগের মতো মূল্যায়ন করা হয় না, তারা পায় না কোনো ভালোবাসা, আদর কিংবা সোহাগ। পায় না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ, সমাজ তাদের স্বাভাবিক চোখে দেখে না, নিজ পরিবারেই তারা নিজ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বাধ্য হয় নিজের মতো সমজাতীয় মানুষদের সন্ধানে যেখানে কেউ আর তাকে অবহেলা করবে না! তারপর! তারপর শুরু হয় ভিন্ন জীবন। সমাজ যখন তাদের স্বাভাবিক চোখে দেখে না, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের দরজা যখন অঘোষিতভাবেই তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের ভালোবাসায় যখন টান পরে, ঠিক তখনই এই মানুষগুলো নিজেদের সমস্ত মায়াকে হারিয়ে চলে আসে কোনো এক হিজড়া পল্লীতে। দিব্যি চলে যাচ্ছে তাদের জীবন। নেই শিক্ষা, নেই কমর্সংস্থানের সুযোগ, পাচ্ছে না মানবাধিকার! তারাও তো মানুষ। তাদেরও বঁাচতে হবে। অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা বেছে নেয় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চঁাদা তোলা। খুব বেশি তারা কখনোই দাবি করে না। খুব অল্পতেই তারা তুষ্ট। আর আমরা সভ্য সমাজের মানুষরা কি করি! আমরা তাদের ঘৃণা করা শুরু করি, পথে দেখলেই মুখ লুকাই, হিজড়া বলে সম্বোধন করি। খুব কষ্ট হয় ওদের। আমরা কখনোই ওদের কথা শুনি না, কখনোই জানতে চাই না তারা আমাদের থেকে কি চায়! এইতো সেদিন কথা হয়েছিল একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে। মন দিয়েই শুনেছিলাম তার কথাগুলো। নিশ্চুপ ছিলাম পুরোটা সময়। শুধু শুনেই ছিলাম মুগ্ধশ্রোতা হয়ে। আর সে বলেই যাচ্ছিল তাদের হাজারো অভিমানী কিছু অভিযোগ। সে বলেছিল, ‘জানেন, আমাদেরও তো আপনাদের মতোই মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে ইচ্ছে করে, ওইপাশে মা আর এইপাশের এই অস্বাভাবিক মানুষটার চোখে প্রতি রাতেই অশ্রæ ঝরে, খুব ইচ্ছে করে গায়ে গিয়ে ছোট্ট ভাইটির সাথে একটু দুষ্টুমি করতে, আমাদেরও ইচ্ছা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে, খুব ইচ্ছে করে আপনাদের মতোই বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে, আমরা কখনোই চাই না আপনাদের বিরক্ত করে টাকা নিতে, আমরা বন্ধুত্বপূণর্ সম্পকর্ চাই, আমরা শিক্ষার সুযোগ চাই, আমরা কমের্র সুযোগ চাই, আমরা ভালোবাসা চাই, আমরা পরিবারেই থাকতে চাই, আমরা আপনাদের বিরক্ত করতে চাই না, আমরা আমাদের অধিকার চাই, আমরা ও আপনাদের মতো বঁাচতে চাই।’ চুপ ছিলাম কতক্ষণ। সত্যিই তো। আমরা যখন লিঙ্গভেদে জনসংখ্যাকে আলাদা করতে চাই, তখন কিন্তু মনের অজান্তেই পুং লিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গের ধারণা চলে আসে। এইখানে কিন্তু আমরা ওদেরকে পুরুষ-মহিলার ভেতরেই রেখেছি। কোনো ভেদাভেদ রাখিনি। বেশ ভালো। কিন্তু যখনই অধিকারের প্রশ্নে আসি, আমরা তাদের সমানাধিকার দিতে নারাজ। তা বিশ্বের অনেক দেশেই হিজড়ারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। অন্যের করুণার ওপর নিভর্র করে তাদের জীবন চলে না। আমাদের দেশে তারা অবহেলার পাত্র, অবজ্ঞার পাত্র, রাস্তাঘাটে বিরক্ত করা জনগোষ্ঠী। বেশি দূরে যেতে হবে না। এইতো পাকিস্তানেই হিজড়াদের মধ্য থেকে নিবাির্চত এমপি রয়েছে, আপনি কানাডায় যান সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কাজ করছে। দিব্যি চলে যাচ্ছে তাদের জীবন। কিন্তু আমাদের দেশে কেন নয়। কারণ, আমরা তাদের সুযোগ দিচ্ছি না, তাদের নাসির্ং করছি না, তাদের যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করছি না, কোনো প্রতিষ্ঠান নেই তাদের নিয়ে কাজ করার, তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলার, তাদের প্রত্যাশাগুলো সরকারকে জানানোর। হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি। তাও সরকারি ও বেসরকারি সহয়তার জন্য তারা ঠিক মতো কাজ করতে পারছে না। সংগঠনগুলোর অনেকদিনের প্রচেষ্টার ফলে সরকার অবশেষে তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল স্বাভাবিক মানুষের মতো তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? তারা এখন সসাজের পিছিয়ে পড়া, সামাজিক সমস্যা, সুবিধাবঞ্চিত একটি অংশ। তাদের সমাজ খাটো করে দেখে। অনেক সময় তাদের মানুষই মনে করে না। নানাভাবে তিরস্কার করা হয় তাদের। চাকরি, শিক্ষা, কমর্জীবন, রাজনীতি সবক্ষেত্রে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কেউ তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতেছে না, কেউ তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে না, তাদের শিক্ষা, কমর্, সামাজিক মযার্দা ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করবে তেমন কোনো সংগঠন নেই। তাদের চাওয়া-পাওয়াগুলো বুঝার মতো কোনো প্ল্যাটফমর্ ও নেই। তাইতো অব্যক্তই রয়ে যাচ্ছে তাদের কথাগুলো। নীরবে নিভৃতে কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন। যদি আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসি, তাদের প্রতি আমাদের বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবতর্ন করি তাহলেই সম্ভব তাদের জীবনকে পরিবতর্ন করা। তাদের জীবনকে স্বাভাবিক পযাের্য় নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে, সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের জীবনমানকে উন্নত করতে হবে। তাদেরকে শিক্ষা, সামাজিক মযার্দা, কমর্সংস্থানের সুযোগ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের যেন আর রাতের অন্ধকারে অশ্রæ ঝড়াতে না হয়, তাদের যেন আর কারোর তিরস্কারের পাত্র হতে না হয়, তারা যেন নিজ নিজ পরিবারেই বসবাস করতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনকেও এগিয়ে আসতে হবে তাদের জীবনমানকে উন্নত করার প্রত্যয় নিয়ে। সাধারণ জনগণের মাঝে প্রচারণা চালাতে হবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে, তাদের অধিকার নিয়ে, সামাজিক মযার্দা নিয়ে। সবোর্পরি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, তবেই তাদের জীবন বদলে যাবে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের শিক্ষা, সামাজিক মযার্দা, কমর্সংস্থান এবং বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে সমাজের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করণ এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবতর্ন। দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, ওদের জীবন বদলে যাবে। রাজু আহমেদ শিক্ষাথীর্ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়