সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের ৭ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এবং এলিট ফোর্সের মানবাধিকার লঙ্ঘন ইসু্যতে ঝধহপঃরড়হ আরোপের পর কিছু দুষ্ট ও বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী চক্রের সাম্প্রতিক কার্যকলাপে আহত হয়ে উপরোক্ত শিরোনাম নিয়ে লিখতে বাধ্য হলাম।
ব্যক্তির দোষ কেন সমগ্র বাহিনীর ওপরে বর্তাবে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর (কু) কাজের মাশুল কি সমগ্র বাহিনীকেই দিতে হবে? যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত স্যাংশনের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে গুম ও খুনের বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডকে যে কোনো সভ্য সমাজ সমর্থন করবে না এটা হলফ করে বলতে পারি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি অতি সুশৃঙ্খল বাহিনী- যার প্রফেশনাল ক্যাপাবিলিটি নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে কি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন এমনি এমনি বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী থেকে লাখ লাখ অফিসার ও জওয়ান নিয়ে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র বা জাতিকে সাহায্য করত? আপনাদের কি তাই মনে হয়?
আমরা নিশ্চয়ই জানি যে, বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরেই খধৎমবংঃ চবধপব কববঢ়বৎ ফোর্স হিসেবে বিশ্বে তার সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকান্ড দ্বারা প্রফেশনাল ইমেজ বৃদ্ধি করে আসছে। এর ডাইরেক্ট / ইন্ডাইরেক্ট বেনিফিসারি কিন্তু আমার আপনার সোনার বাংলাদেশ।
এবার আসি এতে বাংলাদেশের কি কি লাভ হচ্ছে, তা নিয়ে একটু আলোচনা করি।
১। জাতীয় অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক রপ্তানি, বিদেশে কর্মরত এক কোটি বাংলাদেশি জনগণের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পরই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য কর্তৃক রেমিট্যান্স উলেস্নখযোগ্য। আজ আমাদের ৪২ বিলিয়ন ফরেন রিজার্ভ নিয়ে ফুটানি কিন্তু উপরোক্ত সেক্টর ত্রয়ের কর্মীদের ঐকান্তিক ফসল।
২। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সাফল্য পেলে যেভাবে বাংলাদেশের মান বৃদ্ধি পায়, সমভাবে পিসকিপারদের অবিরাম আত্মত্যাগের সাফল্যেও সমভাবে বাংলাদেশ বিশ্ববাসী মর্যাদার আসন নিশ্চিত করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র হোঁচট খেলেও
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জাতিসংঘ মিশনে অবদানের কারণে বাংলাদেশ বিদেশে একটি চবধপব খড়ারহম রাষ্ট্র হিসেবে ব্র্যান্ডেড হচ্ছে।
৩। ইৎধহফরহম ইধহমষধফবংয:
মালয়েশিয়া-ঞৎঁষু অংরধ. এই স্স্নোগানটি বিশ্বব্যাপী মালয়েশিয়ান সরকার ক্রমাগত ব্র্যান্ডিং করাতে কি উপকার পেয়েছে তা সবাই অবগত। টু্যরিজম সেক্টর, বিনিয়োগ, লেখাপড়ার জন্য সে দেশে বিশ্বের অনেক দেশ আগ্রহ প্রকাশ করাতে তারা তাদের অর্থনীতিকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছে, তা আমরা কতটুকুন অবগত?
দুঃখজনক হলেও সত্য, অমিত সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ভারত, মালয়েশিয়া, বা মালদ্বীপের ধারে কাছেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে চরমভাবে ব্যর্থ।
সরকার কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর, ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেনযোগে কক্সবাজার রেলপথ তথা ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল অবকাঠামো যতই নির্মাণ করুক না কেন, বাংলাদেশকে বর্তমান চলমান ধারায় ব্র্যান্ডিং করলে অর্থনৈতিকভাবে কতটুকু লাভবান হবে, তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলাদেশ কেন ভারত, মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপের মতন ব্র্যান্ডেড হচ্ছে না? এই ব্যর্থতা কি তবে রাষ্ট্রের নাকি রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের, নাকি সাচ্চা দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা / আমলাদের দূরদর্শিতার অভাব? এই চরম অসাফল্যের পেছনে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিতদের যোগ্যতা নিয়ে শঙ্কিত।
কেউ যদি এসব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন বা জবাবদিহিতা চেয়ে বসেন, তবে আমরা কি ধরনের উত্তর পাব, তা আমি আপনি কমবেশি সবাই অগ্রিম এই মুহূর্তেই বলে দিতে পারি। একটা উদাহরণই কাফি। কি সেটা?
জনভোগান্তির প্রশ্ন উঠলে ঢাকা শহরে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একে অন্যকে দোষারোপ কালচারটা আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে দেখে হতাশ।
এমতাবস্থায় এই সশস্ত্র বাহিনী যখন আমার দেশকে ক্রমাগত বিদেশে ব্র্যান্ডিং করছে, সেখানে স্যাংকশন ইসু্যতে আমরা কেন সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হব? দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রশ্নেই এই বিতর্ক কতোটা যৌক্তিক?
দেশের জনগণের প্রত্যাশার সবকিছুই এই সেনাবাহিনীর সব স্তরের সদস্য জানপ্রাণ দিয়ে করেছে। আজ যে আমরা মাওয়া হাইওয়েতে লং ড্রাইভে পদ্মা সেতু দেখতে যাই, হাতিরঝিলে মুক্তবাতাস খেতে যাই, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে সবক্ষেত্রে লাভবান হচ্ছি, জাতীয় দুর্যোগে জনগণের বিশ্বসহ সেবক হওয়ার গৌরবে গৌরবান্বিত, '৭১-এ ছোট ছোট দলে মুক্তিকামী বাঙালিকে প্রশিক্ষণের দ্বারা দেশ স্বাধীনে অবদান রেখেছি- তা তো আমার আপনার এবং বাংলাদেশি প্রতিটি জনগণের সেনাবাহিনীই করেছে। এটাও কি বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং এ সহায়ক নয়?
তাই জাতীয় স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কের বাইরে রাখব, নাকি নিজের গালে নিজেই জুতোপিটা করে নিজেকে অপদস্ত করব, তা আপনাদের বিবেকের ওপরই ছেড়ে দিয়ে আজ বিদায় নিচ্ছি।
একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে আমার এ মূল্যায়ন হোক রাজনৈতিক বিভাজনের আলোচনার বাইরে। হোক তা কেবলই দেশীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিকল্পে।
মেজর (অব.) ফেরদৌস : কলাম লেখক