মৃত পাঠক জীবিত হোক

প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

স্বপন হোসাইন শিক্ষাথীর্, আইন বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বই হলো জগতের সবচেয়ে বড় বন্ধু। যখন কেউ পাশে থাকবে না, তখন বই থাকবে পাশে। সবাই ছেড়ে গেলেও বই ছেড়ে যাবে না। বইকে আপনি ছুড়ে ফেলতে পারেন বা মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারেন। যাই করেন না কেন, বই আপনাকে ছেড়ে যাবে না। হয়তো এমনও হতে পারে বই আপনাকে বেঁধে রেখেছে, আপনি উঠতেই পারছেন না বই ছেড়ে, তখন আপনাকে স্বীকার করতেই হবে বইয়ের নিজস্ব শক্তি আছে। এই পৃথিবীতে যারাই বিখ্যাত হয়েছেন, তাদের পিছনের প্রধান যে রহস্য ছিল, তাহলো বই পড়ার অভ্যাস। তিনি বিজ্ঞানী হোন আর কবি-সাহিত্যিক হোন, বই পড়ার অভ্যাস ছিল বলেই তিনি তার সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পেরেছেন। অনেকে এমনও ছিলেন, যাদের খাবারের টাকা ছিল না, কিন্তু বই কিনতেন যখনই টাকা পেতেন। যেমন হিটলার তার ‘মাইন ক্যাম্ফ’ বইতে বলেছেন, তিনি যদি একটা বই কিনতেন, তাহলে পরবতীর্ দিন পযর্ন্ত না খেয়ে থাকতে হতো, কিন্তু তিনি বই কেনাকেই প্রাধান্য দিতেন। এরকম আরও অহরহ উদাহরণ আছে, যারা অথের্র জোরে নয়, বরং বইয়ের জোরেই বিখ্যাত হয়েছেন এবং এখনো অমর হয়ে আছেন। বই হলো জ্ঞানাজের্নর প্রধান মাধ্যম। বলা হয়ে থাকে প্রকৃতিই হলো সবচেয়ে বড় শিক্ষক। সুতরাং, আমরা বলতেই পারি যে বই হলো প্রকৃতির শিক্ষাদানের প্রধান উপকরণ, যেটার মাধ্যমেই প্রকৃতি জ্ঞানাজের্নর দিকে ধাবিত করে। অথার্ৎ, কারও মনে যদি এই কথায় উদয় হয় যে, তাকে জ্ঞানাজর্ন করতে হবে বা জ্ঞানী হতে হবে, তাহলে প্রথমে যে মাধ্যমের কথা মনে পড়বে সেটা হলো বই। এটা হলো সব মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব যা জন্মগতভাবেই মানুষ পেয়ে থাকে। তাই বই হলো জ্ঞানাজের্নর শ্রেষ্ঠ উপায়। যিনি শিক্ষক তাকেও পড়তে হয়। ফলে, বই ছাড়া কেউ শিক্ষা গ্রহণ বা প্রদান করতে পারে না। একটা সময় ছিল যখন মানুষের অবসর সময় কাটানোর প্রধান মাধ্যম ছিল বই। মানুষ সময় পেলেই বই পড়তো। কিন্তু প্রযুক্তিগত উন্নয়নে আমাদের এটা মেনে নিতেই হচ্ছে যে, আর কোনো ক্ষতি না হলেও এই ক্ষতিটা হয়েছে, আমাদের পাঠকের সংখ্যা কমে গেছে। ফেসবুক, টুইটার, মেসেঞ্জারের আগমনে বইয়ের সঙ্গে সময় পার করার পরিবতের্ মানুষ এখন এগুলোর সঙ্গেই সময় কাটায়। অবসরে যেখানে বই পড়তো সবাই, এখন সেখানে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। বইয়ের যে আকষর্ণ ছিল সেটা কমে যাচ্ছে। হ্যঁা, এটা সত্য যে প্রযুক্তির কল্যাণে এখন খুব সহজেই যে কোনো বই অনলাইনে পাওয়া যায়। খুব সহজেই যে কোনো বই ডাউনলোড করে পড়া যায়। তবে কাগজ-কালির বই পড়লে যে ধ্যান আসে, মোবাইল বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে বই পড়লে সেই ধ্যানটা আসে না। বই পড়ার মধ্যে যে একটা আলাদা সংস্কৃতি আছে, সেটার মৃত্যু হয়। বইয়ের আধিক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে অনলাইনে, কিন্তু পাঠকের সংখ্যা কমে গেছে অনেক। অনলাইনে আমরা সময় ব্যয় করছি বেশি। বই টেবিলেই পড়ে আছে। হয়তো ধুলোবালির মধ্য মিশে যাচ্ছে, কিন্তু পাঠক নেই। কারণ, পাঠকের মৃত্যু হয়েছে। বলাইচঁাদ মুখোপাধ্যায়ের একটা গল্প আছে, গল্পটার নাম ‘মৃত্যু। এই গল্পে লেখক এক বইপাগলের কথা বলেছেন যার পরবতীের্ত মৃত্যু হয়। প্রকৃতপক্ষে তার মৃত্যু হয় না, বরং তার মধ্যে যে পাঠক ছিল, তার মৃত্যু হয়। ফলে, একটি বইয়ের শেষের কয়েকটি পাতা তার আর পড়াই হয় না। বতর্মানে আমাদের পাঠকদেরও মৃত্যু হয়েছে। সবাই তার নিজের মধ্যে একজন পাঠককে বহন করে, যার খাদ্য হলো বই। ফেসবুক, মেসেঞ্জারের মতো বিষ এই পাঠককে হত্যা করেছে। এই পাঠককে আবার জাগরিত করতে হলে বইয়ের বিকল্প নাই।