ভূপৃষ্ঠস্থ দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য যাবতীয় জৈব ও অজৈব পদার্থের সমন্বয়ে পরিবেশ গঠিত। অর্থাৎ আমাদের চারপাশে যা কিছু রয়েছে সব কিছু মিলেই আমাদের পরিবেশ। এই পরিবেশের অনেক কিছুই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই আবার কিছু উপাদান দেখতে হলে যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। পরিবেশ না থাকলে আমাদের সমাজে মানুষের কী কোনো অস্তিত্ব টিকে থাকবে? উত্তর হলো না আমরা এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারব না। যার কারণে তো বুধ, শুক্র,, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন নামক গ্রহগুলোতে মানবজাতির অস্তিত্ব নেই। মানবজাতির কর্মকান্ডের জন্যই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ছে ইতোমধ্যে তাপমাত্রা উঠছে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর এবং দেখা দিচ্ছে চরম আবহাওয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখন যে চরম তাপপ্রবাহ, প্রচন্ড ভারী বৃষ্টিপাত, খরা বা সাইক্লোন হতে দেখা যাচ্ছে- তাতে জলবায়ুর এই পরিবর্তন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। যার ফলে পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে যা মানবজাতির জন্য অশনিসংকেত। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার যুদ্ধে বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত? সম্প্রতি ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ২০০ রেকর্ড করা হয়েছে, যা বাতাসের মানকে 'অস্বাস্থ্যকর' বলে নির্দেশ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও) ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইপিএর হিসাবে কোনো একটি শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। ৩০০-র উপরে হলে সেটিকে দুর্যোগপূর্ণ বলা হয়। চীনের উহান ২১৮ একিউআই স্কোর নিয়ে শীর্ষস্থান, ঢাকা শহর দ্বিতীয় স্থানে এবং ভারতের কলকাতা ১৯৩ স্কোর নিয়ে তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক দ্বারা প্রমাণিত হয় শহরের বাতাস দূষিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণে ভুগছে। ঢাকা শহরকে কারা অস্বাস্থ্যকর করছে? শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ কাজ, রাস্তার ধুলো ও অন্যান্য উৎস থেকে দূষিত কণার ব্যাপক নিঃসরণের কারণে শহরের বাতাসের গুণমান দ্রম্নত খারাপ হতে শুরু করে। বিশেষজ্ঞদের গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে বায়ুদূষণের শিকার দেশের মধ্যে শীর্ষ শহর রাজধানী ঢাকা। এর কারণ পুরনো যানবাহনের আধিক্য, অপরিকল্পিতভাবে শহরের যেখানে-সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, শহরের আশপাশের ইটভাটা ও শিল্প-কলকারখানার দূষণ, শহরের ভেতরে যে ময়লা-আবর্জনা জমে সেগুলো পোড়ানোর ধোঁয়া এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্যই বসবাসের অযোগ্য নগরী ঢাকা শহর। ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধূলিকণা জমে। সেই হিসাবে মাসে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধুলো জমা হয়। এই জমে থাকা ধুলো দিনের বেলা বাতাসের সঙ্গে মিশে যেমন দূষণ বাড়ায়, তেমনি রাতে গাড়ির অতিরিক্ত গতির সঙ্গে বাতাসে উড়তে থাকে। আর তাই দিনের বেলা থেকে রাতের বেলা বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়।
বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ণ বস্তুকণা বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নএইচও) মতে, বায়ুদূষণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী বাধা পালমোনারি রোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ও তীব্র শ্বাসকষ্ট সংক্রমণের ফলে আনুমানিক ৭০ হাজার মানুষের মৃতু্য হচ্ছে।
আমাদের দেশের বায়ুদূষণের অবস্থা দিন দিন খারাপ। কিন্তু দুঃখের বিষয় বায়ুদূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বায়ুদূষণ রোধে রাষ্ট্রের ভূমিকা তেমনটা লক্ষ্য করার মতো নয়। বায়ুদূষণ রোধের প্রধান কাজ তো পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু তারা যখন বায়ুদূষণ ঠেকাতে পারছে না তখন তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। পূর্বে আমরা দেখেছি রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকার বায়ুর মান ছিল ২৯৮, যা দুর্যোগপূর্ণের কাছাকাছি ফলে স্বাস্থ্যের জন্য যেমন খুবই অস্বাস্থ্যকর। ঠিক তেমনি ওই স্থানের পরিবেশও দূষিত। ফলে দূষিত পরিবেশ নিয়ে মানুষ কী বসবাস করতে পারবে। আমাদের দেশের রাজধানী শহর ঢাকা। ফলে আমরা জানি এই শহরের শিক্ষিত মানুষ ও পরিবেশ উন্নত কিন্তু দিনের পর দিন খবর প্রচারিত হচ্ছে ঢাকা শহর অস্বাস্থ্যকর তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে এই শহরেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি, প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, জাতীয় সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনসহ ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ঢাকা শহরেই আছে। কিন্তু এত শিক্ষিত ব্যক্তি থাকার পরেও আজ ঢাকা শহর কেন অযোগ্য নগরী হবে? আমাদের দেশের ভিআইপি মানুষ তো খোলা রাস্তায় বের হয় না তারা তো ভিআইপি গাড়িতেই ঘোরেন ফলে তাদের পরিবেশ নিয়ে মাথাব্যথা থাকে নামমাত্র। কিন্তু পরিবেশ দূষণের কবলে বেশি শ্রমজীবী মানুষ। যারা কিনা দিনের পর পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য হন্যে হয়ে ঢাকা শহরে ছোটেন তারাই বেশি এর ভুক্তভোগী। কিন্তু মনে রাখতে হবে পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। তাই মানুষ হিসাবে প্রধান দায়িত্ব শুধু উন্নয়নে নয় পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। ফলে দায়িত্ব জনগণের সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। বায়ুদূষণের সূচক ৩০০ নয়, দূষণের পর্যায় সূচক ৫০শে নিয়ে আসতে হবে।
তার জন্য প্রয়োজন ঢাকাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা,
অপরিকল্পিত যে সব কার্যকলাপ, তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঢাকা শহরে এখনো প্রচুর ডিজেলচালিত পুরাতন বাস চলে এবং প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার যানজটে বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া নির্গত হয়। সেই নির্গত ধোঁয়া যাতে বের না হয় সতর্ক থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ডিজেল বাসের পরিবর্তে ইলেকট্রিক বাসের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সেক্টর থেকে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনতে হবে। যানজট কমানোর প্রতি মনোযোগী হওয়া ও ধীরে ধীরে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণকে টার্গেট করে আমাদের নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। শহরের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পরিকল্পনা করা। বৃদ্ধির বিষয়টিও পরিকল্পিতভাবে হতে হবে। নাগরিকরা যে সব সমস্যা মোকাবেলা করছে, সেগুলো সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অংশগ্রহণও আবশ্যক। বাসযোগ্য নগরী হিসাবে গড়ে তোলার কাজটি মেয়র ও কাউন্সিলরদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
রাশেদুজ্জামান রাশেদ
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট