শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জিয়ার দেখানো পথে উত্তরসূরিরাও

মাহবুবুল হাসান পিংকু ভূইয়া
  ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী আজ। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সমাদৃত। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান এ দেশের মানুষের কাছে পরিচিত। তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের মধ্য দিয়ে দেশে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির সূচনা করেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নতুন দর্শন উপস্থাপন করেন জিয়াউর রহমান।

শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন। সামরিক জীবনে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যেও তিনি একের পর এক কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার কোম্পানি যুদ্ধে সবচেয়ে অধিক খেতাব লাভ করে। ৯ মাসের মুক্তিসংগ্রামে তিনি একটি সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে সমরনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বীর-উত্তম খেতাব লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে দেশে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভু্যত্থানে খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতাচু্যত হন এবং সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয়। জাতির ভাগ্যাকাশে তখন এক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল। সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে প্রকৃতপক্ষে সে সময় দেশে কোনো সরকার ছিল না। কোথা থেকে কী হচ্ছে তা জানতে পারছিলেন না কেউ। চারদিকে এক অনিশ্চয়তা-বিশৃঙ্খলার মাঝে আধিপত্যবাদের শ্যেনদৃষ্টিতে উৎকণ্ঠিত ছিল পুরো জাতি। ইতিহাসের সেই বিশেষ ক্ষণে সিপাহি-জনতার মিলিত প্রয়াসে জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন এবং নেতৃত্বের হাল ধরেন। এরপর থেকে জিয়াউর রহমানকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি শুধুই এগিয়ে গেছেন। ব্যক্তিগত সততা, পরিশ্রমপ্রিয়তা, কর্তব্যনিষ্ঠা, দৃঢ় নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা, নির্লোভ, নির্মোহ, গভীর দেশপ্রেম প্রভৃতি গুণ দিয়ে তিনি জাতির মধ্যে নতুন করে জাগরণের সৃষ্টি করেন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিতে একদিকে যেমন চরম বামপন্থিরা স্থান পান তেমনি চরম ডানপন্থিরাও জায়গা করে নেন। একটি উদার ও মধ্যপন্থি দল হিসেবে বিএনপিকে গড়ে তোলেন তিনি- যা বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল। জিয়াউর রহমান বিভক্তির রাজনীতি দূর করে ঐক্যের রাজনীতির ডাক দেন। রাজনীতিবিদদের তিনি জনগণের দোরগোড়ায় যেতে বাধ্য করেন। বিশাল কর্মযজ্ঞের সূচনা করে জনগণের মধ্যে তিনি সাড়া জাগান। মাত্র ছয় বছরের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পান শহীদ জিয়া। কিন্তু এ ছয় বছরেই তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন এবং তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে এ জাতিকে মুক্ত করেন। স্বজনপ্রীতি, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনসহ নানা অপকর্মে জাতির যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, ঠিক তখনই জিয়াউর রহমান শক্ত হাতে দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তিনি সমগ্র জাতির মধ্যে এক নবজাগরণের সূচনা করেন। সাদামাটা জীবনযাপনের এমন দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ কেন সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের ইতিহাসে খুব বেশি নেই।

বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে জিয়াউর রহমান যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, বিশ্বে দ্রম্নত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অংশ হিসেবে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ঘাতকদের তপ্ত বুলেটে প্রাণ হারান বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এই রাষ্ট্রনায়ক। তিনি যে কত জনপ্রিয় ছিলেন তা বোঝা গিয়েছিল ঢাকায় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত তার স্মরণকালের জানাজায়। সেদিন পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল- 'একটি লাশের পাশে সমগ্র বাংলাদেশ।'

জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পরে বিএনপি শেষ হয়ে যাবে এমনই আওয়াজ উঠেছিল সর্বত্র। তা হয়নি। শুরু দিকে দু'ছেলেকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েও ধমে যাননি স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ওই সময়ে ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে তৈরি হয় দলীয় কোন্দল। অন্যদিকে এরশাদের মন্ত্রিসভায় বিএনপির নেতাদের যোগদানে দল অনেকটা বিপর্যয়ে পড়ে। এবার দলকে পুনর্গঠন ও দেশের গণতন্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগ দেন বেগম জিয়া। এর আগ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া নিতান্তই গৃহবধূ ছিলেন। কিন্তু দল ও দেশের প্রয়োজনে রাজপথে নেমে আসেন তিনি। দলকে সুসংগঠিত রাখতে সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ১৯৮৩ সালে ৩ জানুয়ারি দলের সঙ্গে যুক্ত হন বেগম জিয়া। এবার বেগম খালেদা জিয়া হয়ে উঠেন বিএনপির অবিচ্ছেদ্য অংশ, দেশের গণতন্ত্রের অগ্রনায়ক। ১৯৮৩ সালের মার্চে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বগ্রহণ করেন। ওই বছর ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় বক্তব্য রাখেন বেগম খালেদা জিয়া। আর ১৯৮৪ সালে ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন তিনি। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য 'আপসহীন' নেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পান বেগম খালেদা জিয়া। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা সব মহলে প্রশংসিত হয় তখন। ১০ বছরের মধ্যে জিয়ার হাতে গড়া দল- বিএনপিকে ফের রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিয়ে আনেন তিনি। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রম্নয়ারি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। ১৯ মার্চ দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ওই সময়ে জাতীয় সংসদে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিল পাস করে ৩০ মার্চ পদত্যাগ করেন। ১২ জুন ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট জয়লাভ করেন এবং তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাইনাস টু ফর্মুলায় ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করে সংসদ ভবনের সাব-জেলে রাখা হয়। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টম্বর তিনি মুক্তিলাভ করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া আবারও বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর দলের পঞ্চম এবং ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে তিনি পুনরায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেন তিনি। এর মধ্যে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চেরিটেবল মামলায় সাক্ষী-জেরার জন্য নিয়মিত ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসায় হাজিরা দিতে থাকেন তিনি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি খালেদা জিয়াকে আবারও কারাগারে পাঠানো হয়। ২০২০ সালে সারাবিশ্বে করোনার প্রকোপ শুরু হলে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মাস কারাভোগের পর ২৫ মার্চ খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে ছয় ?মাসের জন্য মুক্তি দেয় সরকার। মুক্তি দিলেও রাজনীতি না করার শর্তের কারণে তাকে এক রকম রাজনীতি থেকে সরানো গেলেও জিয়ার উত্তরসূরিদের রাজনীতি থেকে সরানো যায়নি।

মাহবুবুল হাসান পিংকু ভূইয়া : সহ-সভাপতি, জাতীয়তাবাদী যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে