পাঠক মত

সুন্দর থাকুক সুন্দরবন

প্রকাশ | ১৩ মার্চ ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। অপরূপ রূপে শোভিত সুন্দরবন বাহারি বৃক্ষ, নানান ধরনের পশু-পাখি, নদী-নালা, খাল-বিল আর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর প্রকৃতির এক মহাবিস্ময়। 'বৃক্ষ বিস্ময়' হিসেবে খ্যাত এই বন প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের এক অন্যতম আধার। এর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে এটিকে ৫২২তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ মিলে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বা ৬২ ভাগের মালিকানাই বাংলাদেশের। যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪.২ ভাগ এবং দেশের সমগ্র বনভূমির ৪৪ ভাগ। বিশাল এই বনভূমি বাংলাদেশের অস্তিত্ব, অর্থনীতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অন্যতম লীলাভূমি। তিন শতাধিক প্রজাতির বৃক্ষরাজি, হরেক জাতের মৎস্য, বন্য পশু-পাখি, নদী-নালা-খাল-বিল ইত্যাদি এই বনকে করেছে অনন্য ও অসীম। এই বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী। বনের প্রায় ৭৩ ভাগ বৃক্ষই সুন্দরী। সুন্দরী গাছের আধিক্য থাকায় একে সুন্দরবন নামে অভিহিত করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে সুন্দরী ছাড়াও গেওয়া, গরান, কেওড়াসহ নানা বৃক্ষ শোভিত এই বন। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ডি. প্রেইনের হিসাব মতে, সর্বমোট ২৪৫ শ্রেণি এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এই বনে। প্রাণী বৈচিত্র্যের দিক দিয়েও এই বন অনন্য। পৃথিবীবিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বসবাস এই বনে। যা এই বনকে করেছে বিশ্বময় আরও পরিচিত। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ, বানর, চিত্রা হরিণ; রয়েছে শিয়াল, শূকর, বন মহিষ, বন বিড়াল, উদ, সজারু, বন মোরগসহ হাজারো বন্যপ্রাণী। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, জীববৈচিত্র্যের আধার সুন্দরবন প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি, প্রায় ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছের আবাসস্থল। পুরো সুন্দরবনজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পরস্পর সংযুক্ত ৪০০-এর অধিক নদ-নদী, খাল-বিল; যা সুন্দরবনের প্রায় ৩১.২ শতাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এ সব নদ-নদী যেমন বাহারি মাছের বিচরণ ক্ষেত্র, তেমনি শুশক, কুমির, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক, ব্যাঙসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সুন্দরবনের অবদান অপরিসীম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে যেমন ঠিক তেমনি দেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই বনের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভর করে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ। সরকারের প্রায় ৪৫ ভাগ রাজস্ব আসে এই বন থেকে। এটি দেশের বনজ সম্পদের অন্যতম উৎস। খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিলস এবং হার্ডবোর্ড মিলস, উদ্ভিদনির্ভর অন্যান্য শিল্প-কারখানা যেমন- দিয়াশলাই ও নৌকা তৈরির কারখানার কাঁচামালসহ ঘরের ছাউনি তৈরির উপকরণ, কাঠজাত দ্রব্য, ভেষজ উদ্ভিদ, পশুখাদ্য, মধু এবং মোমের অন্যতম প্রধান উৎস ও যোগানদাতা এই বন। এই বনের জ্বালানি, নদীগুলোর বিশাল মৎস্য সম্পদ, মধু, মোম এবং বন্যপ্রাণী থেকে দেশের গড় বার্ষিক আয় প্রায় ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে অন্যতম ঢাল হিসেবেও কাজ করে সুন্দরবন। গবেষণার তথ্য মতে, এই বন প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয়- প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যভান্ডার, প্রকৃতির রক্ষাকবচ সুন্দরবন আজ ধ্বংসের মুখে। নানাভাবে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে গত ৪০ বছর ধরে নীরবে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবন। বন্যপ্রাণীসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ আজ বিলুপ্ত প্রায়। এই বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী এক অজানা রোগে আজ মরতে বসেছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় মিঠা পানির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এই অজানা রোগ দেখা দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সুন্দরী ছাড়াও এ বনে আছে আরও ৩৩৪ প্রজাতির বৃক্ষ। যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া যায় তবে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে এ বনের ৭৩ ভাগ ভূমিই গাছশূন্য হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ প্রকৃতির পাহারাদার রয়েল বেঙ্গল টাইগারও আজ অস্তিত্ব সংকটে। একটা সময় সুন্দরবনে অসংখ্য বাঘের বিচরণ ছিল। কিন্তু দিনে দিনে সে সংখ্যা কমে আসছে। ২০০৪ সালের হিসাব হতে এই বনে বাঘ ছিল প্রায় ৫০০টি। অথচ ২০১৫ সালের জরিপে বলছে, সে সংখ্যা এখন মাত্র ১০৬। অবৈধ শিকার, খাদ্যের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা কমছে। আর এই অবস্থা চলতে থাকলে একসময় সুন্দরবন বাঘশূন্য হয়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া অবাধে গাছ কাটা, অবৈধ হরিণ শিকার, বিষ দিয়ে মাছ নিধন ইত্যাদির মাধ্যমে সুন্দরবনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে কিছু অসাধু, অবিবেচক এবং বিবেকহীন মানুষ নামের কুচক্রীমহল। সুন্দরবনের চারপাশকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক তৎপরতাও বেড়ে গেছে অনেক। মোংলাসহ আশপাশের এলাকায় দ্রম্নত গড়ে উঠছে নানা শিল্প-কারখানা। মোংলা উপজেলার দুবলার চর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে দুবলার চর ও হিরণ পয়েন্টের মাঝখানে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু চরসহ নতুন জেগে ওঠা চরকে কেন্দ্র করে পর্যটন বাণিজ্যের পাঁয়তারা চালাচ্ছে একটি মহল। সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপাল বিদু্যৎকেন্দ্রের মতো ভারী অবকাঠামো নির্মাণও অব্যাহত রয়েছে। সুন্দরবনকে ঘিরে এ সব অপতৎপরতা এই বনের জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। অনেক সময় বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সুন্দরবনের মধ্যে গর্ত তৈরির জন্য সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই জায়গায় বর্ষাকালে মাছ আসে এবং সেগুলো তারা সংগ্রহ করে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করছে বড় বড় জাহাজ, লঞ্চ ও স্টিমার। এ সব যান্ত্রিক জলযানের ইঞ্জিনের বিকট শব্দ এবং হাইড্রোলিক হর্ন আতঙ্কিত করে তুলছে বন্যপ্রাণীদের। নৌযান থেকে নিঃসৃত তেল, মবিল ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে বনের মধ্যে। এতে দূষিত হচ্ছে বনের মাটি ও পানি। কখনো কখনো জাহাজ বা লঞ্চ দুর্ঘটনার ফলেও ক্ষতি হচ্ছে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের। এভাবে প্রতিনিয়ত সুন্দরবনকে তিলে তিলে ধ্বংস করা হচ্ছে। বিষ দিয়ে মাছ নিধনের ফলে মাছের ক্ষতি তো হচ্ছেই, সঙ্গে সঙ্গে কাঁকড়া শামুক-ঝিনুক, ব্যাঙসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। ফলে মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হচ্ছে পুরো সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম। ঘূর্ণিঝড়ের মতো বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে সুন্দরবন বাংলাদেশকে রক্ষা করে। অবদান রাখে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতেও। তাই সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক ও অপরিহার্য দায়িত্ব। সুন্দরবন রক্ষায় ব্যাপকহারে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ সরকারকে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতিমধ্যে সুন্দরবনের বনদসু্যদের একটি বড় অংশ আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। এ সব বনদসু্যরা যাতে পুনরায় তাদের পূর্বের কাজে ফিরে না যায়, তা তদারকির পাশাপাশি তাদের জন্য কর্মসংস্থান ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। যে সব অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় প্রভাবশালীরা সুন্দরবন ধ্বংসের অপতৎপরতায় লিপ্ত, তাদের চিহ্নিত করে চাকরি থেকে অব্যাহতিসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। চলমান রামপাল বিদু্যৎকেন্দ্র নিয়ে ইউনেস্কো ও পরিবেশবাদীদের আপত্তি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে এটি নির্মাণ করা হতে সরকারকে সরে আসতে হবে। বনের মধ্যদিয়ে বড় বড় লঞ্চ ও জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ করা গেলে বনে পশুপাখির চলাচল নির্বিঘ্ন হবে। 'বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন' সংস্কার করার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য যুগোপযোগী নতুন আইন করে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষজন জীবিকা অর্জনের জন্য সুন্দরবনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। এতে বনের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বনে মানুষের অবাধ ও ব্যাপক বিচরণের কারণে পশু-পাখি ও বন্যপ্রাণীরা যেমন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছে না, তেমনি বনের প্রাকৃতিক প্রজননও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই সুন্দরবনের উপর স্থানীয় মানুষের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে তা ইতিবাচক ফলাফল আনবে বলে আশা করা যায়। পৃথিবীর বৃহৎ তিনটি ম্যানগ্রোভ বনের একটি সুন্দরবন। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গর্ব। অথচ এটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য যে ধরনের উলেস্নখযোগ্য গবেষণার দরকার ছিল, তা দেখা যায় না। এ জন্য সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি, মৎস্য, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, পশু-পাখি, জলজ প্রাণী, মাটি, আবহাওয়া ইত্যাদি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা প্রয়োজন। যাতে গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে পরিকল্পিত ও লাগসই উপায়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করা যায়। এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাক্ষেত্র। এটি আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও অর্থনীতির অন্যতম ধারক ও বাহক। সুন্দরবন ধ্বংস মানে আমাদের প্রকৃতির অস্তিত্বকে গলা টিপে হত্যা করা; যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই সুন্দরবনের সৌন্দর্যকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের আরও সোচ্চার হতে হবে। মনিরুল হক রনি প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ সাভার সরকারি কলেজ, সাভার, ঢাকা