বাঙালির বর্ষবরণ
এই উৎসবটি শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করা হয়।
প্রকাশ | ১৪ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
কামরুজ্জামান তোতা
স্মরণাতীত কাল থেকে বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ দেশের লোকজ ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়ে আছে। বৈশাখী মেলা বা উৎসব এ দেশে বছরের সর্ববৃহৎ ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব এবং বাঙালি সংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা বর্ষপঞ্জি, দেশের উৎপাদনশীলতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। বর্ষপঞ্জিটি কৃষিচক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং এ সংযোগ এতই অবিচ্ছেদ্য যে, বাঙলা নববর্ষ 'ফসলি বর্ষ' বা 'ফসল বর্ষ' নামেও পরিচিত ছিল। এ উৎসবে কোনো ধর্মীয় প্রভাব নেই এবং এটা অবাধে সংস্কৃত ও ফার্সি-আরবি ঐতিহ্য থেকে গৃহীত। বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুল-ত্রম্নটি ও ব্যর্থতার গস্নানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় নববর্ষ। এদিন সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশের প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। এছাড়াও দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়।
এই উৎসবটি শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদ্?যাপন করা হয়।
বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টি মুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। মূলত কৃষি কাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। দিনে-দিনে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভূখন্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ।
বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বি.এস.সি.আই.সি), নজরুল একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। সেসব কর্মসূচিতে থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, বর্ণাঢ্য মিছিল, বৈশাখী মেলা ইত্যাদি। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন পহেলা বৈশাখের ওপর বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। এছাড়া সংবাদপত্রগুলোতে বঙ্গাব্দ, নববর্ষ ও বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধসহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। বাঙালির প্রিয় পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ দিনটি এপ্রিলের মাঝামাঝি পড়ে এবং সারা দেশে উৎসবের মাধ্যমে পালিত হয়। এই দিনটির শুরু হয় ইলিশ মাছ ও সবজি দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার মাধ্যমে অথবা চিড়া-গুড় ও দইয়ের নাস্তা দিয়ে। পুরুষ-নারী এবং শিশুরা নতুন কাপড় পরে বটের তলায় বা নদীর ধারে অনুষ্ঠিত মেলায় যায়। এসব মেলায় হরেক রকমের ব্যবহারিক জিনিসপত্র, বহু রকমের খাবার, মিষ্টি ও বাচ্চাদের খেলনা পাওায় যায়। সব শ্রেণির লোকদের আনন্দের জন্য থাকে নাগরদোলা, ঘোড়ায় চড়া, ভাগ্য পরীক্ষার খেলা, যাত্রা, পুতুলনাচ। সব ব্যবসায়ী দিনটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে এবং এদিন তারা হালখাতা খোলে। সৌভাগ্যের চিহ্নস্বরূপ হিন্দুরা এসব খাতায় সিঁদুর মাখিয়ে দেয়। শহর এলাকায়ও পয়লা বৈশাখ জনপ্রিয়। ঢাকায় দিনটি বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে গান-বাজনা, শোভাযাত্রা এবং মেলার মাধ্যমে পালন করা হয়। কোনো কোনো মেলা এক সপ্তাহ ধরে চলে। প্রায়ই দেখা যায় এ দিনটির শেষে প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড় এবং প্রচুর বৃষ্টি হয়। এ ঝড়ে জান-মালের ক্ষতিও হয়, তবে তা গ্রীষ্মের দাবদাহ একেবারেই কমিয়ে আনে।
করোনায় নববর্ষ উদযাপনের সব আয়োজন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল চীন, ধীরে ধীরে করোনা ছড়িয়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। আনন্দ-বিনোদনের সব আয়োজন গুটিয়ে ঘরবন্দি হয়েছে সব ধর্ম, বর্ণ, জাতির মানুষ। করোনাকে এড়িয়ে জীবন রক্ষার এটাই যে সবচেয়ে কার্যকর উপায়! সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক বিনোদনের বিভিন্ন আয়োজন থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানও হয়েছে স্থগিত, তিন দফায় বেড়েছে ছুটি, মসজিদ-মন্দিরসহ সব উপাসনালয়ে না গিয়ে সরকারি নির্দেশ মেনে ঘরেই উপাসনা শুরু করেছে ধর্মানুরাগী মানুষ। ১৪২৭/১৪২৮ সালকে সেই নিয়ম মেনেই বরণ করছে বাঙালি।
এবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের উদ্যোগে রমনার বটমূলে 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো' গেয়ে শুরু হবে নববর্ষ উদ্যাপন। চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রাও বের হবে। শহর-গ্রামের নানা প্রান্তে বসবে বৈশাখী মেলা।
বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক যুগের বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের মনোহরি চাকচিক্য বাড়লেও আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সময়ের 'নববর্ষ' উদ্যাপনে পান্তাভাত ও ইলিশ ভাজাসহ মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটালেও এতে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। ধনী ও বিলাসী মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র ও অসহায় মানুষের অন্তরে প্রকৃত সুখ আসে না। আধুনিক যুগের শহরের মানুষের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের কৃত্রিম নিবিড় পলস্নীর প্রীতিপূর্ণ ছোট ছোট উৎসব অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। শিল্পপতি, চাকরিজীবী ও টাকাওয়ালাদের উৎসবের গহ্বরে পিষ্ট বাঙালি কৃষকদের নববর্ষ উৎসব। অথচ বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়েছে বাঙালি কৃষকের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। বাংলা নববর্ষের মূল উৎস কৃষক ও কৃষি। বিশ্বায়নের বিভ্রান্তি থেকে নতুন প্রজন্মকে হতে হবে শেকড়সন্ধানী। তরুণ-যুব ও শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয় মূল্যবোধ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার চেতনা জাগ্রত করতে হবে। আঁকড়ে ধরতে হবে বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতিকে। বাহ্যিক চাকচিক্যময় কুরুচিপূর্ণ আগ্রাসী অপসংস্কৃতি আমাদের যুব ও তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করছে। নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে ভিনদেশি সংস্কৃতিতে মোহচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তাদের অপসংস্কৃতি হতে প্রতিহত করতে না পারলে প্রাণশক্তি হারিয়ে আমাদের জাতি কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে। তাই অপসংস্কৃতি প্রতিহত করতে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। উচ্চকিত করতে হবে মানবিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঙালি সংস্কৃতি। পরিহার করতে হবে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি। তাহলেই আমাদের বাঙালির 'নববর্ষ' উদ্যাপন সার্থক হবে। সার্থক হবে বৈসাবি উৎসব।
কামরুজ্জামান তোতা : কলাম লেখক