টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন বৃত্তাকার অর্থনীতি রেজাউল করিম খোকন

পরিবেশের ওপর শিল্পের আরেকটি ক্ষতিকর প্রভাব হলো কারখানার ব্যবহৃত পানি নদনদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়ে প্রবাহিত হয়। পোশাক কারখানার এই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ও রংমিশ্রিত পানি নদনদী, খাল-বিলের পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। যার ফলে নদনদী খাল-বিলের মাছ মারা যাচ্ছে, চাষাবাদে বিঘ্ন ঘটছে। এতে কৃষি উৎপাদনে প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে।

প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ক্রমপরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে শিল্পের ভূমিকার বিষয়টিকেও নজর রাখতে হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায় পরিবেশ ও জলবায়ুর বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহার বাড়ছে। পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু, বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। শঙ্কা তৈরি হচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের। আগামী প্রজন্মের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র রক্ষা, বর্জ্য ও দূষণ রোধ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতির বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। পণ্য ব্যবহারের পর বর্জ্য সংরক্ষণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ কমে, দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায় পরিবেশ। বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেলে উৎপাদন ও ভোগের মধ্য সমন্বয় সাধন হয়। পণ্য ব্যবহারের পর বর্জ্য সংরক্ষণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ কমে, দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায় পরিবেশ। তাই টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের কার্যকর হাতিয়ার হচ্ছে সাকুর্লার ইকোনমি। বিশ্বে এখন কেউ বর্জ্যকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে না। এক শিল্পের বর্জ্য অন্য শিল্পের জন্য উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন, ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের। এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর সেজন্য সার্কুলার ইকোনমির বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। যে হারে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার হচ্ছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যে মূল্যবান বিভিন্ন খনিজের মজুত শেষ হয়ে যাবে। তবে পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এ বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। ওই বিবেচনা থেকেই এখন বৃত্তাকার অর্থনীতির দিকে এগোনো দরকার। দেশে নির্মাণ শিল্প, টেক্সটাইল, মোটর গাড়ি, লজিস্টিকস, কৃষি, আসবাব, তেল ও গ্যাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে সার্কুলার ইকোনমিতে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু বার্ষিক পস্নাস্টিক ব্যবহার মাত্র ৭ থেকে ৮ কেজি। পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে পস্নাস্টিক-বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে এ পরিমাণ ১৩০ কেজি। পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে পস্নাস্টিক বর্জ্যকে অপার সম্পদে রূপান্তর করছে দেশটি। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো সার্কুলার ইকোনমি প্রয়োগের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। ইউরোপীয় কমিশন এরই মধ্যে সার্কুলার ইকোনমি অ্যাকশন পস্ন্যান তৈরি করেছে। এছাড়াও চীন, ব্রাজিল, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও জাপান তাদের অর্থনীতিকে সার্কুলার ইকোনমিতে রূপান্তরের জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশেরও একই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তবে সেজন্য উৎস্যে বর্জ্যকে ধরন অনুযায়ী আলাদা করে সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে আলাদা কোনো ডাম্পিং জোন নেই যেখানে বর্জ্যকে আলাদা করা সম্ভব। এজন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করা জরুরি। সার্কুলার ইকোনমি নিয়ে কাজ করতে মন্ত্রণালয়ে একটি আলাদা সেল গঠন করতে হবে। এই সেল সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংগঠনের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে। সার্কুলার ইকোনমি বিকাশের জন্য অপরিহার্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। দেশে অনানুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। এই খাতের আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্পের মর্যাদা পাওয়া উচিত। এ বিষয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। তারপরও বৃত্তাকার অর্থনীতি নিয়ে কাজ করতে মন্ত্রণালয়ে একটি আলাদা সেল গঠন করা হবে। এই সেল সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে কাজ করবে। বর্তমানে ৪০ শতাংশ পস্নাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। বাকি ৬০ শতাংশকেও এর আওতায় আনতে হবে। এজন্য পস্নাস্টিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ওয়ার্কিং পেপার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। যে হারে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার হচ্ছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যে মূল্যবান