মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রগুলোর কাজ কী?

মাদকাসক্তি ছাড়াতে রোগীকে কাউন্সিলিংয়ের মধ্যে রাখতে হয়। অথচ এসব কেন্দ্রে রোগীদের মারধর কিংবা মানসিক চাপে রেখে বন্দিদশায় আরও অসুস্থ করে দেওয়া হয়- যার ক্ষতিকর প্রভাব রোগীর পরিবারে পড়ে।

প্রকাশ | ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

আবির হাসান সুজন
মাদক এক ভয়ানক অস্ত্র- যার প্রভাবে একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে মাদকাসক্তি মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে পরিগণিত। মাদকের ক্ষতিকর মানসিক ও স্বাস্থ্যগত প্রভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে আধুনিক রাষ্ট্রের উন্নয়ন। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি একটি পরিবার ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশে মাদকের ভয়ানক বিস্তার যত শক্ত অবস্থান তৈরি করছে এর বিপরীতে যথাযথ চিকিৎসা কিংবা নিরাময়ের ব্যবস্থা ততটা জোরদার করা হচ্ছে না। সারাদেশে মাদকাসক্তির সমস্যা যতটা ব্যাপক, এর সমাধানের জাতীয় উদ্যোগ সে তুলনায় একেবারেই ক্ষুদ্র এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা খুবই নগণ্য। বাস্তবতা হলো বেশির ভাগ নিরাময় কেন্দ্রকে অনেক সময় একটি ভবনের ভেতরে জেলখানার মতো মনে হয়। সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক থাকে না। সেবা দানকারীদের মধ্যে প্রায়শই মাদকাসক্তদের প্রতি অপরাধী হিসেবে আচরণ করার প্রবণতা থেকেই যায়। সারাদেশে ১৮ থেকে ৬০ বছরের মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫৬ লাখের বেশি। অবশ্য এই বিশালসংখ্যক মাদকাসক্তের চিকিৎসার জন্য দেশের ৪৪ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে মোটে ৩৫১টি। এর মধ্যে ১০৫টিই ঢাকায়। ২০ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো নিরাময় কেন্দ্রই নেই। কিন্তু মাদকাসক্তের চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিরা মারধর, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছাড়া তারা কোনো চিকিৎসা দেখেননি। নির্যাতনের বিষয়টি সামনে আসে কিছুদিন আগে। গাজীপুরের ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে। আশা করি, এতে করে কর্তৃপক্ষের টনক নড়েচড়ে যাবে। চিকিৎসার পরিবর্তে নির্যাতন, পরিবেশ ভালো না থাকা, চিকিৎসক না থাকা, অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেয়ার মতো নানা অভিযোগে মানুষের আস্থা হারাচ্ছে নিরাময় কেন্দ্রগুলো। এসব নিরাময় কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকতেই বিশ্রী গন্ধ এসে নাকে লাগে। অপরিচ্ছন্ন দেয়াল, মেঝেতে পুরনো ময়লা। শৌচাগার থেকেও উপচে পড়ছে ময়লা। শুধু ঢাকার কেন্দ্রগুলোতেই নয়, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় যে তিনটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আছে, সেখানকার অবস্থাও ভালো নয়। অবকাঠামো নেই, রোগী নেই, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক নেই, ভালো পরিবেশও নেই। সব মিলে দুরবস্থা বাসা বেঁধেছে সেখানে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী, নিরাময় কেন্দ্রে একজন মাদকাসক্ত রোগীর জন্য গড়ে কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে। এতে একজন চিকিৎসক, একজন মনোচিকিৎসক, একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স, একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও জীবন রক্ষাকারী উপকরণ এবং ওষুধ-পথ্য থাকতে হবে। বর্তমানে জীবনরক্ষাকারী উপকরণাদি ও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না নিরাময় কেন্দ্রে। অধিকাংশ নিরাময় কেন্দ্রে ঘুটঘুটে পরিবেশে আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই। \হমাদকাসক্তি সম্পূর্ণ নিরাময়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা শেষে কমিউনিটি চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়- যা এসব কেন্দ্রে অনুপস্থিত। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ পুনর্বাসন কেন্দ্রই পুনর্বাসন কেন্দ্র নয়। এই কেন্দ্রগুলোতে আসা রোগীদের হাতে ও পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে তালাবন্ধ কক্ষে রাখা হয়। এটি আর যায় হোক, চিকিৎসা নয়, এটি মানবিক অবমাননা। নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্ত ব্যক্তি আসার পর তাকে প্রশিক্ষিত লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কাউকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তাকে বিশেষ কক্ষে রাখতেই হবে। ওই কক্ষের মেঝে ও দেয়ালে ফোমজাতীয় পদার্থ থাকবে, যাতে রোগী পড়ে গিয়ে এবং কোনোভাবে মাথায় আঘাত না পান। মাদক গ্রহণ করতে না পারায় রোগীর শরীরে কাঁপুনি, মলমূত্র ত্যাগ করাসহ বিভিন্ন উপসর্গ ও প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ওষুধ দিতে হবে। মাদকাসক্তি ছাড়াতে রোগীকে কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে রাখতে হয়। মাদকাসক্তি ছাড়াতে রোগীকে কাউন্সিলিংয়ের মধ্যে রাখতে হয়। অথচ এসব কেন্দ্রে রোগীদের মারধর কিংবা মানসিক চাপে রেখে বন্দিদশায় আরও অসুস্থ করে দেওয়া হয়- যার ক্ষতিকর প্রভাব রোগীর পরিবারে পড়ে। মাদকাসক্ত যে নিজেই মাদকের ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হয় বিষয়টি এমন নয়, মাদকসেবীর সঙ্গে সঙ্গে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, তথা সামগ্রিক সমাজব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। একটি পরিবার যখন অর্থনৈতিক টানাপড়েন সত্ত্বেও চিকিৎসার জন্য নিরাময় কেন্দ্রে পাঠায় তখন হত্যার মতো ঘটনার শিকার হতেও দেখা যায়। এমন প্রেক্ষাপটে মাদকাসক্তদের সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় ও মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। পরিচ্ছন্ন ও মনোরম পরিবেশ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিনোদনসুবিধা, খেলাধুলা ও জিমনেশিয়ামের ব্যবস্থার পস্নাটিনাম ক্যাটাগরির এসি রুম, আত্মহত্যা ঠেকাতে সেন্সর বিশিষ্ট ফ্যান স্থাপন, লিফট ও জেনারেটর ব্যবস্থা, সব ধর্মের জন্য প্রার্থনার ব্যবস্থা, নারীদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ নানা রকম অত্যাধুনিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে নিরাময় কেন্দ্রে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মাদকাসক্তরা কোনো আসামি নয় কিংবা পরিবারের বোঝা, একটু কাউন্সিলের মাধ্যমে তারাও পেতে পারে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। তাই মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রগুলোর উচিত, তাদের সঙ্গে যথাযথ ব্যবহার করা, আধুনিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। আবির হাসান সুজন : কলাম লেখক