পথশিশু পুনবার্সন ও শিশু অধিকার নিশ্চিত হোক

প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মোহাম্মদ অংকন ঢাকা
অবসর পেলে আমি ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় হঁাটাহঁাটি করতে যাই। সেখানে অসংখ্য মানুষের ভিড়ে কিছু পথশিশু (প্রচলিত ভাষায় টোকাই; আমি আদর করে পথফুল বলি) দেখা যায়। প্যান্ট-শাটর্ পরা মানুষ দেখলে দৌড়ে এসে টাকা চায়। ‘কয়ডা টাহা দ্যান, ভাত কিনা খামু। সারাদিন কিচ্ছু খাই নাই।’ তবে আমি সচরাচর টাকা দিই না এই কারণে যে টাকাটা তারা খাদ্য কেনা বা সঠিক কাজে লাগাতে পারে না। হয় বাবার হাতে তুলে দেয়; যিনি তা দিয়ে মাদক কিনে অথবা পথশিশু নিজেরা মাদক কিনে গ্রহণ করে। ওদের ক্ষুধা শতের্ও খাদ্য কিনে খাওয়ার প্রবণতা কম। তাই পথশিশুরা যখন আমার কাছে টাকা চায়, তখন আমি নিকটস্থ দোকান থেকে সাধ্যানুযায়ী খাবার (কলা, রুটি, বিস্কুট, পানি) কিনে দিই। তখন আমার উদ্দেশ্য হয়ে দঁাড়ায়Ñ সামান্য খাবার হলেও পথফুলগুলো অন্তত খেয়ে বঁাচুক। কিন্তু এভাবে ওরা কতদিন বঁাচবে? আমার মতো কতজন ওদের মুখে খাবার তুলে দেয় বা দেবে? দিলেও প্রতিদিন তিনবেলা কে বা কারা ওদের দেখভাল করবে? সাময়িক খাদ্য দিয়ে কতদিন সুস্থভাবে ওদের বঁাচিয়ে রাখা সম্ভব? এর জন্য প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে পথশিশু পুনবার্সন প্রকল্প উদ্যোগ হাতে নেয়া। কিন্তু এটা যে আমার নিছক কল্পনামাত্র, তা বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার ক্ষুণেœর বতর্মান হালচাল দেখলে উপলব্ধি করা যায়। বাংলাদেশসহ অসংখ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে অসংখ্য শিশু অনাহারে, অধার্হারে জীবনযাপন করছে; শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত, অথচ তাদের পুনবার্সনের ব্যাপারে বিত্তবানদের বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা নাই। আমরা বলে থাকি, ‘আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।’ কিন্তু কোন শিশুগুলো আগামী দিনের ভবিষ্যৎ? নিশ্চিত করে বলা যায়, ধনীর শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এবং ¯েøাগানটি এমনই হওয়া যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আজ হাজার হাজার শিশু বঞ্চনার শিকার। পারিবারিক দরিদ্রতা তাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে। ভ‚মিহীন বাবা-মায়েরা পেটের আহার জোগাড় করতে শ্রম দিয়েই ক‚ল পায় না, সেখানে সন্তানদের কীভাবে মানবাধিকার নিশ্চিত করবে? প্রতিটি শিশুরা বাবা-মায়ের প্রত্যাশা, আমাদের সন্তান মানুষ হয়ে গড়ে উঠুক, শিক্ষিত হোক। কিন্তু স্বপ্নবান এই বাবা-মায়ের সন্তানের জন্য পৃথিবীটা বড়ই অনুপযোগী। তাই শিশুদের অধিকার নিশ্চিতকরণে সবার আগে তাদের উপযোগী পৃথিবী আমাদের গড়ে দিতে হবে। অনুক‚ল পরিবেশে তাদের বেড়ে উঠতে দিতে হবে। আর আমরা যদি তাদের সেই শিশুবান্ধব পরিবেশ উপহার দিতে ব্যথর্ হই, তাহলে আমরা যত স্বপ্নই তাদের ঘিরে দেখি না কেন, সব বিনষ্ট হয়ে যাবে। ঘরের শিশুরা হবে পথশিশু। শুধু বাংলাদেশ নয়, এটা পৃথিবীর সভ্য জাতিগুলোর জন্য অভিশাপের বিষয় বলে বিবেচ্য হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার পঁাচটি। যথাÑ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। একটি শিশু জন্মগ্রহণ করা মাত্রই অধিকারগুলোর দাবিদার হয়ে যায়। কিন্তু পারিপাশির্¦ক কারণে শিশুরা তাদের অধিকারগুলো হারিয়ে ফেলছে। অথচ একজন সাধারণ মানুষের মতোই একটি শিশুর অধিকার সমান। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুর প্রয়োজনকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অথচ আমাদের পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের বাইরেও অনেক শিশু রয়েছে, যারা দীনহীনভাবে বসবাস করে। প্রাকৃতিক দুযোর্গ, খরা, বন্যা বা অভিবাসনের দ্বারা তারা শহরে পাড়ি জমিয়ে ফুটপাতে, বস্তিতে বাস করতে থাকে। দু’বেলা দু’মুঠো অন্নই যেখানে ঠিকমতো তাদের জোটে না, সেখানে অন্যান্য চাহিদার কথা তো সুদূর পরাহত। এ জন্য কেবল আমাদের পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুর জন্যই নয়, এই বিষয়টি ‘এক বিশ্ব এক শিশু’ হিসাবে যেদিন সবাই ভাবতে শিখবে, সেদিনই বিশ্বের শিশুদের সব মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষমতা আসবে। তখন আর আলাদাভাবে শুধু পথশিশুদের পুনবার্সনের কথা ভাবতে হবে না। শিশুদের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে পারলে পথশিশু বলে আর কেউ থাকবে না এবং শিশুপন্থী অনৈতিক কাজগুলো সহজেই নিমূর্ল করা সম্ভব হবে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে শিশু দিবস পালন করা হলেও ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হয় এবং দিনটিকে ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ বলে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের অন্যতম। ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ ২২টি দেশ এই সনদের প্রতি আবার সমথর্ন জানায়। ১০৫টি দেশ সনদটিতে স্বাক্ষরের প্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘ গৃহীত ‘শিশু অধিকার সনদ’ সমগ্র বিশ্বের শিশুদের জন্য সবের্মাট ৫৪টি ধারা সংবলিত অধিকারকে স্বীকার ও সংরক্ষণের জন্য আইনগত ভিত্তি তৈরি করে। বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার সংরক্ষরণে আশার সঞ্চারণ হয়। কিন্তু জাতিসংঘের শিশু সনদের প্রতিফলন সবর্ত্র কাজে আসছে না বলে দেশে দেশে শিশুরা নিযার্তনের শিকার হচ্ছে, শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেসব শিশু কাজ পাচ্ছে না, তারা পথশিশু হয়ে হঁাটে, মাঠে, রাস্তায় ঘুরছে। কিন্তু এই বিষয়গুলো বন্ধকরণে সংগঠনসমূহের বোধোদয় নাই বললেই চলে। আমাদের বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দিলে শিশু অধিকার ক্ষুণেœর ব্যাপারে টনক নড়বে। শুধু তাই নয়, দেশে বেগতিক হারে পথশিশুর সংখ্যা বাড়ছে, শিশুশ্রমিকের দ্বারা মিল-কারখানা চালানো হচ্ছে এবং তাদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নিযার্তন-নিপীড়ন করা হচ্ছে। শিশুশ্রমের সত্যতা অনুধাবনে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মাত্র ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের ঘরে, মাঠে এবং কারখানায় কাজ করতে দেখা যায়, যা অনেকটা বিনা বেতনেই বলা চলে। বেতন মিললেও তা অতি সামান্য। কেউ কেউ ‘পেটে-ভাতে’ চুক্তিতেই সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে থাকে। বিষয়গুলো সুশীল সমাজের নজরে আসে। সে প্রেক্ষিতে মাঝেমধ্যে নানা সভা-সেমিনারে শিশু অধিকারের কথা বলা হলেও বিষয়টিতে প্রকৃত অথের্ সামান্যই গুরুত্ব দেয়া হয়। এই গুরুত্বহীনতার কারণে শিশু অধিকারের অব্যাহত অপব্যবহার হচ্ছে এবং শিশু অধিকার লঙ্ঘন উদ্বেগের কারণ হয়ে দঁাড়িয়েছে। ঘনবসতি, সীমিত সম্পদ এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুযোর্গ বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে এবং এ অবস্থায় শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এ কথাটি স্পষ্টত উপলব্ধি করতে পারছি যে দরিদ্রতার কারণে শিশুরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নবাদিতা তাদের শিশুশ্রমিক বানাচ্ছে, অপরাধী বানাচ্ছে, পথশিশু বানাচ্ছে। তাই প্রথমত এদের পুনবার্সন করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। শিশুদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে জাতিসংঘসহ দেশীয় নানা সংগঠনকে আরও তৎপর হতে হবে। আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিশু দিবস পালন করাই শিশুদের অধিকার ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ নয়। তবে বিশ্ব শিশু দিবস থেকে আমাদের ব্যক্তিপযাের্য় সচেতন হতে হবে শিশুদের টিকিয়ে রেখে ভবিষ্যৎ বিশ্বকে গৌরবোজ্জ্বল পথে নিয়ে যেতে হবে। শিশুদের রক্ষায় দেশে দেশে লিখিত আইন থাকলেই চলবে না, তার সঠিক প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে। আইন প্রয়োগের ধারাবাহিকতায় কারখনায় শিশুশ্রমিক নিয়োগ বন্ধ হবে। সেই সঙ্গে আমাদের কোমলমতি শিশুদের সব অধিকার নিশ্চিত করতে পারিবারিক উন্নয়ন ঘটানো খুবই জরুরি। পরিবারকে সচ্ছল করার মাধ্যমে শিশুদের অনুক‚ল পরিবেশ তৈরিকরণ সম্ভব যাতে তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথশিশু হতে না পারে। পরিশেষে, সবার প্রতি আমার আহŸানÑ আসুন, আমরা শিশু অধিকার সম্পকের্ সচেতন হই, পাশাপাশি কোনো শিশু যেন আমাদের দ্বারা নিযাির্তত, অত্যাচারিত না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখি। সম্ভব হলে তাদের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসি। কোথাও শিশু নিযার্তন চোখে পড়লে তা পতিহত করি। পারতপক্ষে শিশুদের কাজে লাগিয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বন্ধ না করে তাদের মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির পথকে সুগম করি। জেনে রাখুন, আপনার আমার ব্যক্তিগত কিছু উদ্যোগই পারে সমাজকে পরিবতর্ন করতে। সবোর্পরি, বিশ্ব শিশু দিবস সাফল্যমÐিত হয়ে শিশু অধিকার সুনিশ্চিত হোক, এমনটাই প্রত্যাশা করছি।