বিভিন্ন খনিজের মজুত শেষ হয়ে যাবে। তবে পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এ বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশের বৃত্তাকার অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা আছে। দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা বাড়ছে। এই খাতকে শিল্প হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলে দেশের সার্কুলার ইকোনমির বিকাশ আরো গতিশীল হবে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি খুবই প্রশংসনীয়। শিল্পায়ননির্ভর অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিগত চার দশকে একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে আমাদের যে যাত্রা তার মূলে রয়েছে শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ, কিন্তু পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধির দিকে যাব কিনা, এখন তা নির্ধারণ করার সময় এসেছে। কেননা, সম্পদের অবক্ষয় শুধু আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কিংবা প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং ভবিষ্যতকেও চরম ঝুঁকিতে ফেলবে। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়, সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা ও সচেতনতা বাড়াতে আরো বিনিয়োগ করা জরুরি। সম্পদে পরিণত করতে বিশ্বে এখন এক শিল্পের বর্জ্য আরেক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি কোনো পণ্য ব্যবহারের পরও তা ব্যবহৃত হচ্ছে অন্য পণ্য তৈরির উপকরণ হিসেবে। এ প্রক্রিয়া সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত। টেকসই অর্থনীতির জন্য বাংলাদেশকেও বৃত্তাকার অর্থনীতির পথে যেতে হবে। সার্কুলার ইকোনমির সঠিক বাস্তবায়নে চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়ের জন্য অ্যাকাডেমিয়া, শিল্প খাত ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা প্রয়োজন। আমাদের শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। বিশেষ করে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প নানা সংস্কার, পরিবর্তন এবং রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক বাধা, বিপত্তি প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আমাদের গার্মেন্টস খাতকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশ সুরক্ষার দিকে সবাইকে আলাদা মনোযোগ দিতে হচ্ছে। গার্মেন্টসসামগ্রী ক্রেতা দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, গোষ্ঠী এখন গার্মেন্টস উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব নানা শর্ত আরোপ করছেন। যেসব শর্ত পূরণের মাধ্যমেই কেবল তাদের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। আর এজন্য এখন গার্মেন্টস শিল্পে কমপস্নায়েন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। অতীতে এ বিষয়টিকে এক প্রকার অগ্রাহ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে প্রতি বছর সুতা ও কাপড় ডাইং ও ওয়াশিংয়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি লিটার পানি খরচ হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, এত বিপুল পরিমাণ পানি দিয়ে ৬ লাখ অলিম্পিক সুইমিং পুল পূর্ণ রাখা সম্ভব। সমপরিমাণ পানি এক বছরে ৮ হাজার লোকের চাহিদা পূরণ করতে পারে। প্রতিটি জিন্স প্যান্ট যার ওজন প্রায় ১ কিলোগ্রাম, এমন একটি প্যান্ট ওয়াশিংয়ে আড়াইশ লিটার পানি ব্যবহৃত হয়। এই পানি কোনো কেমিক্যাল নয়, স্রেফ সাধারণ পানি- যা ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভয়াবহ মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এভাবেই বাড়ছে দিনে দিনে- যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে। সাধারণত ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে যখন এত বিশাল পরিমাণের পানি তোলা হয়, তখন সেখানে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এভাবে যত শূন্যতার সৃষ্টি হবে ততো ভূমি নিচের দিকে দেবে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বেশির ভাগ এলাকার পানির স্তর সুবিধাজনক এবং নিরাপদ অবস্থানে নেই। ফলে যে কোনো ধরনের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশের ওপর শিল্পের আরেকটি ক্ষতিকর প্রভাব হলো, কারখানার ব্যবহৃত পানি নদনদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়ে প্রাবাহিত হয়ে যায়। পোশাক কারখানার এই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ও রংমিশ্রিত পানি নদনদী, খাল-বিলের পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। যার ফলে নদনদী খাল-বিলের মাছ মারা যাচ্ছে, চাষাবাদে বিঘ্ন ঘটছে। এতে কৃষি উৎপাদনে প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে। এসব কারখানার প্রায় সবই ভূগর্ভস্থ উৎসের পানি ব্যবহার করে। এসব কারখানা যদি আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে পানির ব্যবহার চারভাগের এক ভাগও সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়, তবে তাতে কেমিক্যালের ব্যবহারের মাত্রা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে যতবেশি পানি থাকে, তা ফুটাতে তাপ প্রয়োগের জন্য বেশি পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করতে হয়। তাই পানির ব্যবহার কমাতে পারলে মহামূল্যবান জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসেরও সাশ্রয় হবে। শিল্প ও সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর উৎপাদন ও শিল্প উন্নয়নের পাশাপাশি ইকোসিস্টেমের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা অতীব প্রয়োজনীয়। চলমান কোভিড-১৯ মহামারি শুধু আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের মূলেই আঘাত করেনি, পরিবেশ নিয়ে আমাদের অর্জনগুলো ধরে রাখতে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব স্থাপনার বিভিন্ন নির্ণায়কের মধ্যে রয়েছে- টেকসই নির্মাণ ভূমি, জ্বালানি দক্ষতা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, নিরাপত্তা, পানি ব্যবহারের দক্ষতা, কর্মবান্ধব পরিবেশ, অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত মান, কারখানার অভ্যন্তরে বায়ুর মান, প্রযুক্তির ব্যবহার, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, দুর্ঘটনা মোকাবিলার সক্ষমতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। একটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে পানি, বিদু্যৎ, রং এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব উপায়ে হচ্ছে কিনা তা দেখা হয়। অধিকাংশ পোশাকশিল্প কারখানা ইটিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ইটিপির পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করছে- যা আমাদের সবুজ বিপস্নবেরই একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে অর্থায়নের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও করপোরেট গভর্ন্যান্স (ইএসজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের টেকসই ও স্বল্প কার্বনফুট প্রিন্টসম্পন্ন পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির নিত্যনতুন প্রতিশ্রম্নতি নিয়ে কনজুমারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি অন্যতম স্বল্প কার্বন নিঃসরণকারী দেশ, তথাপি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করছে। বাংলাদেশের রয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সোলার হোম সিস্টেম। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিজিএমইএ ইতোমধ্যে ইএনএফসিসির উদ্যোগ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি চার্টার ফর ক্লাইমেট অ্যাকশনে স্বাক্ষর করেছে- যার মাধ্যমে ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতের গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ৩০% কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সহজলভ্যতা নিশ্চিতে বিজিএমইএ এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (গ্রেডা) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। পোশাক শিল্পে সার্কুলার ফ্যাশন প্রণয়নে বিজিএমইএ, গেস্নাবাল অ্যাকশন এজেন্ডা, রিভার্স রিসোর্সেসের সঙ্গে সার্কুলার ফ্যাশন পার্টনারশিপ তৈরি করেছে, পিফোরজির অর্থায়নে এই উদ্যোগের মাধ্যমে পোশাক কারখানায় উৎপাদিত উচ্ছিষ্ট রিসাইকেলের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং এ বিষয়ে শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। এ ছাড়া বিজিএমইএ এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মেকিং ফ্যাশন সার্কুলার শীর্ষক নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশের শিল্পকারখানার মালিকরা এখন এসব বিষয়ে খুব সচেতন হচ্ছেন। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহী হয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। এরই মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান পানি ও গ্যাস সাশ্রয়ে ইতিবাচক ব্যবস্থা নিয়েছেন। পানি রি-সাইক্লিনিংয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার ফলে শতকরা ২৪ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় হয়। অন্যদিকে ৫০ শতাংশ পানির অপচয়ও কমে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে এক নীরব সবুজ বিপস্নব ঘটেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর ব্যাপক প্রচার হয়নি এখনো। ফলে, এটার ব্র্যান্ডিং হয়নি তেমনভাবে। বাংলাদেশ বর্তমানে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি স্থাপনে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএস জিবিসি) সনদপ্রাপ্ত ৬৭টি গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে ৭টি বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় বলা যায়। এছাড়া আরো প্রায় ২৮০টি কারখানা ইউএস জিবিসিতে নিবন্ধিত হয়েছে এবং আরো অনেক কারখানা পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরিতে রূপান্তর হওয়ায় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমাদের গার্মেন্টসশিল্প নানা সংস্কার, পরিবর্তন এবং রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক ক্ষেত্রে গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার বিকাশ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে যা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকসই অর্থনীতির জন্য গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার অনুসারী হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। যার চমৎকার ফলাফল ক্রমেই অর্থনীতিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইভাবে গার্মেন্টসশিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার পরিপূর্ণ বিকাশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে আরো এগিয়ে নেবে- আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। গ্রিন ফ্যাক্টরি কার্যক্রমকে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ ক্ষেত্রে চমৎকার গতির সঞ্চার হবে আশা করা যায়। রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক