শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশব্যাপী মাদকের ভয়াবহ বিস্তার

মাদকের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত হয়ে এই দেশ সত্যিকারভাবে ধ্যানে-জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে এই প্রত্যাশা আমাদের দেশ প্রেমিক সব মানুষের।
সুধীর বরণ মাঝি
  ২৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

জাতীয় দৈনিকে দেখলাম 'কমছেই না মাদকের বিস্তার।' এই সংবাদটি অবহেলার কোনো সুযোগ আছে বলে আমাদের সাধারণের মনে হয় না। সংবাদটি খুবই ভাবনার, অনেক বেশি চিন্তার এবং একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার। সমগ্র দেশের উন্নয়ন ও উন্নতির জন্য একটি অশনিসংকেতও। প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার মাদক বেচাকেনা হয়। যার অধিকাংশ ক্রেতাই শিক্ষত যুবক। দেশের সংঘটিত ৮০ শতাংশের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে মাদকের সংশ্লিটের প্রমাণ পাওয়া যায়। কাঁচা টাকা আর চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি রাতারাতি বিত্তশালী হওয়ার হাতছানির কারণেই মাদকের আগ্রাসন ও বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আর মাদকের এই বেচাকেনা রোধ করতে পারলে তার অর্থ দিয়ে দেশের সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে আসা যায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে দৃশ্যমান বৈষম্যের সমাধান সম্ভব। মাদকের এই ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে বৈকি কমবে না। মাদক আমদানি করে দেশের টাকাওয়ালা প্রভাবশালীরা আর এর গ্রাহক দেশের মধ্যবৃত্ত, নিম্নমধ্যবৃত্ত পরিবারগুলোর সাধারণ ছেলেমেয়েরা। মাদকের যে ভয়বহতা তা দেশের পুরো ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করে দিচ্ছে। হাতেগোনা কয়েকজন মাদককারবারির অতি লোভী মানসিকতার কারণে দেশের যুব সমাজ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গুটি কয়েক মাদককারবারি আর তাদের সহযোগীরা কি রাষ্ট্রের চেয়ে অধিক শক্তিশালী, অধিক ক্ষমতাধর? তাদের এই অপক্ষমতা আর অপশক্তি দেশের সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। আমরা মাদকমুক্ত সমাজ চাই, সোনার বাংলা গড়তে চাই।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অপারেশনস ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরুতেই শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে মাদক আইনে ৮৬ হাজার মামলায় প্রায় সাড়ে ১১ হাজার আসামি। এর মানে একই ব্যক্তি একাধিক মামলার আসামি। মাদক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দায়েককৃত ১৭ হাজারের বেশি মামলার আসামির সংখ্যা সাড়ে ১৮ হাজার। আর ভ্রাম্যমাণ আদালত ২৩ হাজারের বেশি অভিযান চালায়। সেখানে মামলা ও আসামির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১০ হাজার। এসব মামলায় কম সংখ্যক আসামির সাজা হয়েছে। মামলার সঙ্গে আসামির ব্যবধান প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু আমরা সাধারণ মামলার ক্ষেত্রে দেখি মামলার তুলনায় আসামির সংখ্যা বেশি। আর মাদকের মামলার ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো চিত্র। এখানে মামলা বেশি আর আসামি কম। এর মানে একই ব্যক্তি একধিক মামলার আসামি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিরোধ ও গবেষণা শাখার তথ্য মতে, দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা আড়াই কোটি। যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭.২%। এই সংখ্যাটি আমাদের জন্য খুবই ভয়াবহ এবং উদ্বেগের। মাদকের কারণে পারিবারিক ভাঙন, বিবাহ-বিচ্ছেদ, পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা, দুর্নীতি, ঘুষ, মুক্তিপণ, কিশোরগ্যাং কালচার, দখলদারিত্ব, প্রভাব বিস্তার প্রভৃতি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে দেশের শিক্ষা, শিক্ষারমান, শিক্ষার পরিবেশ, সামাজিক মর্যাদা, সামাজিক সম্পর্ক, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, পারিবারিক শিষ্টাচার, বিনিষ্ট হচ্ছে খেলাধুলার পরিবেশ, শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, পারিবারিক এবং সামাজিক বিকাশ। মাদককারবারিরা একটি অপকৌশল নিয়ে আগাচ্ছে। এরা দেশের যুব সমাজকে ধ্বংস করতে, শিক্ষা, সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে। যাতে তারা নির্বঘ্নে প্রতিবাদহীন একটি সমাজে তাদের দখলদারিত্ব, অবৈধ ব্যবসাবাণিজ্য, সিন্ডকেট ব্যবসা, নির্যাতন ইত্যাদি। মাদকসেবীরা চেতনাহীন আর মাদককারবারিরা নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বর্জিত শুধু টাকার নেশায় মত্ত। এরা আমাদের চেতনটাকে ধ্বংস করে একটা বর্বর জাতিকে পরিণত করতে চায়। এরা গাঁয়ে দেশপ্রেমের লেবাস লাগিয়ে চলে কিন্তু এরা সত্যিকার অর্থে দেশ বিরোধী, দেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত সর্বদা।

