শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান ও বাংলাদেশ

ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানের ফলেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ঐতিহাসিকরা এই মামলা এবং মামলা থেকে সৃষ্ট গণআন্দোলনকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে প্রেরণাদানকারী অন্যতম প্রধান ঘটনা বলে গণ্য করে থাকেন।
কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন
  ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি। সেদিন ছিল হরতাল। এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খান সরকারবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় তীব্র এক গণ অভু্যত্থানে ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে ইতিহাসে একে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই গণ আন্দোলনকে। পাকিস্তানি শাসকরা একে নস্যাৎ করতে আগরতলা মামলা করে। মামলার প্রধান আসামি শেখ মুজিবসহ অন্যান্যের মুক্তি ও পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সান্ধ্যআইন ভঙ্গ করে সাধারণ মানুষ মিছিল বের করে।

\হসেই মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান কিশোর মতিউর রহমান মলিস্নকসহ চারজন। সময়টা ছিল এমন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে তখন বন্দি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি মৃতু্যর দিন গুনছেন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেবেন।

\হসে কারণে শেখ মুজিবকে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটে আনার পর আবার গ্রেপ্তার করে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' মামলার আসামি হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করা হয়। এই মামলার প্রকৃত নাম ছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান'। উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতির কণ্ঠ স্তব্ধ করা। তবে পরের বছর জানুয়ারির চিত্র আমূল পাল্টে যায়।

৪ জানুয়ারি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এরপর ১০ জন ছাত্রনেতার সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন সংগঠিত করা হয়। ঊনসত্তরের ১৭ জানুয়ারি

১৪৪ ধারা ভাঙার ঘোষণা দেওয়া হয়; এর প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি কর্মসূচি দেওয়া হয়। হামলা চালানো হয়েছিল ওই কর্মসূচিতে। প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি মিছিল বের করা হলে গুলিতে মারা যান ছাত্রনেতা আমানুলস্নাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। আসাদের মৃতু্যর ঘটনাকে ঘিরে বেগবান হয়ে ওঠে আন্দোলন। তার মৃতু্যর প্রতিবাদে পরদিন আবার কলাভবনে কর্মসূচি দেওয়া হয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে-তথা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে যোগ দেয়। বাদ পড়েননি শ্রমিকরাও।

ছাত্রনেতারা শহীদ আসাদের গায়ের রক্ত মাখা জামা দিয়ে পতাকা তৈরি করে, শহীদ মিনারে তার লাশ শুয়ে স্পর্শ করে শপথ নেয় আন্দোলনের, শপথ নেয় প্রতিবাদের, গর্জে ওঠে এক ঝাঁক কিশোর-তরুণ প্রাণ, জীবনের মায়া যাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি-

'আসাদ তোমার রক্ত বৃথা যেতে দেব না।'

'২১ জানুয়ারি পল্টনে ২২ থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত পরবর্তী তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেদিন সেখানে মওলানা ভাসানীও ছিলেন, ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ২২ জানুয়ারি প্রত্যেকটা বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয় ও ২৩ তারিখ সন্ধ্যার পর হয় মশাল মিছিল। তৎকালীন আজাদ পত্রিকায় যার শিরোনাম হয়েছিল 'স্মরণকালের বৃহত্তম মশাল মিছিল'। এরপর ২৪ জানুয়ারি হরতাল পালিত হয়। পল্টনে লাখো লাখো লোক জমায়েত হয়।

'ঢাকা শহরের সমস্ত মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগুন জ্বলছে। মানুষের স্রোত পল্টনের দিকে। এই যে মতিউর, মকবুল, রুস্তম ও আলমগীর- এই চারজনকে গুলি করে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগরতলা মামলার সাক্ষী, তৎকালীন মন্ত্রী, এমনকি বিচারপতির বাড়িতেও মানুষ আগুন লাগিয়ে দেয়, এ যেন এক অন্যরকম প্রতিজ্ঞা দৃঢ় প্রত্যয় ইস্পাতকঠিন মনোবল নিয়ে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে যাওয়া, বিজয়ের প্রত্যাশা ও ছাত্রনেতারা ভাবতে শুরু করে যে, এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।'

'তখন প্রথম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রম্নপ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রম্নপ এবং ডাকসুর ভিপি বর্তমান বর্ষীয়ান রাজনীতিক তোফায়েল আহমদ এবং জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে এবং পরে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একটি অংশ এসে যোগ দেয়'।

মাহবুব উলস্নাহ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ছিলেন, তিনি ২৪ জানুয়ারির দিনটির স্মৃতিচারণ থেকে জানান, '১৯৬৮ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ৫ ডিসেম্বর পরের দিন হরতালের ডাক দেন এবং তা পালিত হয়। সেখানে দু'জন নিহত হন।'

'পরদিন সাত তারিখেও হরতাল পালিত হয়। পরবর্তী ২৯ ডিসেম্বর সারাদেশে হাট-হরতাল পালনের আহ্বান জানান মওলানা ভাসানী। এখান থেকে মানুষ আন্দোলনের উদ্দীপনা পায়। পরবর্তী সময়ে ১১ দফা কর্মসূচি আসে ছাত্রসমাজ থেকে, যার মূল বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।'

মাহবুব উলস্নাহ জানান, 'এরপর ১৭ জানুয়ারি থেকে আন্দোলনের সূচনা। ২০ জানুয়ারি আসাদ শহীদ হলেন। এরপর ২৪ জানুয়ারি আরেকটি হরতালের ডাক দেওয়া হয়।'

\হ'সে ছিল এক বিশাল গণ অভু্যত্থান। যখন আমরা পল্টন ময়দানে জড়ো হলাম আমাদের সামনে পাঁচ লাখ লোকের বিশাল সমাবেশ। জনগণের মধ্যে প্রচন্ড আক্রোশ এবং ক্রোধ কাজ করছিল।'

\হ'তারা তৎকালীন গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) হামলা করতে চাইছিল। কিন্তু এটা হবে হটকারী এবং বহু মানুষের প্রাণ হারাবে সেই চিন্তা করে আমরা সেখানে শহীদ মতিউরের জানাজা আদায় করে মিছিল নিয়ে তৎকালীন ইকবাল হলের দিকে চলে গেলাম,' বলছিলেন মাহবুব উলস্নাহ। তিনি বলেন, 'ছাত্রসমাজ, মেহনতি জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের একতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয় এই আন্দোলনকে ঘিরে।'

'আন্দোলন তখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।'

বর্ষীয়ান রাজনীতিক তোফায়েল আহমদ ২৪ জানুয়ারি দিনটির স্মৃতিচারণ থেকে বলেন, ২৪ জানুয়ারি নিহত হওয়া নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র কিশোর মতিউর রহমান এর আগে পল্টনে গায়েবানা জানাজাতে অংশ নিয়েছিল। সেই মতিউরকে তার বাবা আন্দোলন থেকে আটকে রাখতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

মৃত কিশোর মতিউরের পকেটে হাত দিয়ে পরে একটি চিরকুট পাওয়া গেল, যেখানে লেখা ছিল- 'মা আমি মিছিলে যাচ্ছি, যদি ফিরে না আসি তাহলে মনে করো, তোমার মতিউর বাংলার মানুষের জন্য, শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল, ইতি মতিউর রহমান।'

বিরবিসি বাংলা।

আজকের বঙ্গভবন তখন পরিচিত ছিল গভর্নর হাউস হিসেবে। সেখানেও আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল উত্তেজিত জনতা। তোফায়েল আহমদ বলেন, এরপর মিছিল নিয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) মাঠে জড়ো হই। সেদিনই সান্ধ্যআইন (কারফিউ) জারি করে দেওয়া হয়।

এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ফেব্রম্নয়ারি মাসের শুরুতেই আইয়ুব খান ঘোষণা করেন- তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করবেন না।

এর মাঝে ১৮ ফেব্রম্নয়ারি রাজশাহীতে ডক্টর শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হয় এবং কারফিউ জারি করা হয়। ২০ তারিখে কারফিউ ভঙ্গ করে মশাল মিছিল করা হয় এবং ২১ তারিখ ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয় শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে। এই আন্দোলনের জেরে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে এবং ২২ ফেব্রম্নয়ারি শেখ মুজিবসহ মামলার অভিযুক্তদের মুক্তি দেওয়া হয়। এখন যেটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত, সেখানে ২৩ ফেব্রম্নয়ারি তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং ভূষিত করা হয় বঙ্গবন্ধু উপাধিতে।

\হসেখানেই সেদিন শেখ মুজিব জানান, তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে এগারো দফা দাবি তুলে ধরবেন।

তোফায়েল আহমদের ভাষায়, 'বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, তিনি যদি ছয় দফা না দিতেন আগরতলা মামলা হতো না, এই মামলা না দিলে গণ অভু্যত্থান হতো না, এই গণ অভু্যত্থান না হলে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারতাম না, আর তিনি মুক্তি না পেলে সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হতাম না।'

'আর তিনি যদি নির্বাচনে বিজয়ী না হতেন, তাহলে আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম না,' এভাবেই মি. আহমদ ব্যাখ্যা করেন ঘটনাক্রমকে। মাহবুব উলস্নাহ বলেন, তখন ইত্তেফাক নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আজাদ, মর্নিং নিউজ, পাকিস্তান অবজারভার, সংবাদ- এসব পত্রিকায় প্রতিদিন এই আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হতো গুরুত্ব সহকারে।

তিনি মনে করেন, এই আন্দোলন শুধু ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে নয়, বরং কৃষকদের মধ্যে, শ্রমিকদের মধ্যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল- ফলে তা হয়ে উঠেছিল গণ অভু্যত্থান।

ঊনসত্তরের গণ অভু্যত্থানের ফলেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ঐতিহাসিকরা এই মামলা এবং মামলা থেকে সৃষ্ট গণ আন্দোলনকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে প্রেরণাদানকারী অন্যতম প্রধান ঘটনা বলে গণ্য করে থাকেন।

তথ্য : বিবিসি বাংলা, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, এমপি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ছাত্র নেতা মাহবুব উলস্নাহ স্মৃতিচারণ থেকে।

কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, লেখক ও কলামিস্ট, পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ, প্রকল্প পরিচালক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে