সমৃদ্ধির নতুন মাত্রা
রপ্তানির সর্বোচ্চ মাইলফলকে বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষিজাত শিল্প পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্রান্ডের পণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ায় এর বাজার বিস্তৃতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রকাশ | ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
রেজাউল করিম খোকন
মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেই পণ্য রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড দেখল বাংলাদেশ। গত ডিসেম্বরে ৪৯০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৪২ হাজার ১৪০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছেন দেশের উদ্যোক্তারা। অতীতে আর কোনো মাসেই এ পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়নি। এর আগে সর্বশেষ গত অক্টোবরে সর্বোচ্চ ৪৭২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। রপ্তানির এ রেকর্ডের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। গত মাসে ৪০৪ কোটি ডলারের বা ৩৪ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে- যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। তাতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১ হাজার ৯৯০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তাতে প্রবৃদ্ধি ২৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে রেকর্ড রপ্তানির কারণে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২ হাজার ৪৭০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। এ আয় গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের জন্য সরকার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। তবে অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় ১৫ শতাংশ বেশি আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্বাচলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার উদ্বোধনকালে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও দেশের রপ্তানি বাড়ার তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদেশে পণ্য বিক্রি থেকে ৪৩৬ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। সার্বিক রপ্তানি বেড়েছে। তবে আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সময় এখন বাংলাদেশের। এই সুযোগটা নিতে হবে। রপ্তানির প্রসারে গবেষণা ও ব্র্যান্ডিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ সময় রপ্তানিকারকদের দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার দিকেও মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সরকারপ্রধান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার বাড়াতে উদ্যোক্তাদের গবেষণা বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। কোন পণ্যের কেমন চাহিদা, কোনটির মান কোন ক্ষেত্রে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিজস্ব ব্র্যান্ডিং সৃষ্টি করে রপ্তানিকারকদের এগিয়ে যেতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ও কূটনীতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রতিটি দূতাবাসকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্যচুক্তি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদনের জন্য ২৩টি দেশের ব্যাপারে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। সবার সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য যাতে আরও সহজভাবে করতে পারি অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের মর্যাদাকে ধরে রেখে কোনো চ্যালেঞ্জ এলে তাও যেন মোকাবিলা করতে পারি, সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। পণ্যভিত্তিক রপ্তানিকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতি বছর একটি পণ্যকে বর্ষপণ্য অর্থাৎ 'প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার' ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সালের জন্য আইসিটি পণ্য সেবাকে বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আজ প্রযুক্তির যুগ, বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপস্নব সামনে রেখে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতেও আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা যাতে কোনোভাবেই পিছিয়ে না থাকি, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। করোনাকালে অর্থনীতিকে সীমিত আকারে হলেও এগিয়ে নেওয়ায় তিনি শিল্প উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে মালিক-শ্রমিক সবাইকে কৃতিত্ব দিয়ে বলেন, এ সময়টাতেও আমাদের অর্থনীতি কিন্তু কখনো একেবারে স্থবির হয়নি। স্বল্পমাত্রায় হলেও আমরা সব চালু রাখতে সক্ষম হয়েছি। পৃথিবীর বহু দেশ কিন্তু এই সমস্যায় পড়েছে। করোনাপূর্ববর্তী সময়ে তার সরকার প্রবৃদ্ধিকে ৮ শতাংশে নিতে সক্ষম হয়েছিল উলেস্নখ করে ভবিষ্যতে এটি অতিক্রমেরও আশা ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন যখন বড় রপ্তানি বাজারগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন শঙ্কা ঘিরে ধরেছে দেশের রপ্তানি খাতকে। কিন্তু সব শঙ্কা পেছনে ফেলে বছর শেষে সেরা চমক দেখাল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় এ খাত। গত ডিসেম্বরে ইতিহাসের সেরা প্রবৃদ্ধি হয়েছে রপ্তানি আয়ে। এ মাসে প্রবৃদ্ধি এসেছে ৪৮ শতাংশের বেশি। এ সময় আয় হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আয় হয়েছে দুই হাজার ৪৬৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮.