নাইকো দুুনীির্ত মামলা

খালেদা জিয়াকে দুনীির্তর একাধিক মামলা লড়ে যেতে হচ্ছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে ‘নাইকো মামলা’, ‘গ্যাটকো মামলা’, ‘বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলা’Ñ এই  তিনটি দায়ের করা হয় ২০০৭ পরবতীর্ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময়ে। তার সাজা হয়েছে কেবল ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা’য় (২০০৯ সালে মামলা হয়)। তবে দুনীির্তর পঁাচটি মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো ৩১টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মামলা নাশকতার। সেইসঙ্গে রয়েছে মানহানি এবং রাষ্ট্রদ্রোহের বেশ কিছু মামলা।

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

মিল্টন বিশ্বাস
সম্প্রতি আদালতে বেগম খালেদা জিয়া অভিযোগ তুলেছেন, ‘নাইকো দুনীির্ত মামলা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে না চললে তার বিরুদ্ধে চলছে কেন?’ উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ২০১০ সালের মাচের্ হাইকোটর্ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলা বাতিল করে দেন। রায়ে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই মামলাটি করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬-২০০১ সালে নাইকোর সঙ্গে দর কষাকষি করেছে, শেষ পযর্ন্ত চুক্তি করেনি কারণ নাইকোর একটি শতর্ বাংলাদেশের স্বাথের্র বিপক্ষে ছিল। বাংলাদেশবিরোধী শতর্ মেনে না নেয়ায় তখন নাইকোর সঙ্গে কোনো চুক্তিই সই হয়নি। অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই নাইকোর সঙ্গে তাদের সব শতর্ মেনে চুক্তি সই করে ফেলে। ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর নাইকো-বাপেক্স ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’ (জেভিএ) সই হয়। পরবতীর্ সময়ে কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয় যে, নাইকো বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার আমলে ঘুষ দিয়ে কাজ পায়। হাওয়া ভবনের গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ঘুষ নেন এবং খালেদা জিয়ার তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনকে ১ লাখ ৯০ হাজার কানাডিয়ান ডলার দামের একটি গাড়ি ও বিদেশ সফরের জন্য পঁাচ হাজার ডলার ঘুষ দেয়ার অভিযোগ ওঠে নাইকোর বিরুদ্ধে। দুনীির্তর মাধ্যমে নাইকোর সঙ্গে বাপেক্সের চুক্তি সম্পাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত হিসেবে তৎকালীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদসহ ২৬ জনের নাম আন্তজাির্তক আদালতে (ইকসিড) উপস্থাপন করা হয়। এই মামলার অভিযোগে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডার কোম্পানি নাইকোর হাতে তুলে দেয়ার মাধ্যমে খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য আসামি রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন। ক্ষতি করার অভিযোগে ২০০৭ সালে ৯ ডিসেম্বর তেজগঁাও থানায় একটি মামলা দায়ের করে ‘দুদক’। শেখ হাসিনা দেশের স্বাথের্র বিরুদ্ধে নাইকোর সঙ্গে কোনো চুক্তিই করেননি। কাজেই তার বিরুদ্ধে নাইকো সংক্রান্ত মামলার হিসাব খুবই সহজ। শেখ হাসিনা চুক্তিই করেননি, কাজেই মামলা খারিজ হয়েছে। আর খালেদা জিয়া দেশবিরোধী চুক্তি করেছিলেন দুনীির্তর মাধ্যমে, কাজেই খালেদা জিয়া এবার শুধু দেশে নয়, আন্তজাির্তকভাবেও দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন। খালেদা জিয়াকে দুনীির্তর একাধিক মামলা লড়ে যেতে হচ্ছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে ‘নাইকো মামলা’, ‘গ্যাটকো মামলা’, ‘বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলা’Ñ এই  তিনটি দায়ের করা হয় ২০০৭ পরবতীর্ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময়ে। তার সাজা হয়েছে কেবল ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা’য় (২০০৯ সালে মামলা হয়)। তবে দুনীির্তর পঁাচটি মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো ৩১টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মামলা নাশকতার। সেইসঙ্গে রয়েছে মানহানি এবং রাষ্ট্রদ্রোহের বেশ কিছু মামলা। ১৫ আগস্টে তার জন্মদিনটি ভুয়াÑ এই অভিযোগেও একটি মামলা রয়েছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। বিগত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগঁাও থানায় নাইকো দুনীির্ত মামলা দায়ের করে দুনীির্ত দমন কমিশন (দুদক)। ২০০৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদক এই মামলায় অভিযোগপত্র দেয়। ২০০৮ সালের ৫ মে থেকে এ মামলায় চাজর্ শুনানি শুরু হয়, তা আজও শেষ হয়নি। বলা হচ্ছে, মওদুদ আহমদ সাহেবের জন্যই শুনানি ঝুলে আছে। তবে নানা অজুহাতের পর এখন আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। নাইকো মামলায় ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর আদালতে খালেদা জিয়া আত্মসমপর্ণ করে জামিন চাইলে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেছিলেন। ২. ‘নাইকো’ মামলার অভিযোগসমূহ পযাের্লাচনা করলে দেখা যায়, খালেদা জিয়া এবং অন্যান্যরা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন রাষ্ট্রবিরোধী ওই কমর্কাÐে। যেমন, ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী খালেদা জিয়া ‘বাপেক্স’ ও ‘পেট্রোবাংলা’র মতামতকে উপেক্ষা করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই প্রস্তাব অনুমোদন করেন- ক) আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালেেয়র প্রাপ্ত মতামতের আলোকে ছাতক গ্যাস-ফিল্ড- ফ্রেমওয়াকর্ অব আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের (এফওইউ) এক্সিবিটের বণির্ত মতে বিবেচনা করা যেতে পারে। খ) বাপেক্স ও নাইকো রিসোসের্স (বাংলাদেশ) লিমিটেডের মধ্যে যৌথ সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য অনুমোদিত ‘প্রান্তিক’ এবং ‘পরিত্যক্ত গ্যাস ফিল্ড উন্নয়ন সংক্রান্ত পদ্ধতি’ এর মাঝে বণির্ত সমুদয় শতর্ এবং অপরাপর প্রাসঙ্গিক বিধি-বিধান অনুসরণে যৌথ সহযোগিতা চুক্তির (জেভিএ) খসড়া চূড়ান্তকরণের জন্য পেট্রোবাংলাকে নিদের্শনা দান করা যেতে পারে।’ খালেদা জিয়ার এই সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পেট্রোবাংলাকে প্রয়োজনীয় পরবতীর্ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। সে মোতাবেক ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’র খসড়া চূড়ান্ত করার পর জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ কতৃর্ক অনুমোদনের জন্য ৭/৯/২০০৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর নিকট পুনরায় সার-সংক্ষেপ প্রেরিত হতে তা কোনোরূপ  অনুমোদন ও নিদের্শনা ছাড়াই ফেরত পাঠানো হয়। এতে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন সংশ্লিষ্ট নথির নোট অনুচ্ছেদ ৩৯৭তে তার আগের অথার্ৎ ৮/১০/২০০৩ তারিখে নিজ হাতে লিখিতভাবে উল্লেখ করেন যে, ‘বিগত ১৫/৯/২০০৩ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, এ বিষয়ে তিনি ইতোপূবের্ ১৮/৩/২০০৩ তারিখে মন্ত্রণালয়ের সার-সংক্ষেপের প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পুনঃঅনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না। উপযুর্ক্ত আদেশ স্বয়ং-সম্পূণর্ এবং মন্ত্রণালয়কে জেভিএ চূড়ান্ত করার নিদের্শ দেন।’ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনের মতামত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তারা অন্যদের সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে নিজেরা লাভবান হয়ে ও নাইকো রিসোসের্স লিমিটেডকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে লিখিত নিদের্শ না দিয়ে একটি অপকৌশলের মাধ্যমে মৌখিকভাবে ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’ চূড়ান্তকরণের নিদের্শ প্রদান করেন। তৎপ্রেক্ষিতে ‘কামতা’ গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের মজুদ ও উত্তোলনযোগ্য পরিমাণ কম থাকায় নাইকো রিসোসের্স লিমিটেডের অনীহার কারণে ‘কামতা’ গ্যাস ক্ষেত্র ব্যতীত ছাতক ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’ সম্পন্ন করা হয়। যার ফলে ছাতক ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের এরকম ক্ষতিসাধন করা হয়Ñ ছাতক পূবার্ংশ গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ গ্যাসের পরিমাণ ১৯০০ বিসিএফ আর উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ দেখানো হয় ১১৪০ বিসিএফ। ছাতক পশ্চিমাংশ ৬৭৭ বিসিএফের বিপরীতে ৪৭৪ বিসিএফ, ফেনীতে ১৮৫ এর বিপরীতে ১৩০ বিসিএফ দেখানো হয়। অথার্ৎ উত্তোলনযোগ্য ১৭৪৪ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলনের অবৈধ সুবিধাপ্রাপ্ত হয় নাইকো। তন্মধ্যে শতার্নুযায়ী নাইকো রিসোসের্স (বাংলাদেশ) লিঃ ন্যূনতম ১০ হাজার কোটি টাকার মূল্যমানের সুবিধা প্রাপ্তির অবৈধ সুযোগ লাভ করে। আমরা জানি ‘গ্যাস’ বাংলাদেশের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। সমগ্র বাংলাদেশকে ২৩টি বøকে ভাগ করে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কাযর্ক্রম চলছে। আর এই ২৩টি বøকের মধ্যে ১৫টি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। বাকি ৮টি বøকে এ পযর্ন্ত মোট ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র বা ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে; রয়েছে ৬২টি কূপ। গ্যাস উত্তোলন করা ওই ১৯টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ছাতক ও কামতা গ্যাসক্ষেত্র বাদে ১৭টি ক্ষেত্রের গ্যাস উত্তোলন বতর্মানে চালু আছে। সরকারের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এবং এর অধীনে পেট্রোবাংলা প্রধানত এসব গ্যাসক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করে। পেট্রোবাংলার অধীনে আবার ১১টি কোম্পানি রয়েছে। যার মধ্যে বাপেক্স, সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিঃ এবং বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস লিঃ ‘নাইকো’ মামলা সংশ্লিষ্ট ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’-এর সঙ্গে সম্পকির্ত।   ৩. নাইকো দুনীির্ত মামলার সামগ্রিক দিক পযাের্লাচনা করলে দেখা যায়, ছাতক ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র দুটি প্রান্তিক বা পরিত্যক্ত ঘোষণা, বাপেক্সের সঙ্গে প্রস্তাবক কোম্পানি নাইকোর ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’ সম্পাদনা এবং ওই ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’-এর আওতায় গ্যাসক্ষেত্র দুটিকে উৎপাদন উপযোগী করার ক্ষেত্রে চাতুযের্র আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’ সম্পাদনের মাধ্যমে প্রযুক্তি হস্তান্তরের লক্ষ্যও অজির্ত হয়নি। চুক্তিটি সম্পাদনের সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অনুমোদনও গ্রহণ করা হয়নি। সে ক্ষেত্রে একটি অস্পষ্ট অবিশ্বাস্য মৌখিক নিদের্শনার বরাত দেয়া হয়েছে। এসবের মাধ্যমে বিষয়টির স্বচ্ছতার মান একেবারে শূন্যের কোটায় নেমে আসে। একটি বিতকির্ত পদ্ধতি প্রবতর্ন এবং কাযের্ক্ষত্রে সেটাকেও লঙ্ঘনের দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ অব্যবস্থাপনায় এক ধরনের মারাত্মক অবিমৃশ্যকারিতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বিপুল মজুদ সত্তে¡ও ছাতক ও অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্রকে প্রান্তিক ঘোষণা করে দেশকে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক ধরনের স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন করা হয়। এই বিশ্লেষণ থেকে পাঠকরা পরিষ্কার যে, নাইকো দুনীির্ত মামলায় স্পষ্টত বেগম খালেদা জিয়া জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ড. মিল্টন বিশ্বাস :  অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়