এই যদি হয় অবস্থা তাহলে আমরা কোথায় আছি। আমাদের পরিবার, ছেলেমেয়েরা সম্পূর্ণ অনিরাপদ অবস্থায় আছি। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য এই সংবাদ থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। এই থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এর পেছনের কারণ, উৎস খুঁজে বের করতে হবে। এদের হাত থেকে আমাদের সমাজটাকে, পরিবারটাকে, রাষ্ট্রটাকে বাঁচাতে হবে। তা না হলে একদিন আমরা আমাদের জাতীয় চেতনাকে হারিয়ে ফেলব। যে কোনো মূল্যে মাদকের এই ভয়াবহতাকে রোধ করতে হবে। দেশের প্রায় এক লাখ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি থাকলেও এগুলো প্রায় অকার্যকর এবং অনেকটাই কাগজে কলমে। রাষ্ট্রীয়, প্রশাসনিক প্রতিরোধের পাশাপাশি দুর্বার সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক সচেতনতা, পারিবারিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। মাদক প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সামাজিক ও পারিবারিক সচতেনতার কোনো বিকল্প নেই। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আরও বেশি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, দেশের জাতীয় চেতনায় জাগ্রত হয়ে কাজ করতে পারলে মাদক প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। মাদক অধিদপ্তরের নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য মাদক প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একটি বিরাট বাধা। যা দূর করা জরুরি। যে যে দেশগুলো থেকে আমাদের দেশে মাদক আমদানি করা হয় তাদের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক কৌশল পরিবর্তন এবং জোরদার করতে হবে। সীমান্ত এলাকাগুলো পাহারা আরও জোরদার করা এবং জিরো টর্লাযান্স নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। আইনজীবীদের নিজ পেশার প্রতি আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। যাতে তারা দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো মামলায় অংশগ্রহণ না করেন। আর যারা শুধুমাত্র টাকার জন্য কোনো মাদককারবারিদের পক্ষে আদালতে লড়েন তবে তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে মাদককারবারিরা মাদকের ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। কারণ তারা তখন দেখবে তাদের পক্ষে কেউ নেই। আর সহযোগিতা ছাড়া অবৈধ মাদক ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বেকার সমস্যা দূর করতে হবে, পর্যাপ্ত খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের আয়োজন রাখতে হবে। যাতে তরুণ এবং যুবসমাজ মাদকের আগ্রাসন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। মাদককারবারি আর তাদের সহযোগীদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। যদি সম্ভব হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাদককারবারি আর তাদের সহযোগীদের নামের তালিকা এবং ছবি প্রতিটি এলাকার জনবহুল মোড়ে মোড়ে টাঙিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে মাদকবিরোধী অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা মনে করি।

মাদকের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত হয়ে এই দেশ সত্যিকারভাবে ধ্যানে-জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে এই প্রত্যাশা আমাদের দেশ প্রেমিক সব মানুষের।

সুধীর বরণ মাঝি : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে