পাঠক মত

কৃষিবিদ জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

ড. মো. শাহ কামাল খান প্রকল্প পরিচালক কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি, ঢাকা
বরেণ্য কৃষিবিদ বর্ষীয়ান জননেতা বদিউজ্জামান বাদশা নবীন-প্রবীণ সব কৃষিবিদকে আপনজন, আত্মার আত্মীয়, সবার মনের মণিকোঠায় স্থান পাওয়া এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব, কৃষিবিদ জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৫৮ সালের ৫ জানুয়ারি শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশার জন্ম। মেধাবী ছাত্র বদিউজ্জামান বাদশা ১৯৭৪ সালে ৫টি লেটারসহ এসএসসি পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ জামালের সহপাঠী ছিলেন। কিন্তু তিনি কখনো শেখ জামালের সহপাঠী পরিচয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নেননি বা নেওয়ার চেষ্টা করেননি এই বিশাল মনের অধিকারী ত্যাগী এই নেতা। তিনি এইচএসসি পাস করে সিলেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। মেধাবী ছাত্র বদিউজ্জামান বাদশা মেডিকেল কলেজ ছেড়ে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নের ব্রত নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বদিউজ্জামান বাদশা ৭৫ পরবর্তী কঠিন দিনগুলোতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিবীয় আদর্শের অগ্র সৈনিক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সমগ্র বাংলাদেশে তিনি সামরিক শাসন এবং স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র বদিউজ্জামান বাদশা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দক্ষ সাংগঠনিক ক্ষমতার বদৌলতে পরে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সহ-সভাপতি, কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি, নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। নালিতাবাড়ীতে তিনি হাজী নূরুল হক নন্নী-পোড়াগাঁও মৈত্রী কলেজ, নালিতাবাড়ী ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কৃষিবিদদের নেতৃত্ব দিতেন, ভালোবাসার ছায়াতলে আগলে রাখতেন। কৃষিবিদদের বিভিন্ন ন্যায্য দাবি আদায়ে তিনি অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন, বিভিন্ন ফোরামে তার অকুতোভয় স্পষ্ট ভাষা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। নবীন-প্রবীণ সব কৃষিবিদের সঙ্গে তার ছিল মধুর সম্পর্ক ও সখ্যতা। কৃষিবিদদের কাছে ডাকতেন, পাশে থাকতেন, সবার খোঁজ-খবর নিতেন, সমস্যা-সমাধানের জন্য তৎপর থাকতেন। ২২ নভেম্বর, ২০২১ শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও সাবেক ছাত্রনেতা বরেণ্য কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিলস্নাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ চত্বরে তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় জানাজা বাদ জোহর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ ও বাদ মাগরিব নালিতাবাড়ী তারাগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে তার তৃতীয় নামাজে জানাজা শেষে পৌর শহরের সিটপাড়া কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে জননেতার জানাজায় লোকে লোকারণ্য ছিল উপজেলা সদর এলাকা। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দলে দলে জানাজায় যোগ দিয়েছিল আবালবৃদ্ধবনিতা। তারাগঞ্জ হাইস্কুলের বিশাল মাঠে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। স্থানীয় নেতারা, জনপ্রতিনিধিরা ও জনসাধারণ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। একজন মানুষের মৃতু্য হলে তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশার মৃতু্যতে দেশের সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কৃষিবিদদের গর্ব ও অহংকার কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা ভাই আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। কৃষিবিদ জগৎ থেকে হারিয়ে গেলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বদিউজ্জামান বাদশা শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি রাজনৈতিক প্রতিভার নাম। তিনি ছিলেন কৃষিবিদদের চোখের মণি। তথ্য-উপাত্তে সমৃদ্ধ অনর্গল বক্তৃতা দেওয়ায় সক্ষম বাদশা ভাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রাঞ্জল শব্দচয়নে বক্তৃতা দিয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করার মতো একজন জননেতা ছিলেন। অত্যন্ত জনবান্ধব, গণমুখী ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। আজীবন সংগ্রামী এই নির্লোভ এবং ত্যাগী মানুষটি অনেকটা অবমূল্যায়িত হয়ে অস্ফুটো গোলাপের মতো অকালেই ঝরে গেলেন। প্রতি বছর ১৩ ফেব্রম্নয়ারি আসবে, কৃষিবিদ দিবস পালিত হবে, সারা দেশব্যাপী কৃষিবিদদের বিভিন্ন মিলনমেলা হবে কিন্তু প্রিয় বাদশা ভাইকে দেখা যাবে না, তার তথ্য-সমৃদ্ধ মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হবে না। ব্যক্তি বদিউজ্জামান বাদশা আমাদের মধ্যে নেই; কিন্তু তার আদর্শ, মতাদর্শ, ত্যাগ, শিক্ষা আজ আমাদের কাছে দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হোক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, তার গুণাবলির চর্চা হোক সর্বস্তরে- দেশ থেকে দেশান্তরে, সৃষ্টি হোক অসংখ্য ত্যাগী বর্ষীয়ান জননেতার আর তাদের মধ্যেই বেঁচে থাক আমাদের সবার প্রিয় বদিউজ্জামান বাদশা ভাই। বাদশা ভাই আছেন, থাকবেন আমাদের সবার অস্তিত্বের মধ্যে। তিনি থাকবেন সংগ্রামে, চেতনায়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত অবিচলিত আমৃতু্য পথ চলায়।