৪১ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের এ সময় আয় হয়েছিল এক হাজার ৯২৩ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৪৯০ কোটি ৭৬ লাখ ডলার আয় হয়েছে। এই আয় ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি। একক মাস হিসেবে এত রপ্তানি আয়ের এটাই প্রথম রেকর্ড। এ আয় এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৪৮.২৭ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আয় ছিল ৩৩০ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। এর আগে একক মাস হিসেবে গত অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪৭২ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। রপ্তানিতে বরাবরের মতোই বেশির ভাগ অবদান পোশাক খাতের। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০২১ সালের একই মাসে পোশাক রপ্তানি ৫২.৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ২০১৯-এর ডিসেম্বরের তুলনায় এ প্রবৃদ্ধি ৩৮ শতাংশ। ২০২১-এর ডিসেম্বর মাসে ৪০৪ কোটি ডলার সমমূল্যের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানির তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী পোশাক খাতের রপ্তানির ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা গেলেও সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিভিন্ন কাঁচামাল যেমন- টেক্সটাইল, পণ্য জাহাজীকরণ খরচ, রং ও রাসায়নিক দ্রব্যের বাজার অনেক চড়া। কিন্তু পণ্য উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির অনুপাতে পোশাকের দাম সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বাড়ছে না। পোশাক রপ্তানির প্রধান বাজারগুলোতে কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ সুনামির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। কোভিডের সংক্রমণ রোধে ও নিজেদের রক্ষার্থে দেশগুলো বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ফলে পোশাকের নতুন ও চলমান রপ্তানি আদেশের ওপর প্রভাব পড়ছে। অন্য প্রধান রপ্তানি আয়ের খাতগুলোর মধ্যে হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার, প্রবৃদ্ধি ২১ শতাংশ। পস্নাস্টিক পণ্যে আয় হয়েছে সাত কোটি ১০ লাখ ডলার, প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩৪ শতাংশ। হস্তশিল্পে আয় দুই কোটি ১৩ লাখ ডলার, প্রবৃদ্ধি ২৯ শতাংশ। হোম টেক্সটাইলে আয় ৭১ কোটি ৭৯ লাখ ডলার, প্রবৃদ্ধি ৩১ শতাংশ। হালকা প্রকৌশলে রপ্তানি আয় ৪৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, প্রবৃদ্ধি ৬৮ শতাংশ। সিরামিক পণ্যে আয় এসেছে দুই কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৩ শতাংশ। তবে রপ্তানির এত জোয়ারেও ভালো যাচ্ছে না দেশের সোনালি আঁশখ্যাত পাট ও পাটজাত পণ্যে। চলতি অর্থবছরের গত ছয় মাসে এ খাতে আয় এসেছে ৫৯ কোটি ডলার। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ কম।
কোভিডের অভিঘাত কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি এখন চাঙা হচ্ছে। গতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। দেশের রপ্তানি খাতেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত শীর্ষ তিন ক্যাটাগরির পণ্য হলো তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এর মধ্যে তৈরি পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বাড়লেও কমেছে পাট ও পাটজাত পণ্য। করোনা মহামারির মধ্যেও আমদানি ও রপ্তানি দুই-ই বেড়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক অনুদান ও ঋণের ওপর ভর করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। গত বছরের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করে। এরপর টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির কবলে পড়ে দেশ। ওই সময় কলকারখানাও বন্ধ রাখা হয়। করোনার কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রায় বন্ধ ছিল। আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য গার্মেন্ট খাতে রপ্তানি কমেছিল। গার্মেন্ট পণ্যে মূল বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার প্রকোপ বেশি ছিল। অন্যদিকে করোনার কারণে আমদানি বাণিজ্য যে স্থবির হয়ে পড়েছিল তাতেও এখন গতি এসেছে। বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি বাজারগুলো হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জাপান, চীন, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, সুইডেন, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত।
বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানিনির্ভর। নতুন বাজার অনুসন্ধান ও পণ্য বৈচিত্র্যকরণের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমান রপ্তানি পণ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারা ইতিবাচক রাখতে হবে। সরকার পণ্য ও বাজারভিত্তিক একটি বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে, এই মন্দা অবস্থার মধ্যেও রপ্তানি বাজারে কোন ধরনের পণ্য ভালো চলছে। তাহলে সেই ধরনের পণ্যের ওপর জোর দেওয়া দরকার, এ ছাড়া অন্য দেশগুলো কি জন্য এত ভালো করছে, সেটিও খুঁজে দেখা প্রয়োজন। যদিও তাদের রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বেশি। সেগুলো আমরা করতে পারি কিনা, চেষ্টা করে দেখতে হবে। করোনা মহামারি বিশ্বের দেশে দেশে নানা সংকট সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে অর্থনীতিতে স্থবিরতা এনে দিয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে করোনার প্রকোপ কমে আসায় ধীরে ধীরে সচল হয়ে উঠছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প উৎপাদনে গতি ফিরে আসায় করোনাকালীন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন সবাই। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ইতোমধ্যে আমাদের অর্থনীতি অনেকটা গতি লাভ করেছে। করোনা মহামারির কারণে ব্যবসাবাণিজ্যসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাত চরমভাবে বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আকারে হাজির হলেও, বাংলাদেশ সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট দক্ষতা প্রদান করেছে। বর্তমানে আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নত দেশ হওয়ার পথে দ্রম্নততার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। অনেক সম্ভাবনাময় খাত একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলেও করোনা মহামারি ব্যবসাবাণিজ্য ও অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশে মেডিকেল ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (এমপিপিই) উৎপাদনে নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হয়েছে গত দেড় বছর সময়ে। অথচ একসময়ে এসব সামগ্রী আমাদের দেশে উৎপাদিত হতো না, বিদেশে উৎপাদিত এসব সামগ্রী আমদানির মাধ্যমে এখানকার চাহিদা মেটানো হতো। করোনা মহামারির প্রকোপ শুরু হওয়ায় সারা বিশ্বে করোনা সংক্রমণের বিস্তার রোধে বিশ্বে মেডিকেল ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (এমপিপিই) চাহিদা বেড়েছে। তাতে সার্জিক্যাল মাস্ক, মেডিকেল গস্নাভস, পিপিই, ফেস শিল্ড, গাউন, জুতার কাভার, অ্যাপ্রোন এবং সুরক্ষা চশমা প্রভৃতির বিপুল চাহিদা সৃষ্টি হয়। সেই চাহিদা মেটাতে দেশেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসব সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদন শুরু করে। প্রথমদিকে উৎপাদিত সামগ্রীর মান সন্তোষজনক না হলেও দ্রম্নতই প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে উন্নত এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার ব্যাপারে বিশেষভাবে মনোযোগী হয়েছে। ফলশ্রম্নতিতে দেশের চাহিদা, মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি শুরু হয়েছে সামগ্রী।
কোভিড-১৯ এর প্রভাব থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে ব্যবসায় খাতকে উৎপাদন ও রপ্তানি আয় বাড়াতে নানা উদ্ভাবনী ও টেকসই উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তৈরি পোশাক খাতের ওপর থেকে অতিনির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা। রপ্তানি খাতের জন্য সরকারকে পাঁচ-সাত বছর মেয়াদি একটি নীতি প্রণয়ন করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সবসময় রাজস্ব আহরণের দৃষ্টিকোণ থেকে রপ্তানি খাতকে দেখা হচ্ছে। এতে স্বল্প মেয়াদে সরকার রাজস্ব পেলেও দীর্ঘ মেয়াদে রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। শুধুমাত্র গার্মেন্টস খাতকে প্রাধান্য না দিয়ে পাশাপাশি অন্য খাতেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গতি বাড়াতে আঞ্চলিক বাণিজ্য বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে প্রায় সময়েই। অনেক বাধা বিপত্তির কারণে মাঝেমধ্যে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য হোঁচট খাচ্ছে। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে উপকৃত হবে বাংলাদেশ। বাণিজ্যের হাত ধরে এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটতে পারে। রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে হয়তো নানা প্রতিকূলতা আছে- যা অতিক্রম করে সমৃদ্ধির ধারা বজায় রাখাটা নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের প্রত্যাশা সব প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে। রপ্তানি আয় বাড়াতে নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীর কোন দেশে কোন ধরনের পণ্যের চাহিদা রয়েছে তা জানতে হবে। এ জন্য বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বিভিন্ন দেশের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এ জন্য আমাদের রপ্তানিকারকদের নিজস্ব উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে যে সব দেশের সঙ্গে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য চালু রয়েছে তার বাইরে আরো নতুন দেশে বাজার খোঁজার চেষ্টা জোরালো করতে হবে। রপ্তানি বাণিজ্যের বিকাশ ঘটাতে হলে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষিজাত শিল্প পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্রান্ডের পণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ায় এর বাজার বিস্তৃতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এজন্য সময়োপযোগী, কার্যকর, বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক