জাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি। এটি ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূলভিত্তি। জাকাত আরবি শব্দ। যার প্রধান দুটি অর্থ-পবিত্রকরণ এবং বৃদ্ধিকরণ। জাকাত আদায় করা হলে মানুষের ধন-সম্পদ থেকে গরিবের হক আদায় হয়। ফলে তা হালাল ও পবিত্র হয়। আবার জাকাতের মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্য দূর হয়, সমাজে দারিদ্র্যের হার কমতে থাকে এবং সচ্ছল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সে অর্থেই জাকাত অর্থ বৃদ্ধি করা। ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায়, নিজের ও পরিবারের সারা বছরের যাবতীয় প্রয়োজন ও ঋণ নির্বাহের পর সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অথবা সমপরিমাণ জাকাতযোগ্য সম্পদ কারও নিকট যদি পূর্ণ এক বছর পর্যন্ত সঞ্চিত থাকে, তবে তার চলিস্নশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা আড়াই টাকা হারে আলস্নাহর নির্দেশিত পথে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যয় করার বিধানকেই জাকাত বলা হয়। ইসলামী বিধানমতে, ধনী ব্যক্তিদের জাকাত আদায় করা অবশ্য কর্তব্য বা ফরজ। ইসলামে নামাজকে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমনি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জাকাতকে। পবিত্র কোরআনের ৮২ জায়গায় নামাজের এবং ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। আর ২৭ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের কথা একত্রে বলা হয়েছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তি জাকাত আদায় না করলে তার পরিণাম বা ফলাফল সম্পর্কেও পবিত্র কোরআনে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আলস্নাহতায়ালা বলেছেন- 'যারা স্বর্ণ ও রুপা জমা করে রাখে এবং ব্যয় করে না আলস্নাহর পথে, তাদের বেদনাদায়ক আজাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। (আর বলা হবে) এগুলো তাই, যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। সুতরাং এখন নিজেদের সঞ্চিত জিনিসের স্বাদ গ্রহণ করো।' (সুরা তাওবা, ৩৪-৩৫) এ সম্পর্কে পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, 'আলস্নাহ পাক যাকে অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন, সে যদি সে অর্থ-সম্পদের জাকাত প্রদান না করে, তাহলে তা কিয়ামতের দিন একটি বিষধর অজগরের রূপ ধারণ করবে, যার দু'চোখের উপর দুটি কালো চিহ্ন থাকবে। সে তাকে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার অর্থ-সম্পদ, আমিই তোমার সঞ্চয়।' (সহিহ বুখারি)
ইসলামে জাকাত ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে মূলত একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন করার জন্য। সমাজে ধনীদের হাতেই যাতে সম্পদ কুক্ষিগত না থাকে, যাতে একটি অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, কেউ পাঁচতলায় আর কেউ গাছ তলায় থাকার মনোবৃত্তি যাতে তৈরি না হয়, সে লক্ষ্যেই জাকাত প্রদানের হুকুম জারি হয়েছে। কারণ যদি সমাজের মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে যায়, তবে সেখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, বৃদ্ধি পাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অস্থিরতা। ফলে সমাজে সৃষ্টি হবে একটি ভারসাম্যহীন অবস্থা। সে কারণে ধনীদের উপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে। এটি ধনীদের কোনো দয়া বা অনুগ্রহ নয়। বরং ধনীদের থেকে গরিবদের প্রাপ্য অধিকার। সুরা আয-যারিয়াতে আলস্নাহ বলেন, 'তাদের অর্থাৎ ধনীদের ধন-সম্পদে অবশ্যই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।' (আয়াত-১৯)
কোন কোন সম্পদের জাকাত দিতে হবে, সে-সম্পর্কেও ইসলামের বিধান সুস্পষ্ট। যদি কোনো সম্পদশালী ব্যক্তির কাছে খাদ্যশস্য, গৃহপালিত গবাদিপশু, স্বর্ণ বা রৌপ্যজাতীয় মূল্যবান ধাতু, বাণিজ্যিক দ্রব্য, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকে, তবে তা থেকে নির্দিষ্ট হারে নির্দিষ্ট খাতে অবশ্যই জাকাত দিতে হবে। কোনো কোনো ব্যক্তি জাকাত পেতে পারে এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আলস্নাহ রব্বুল আলামীন ৮ (আট) শ্রেণির লোককে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, 'জাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আলস্নাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এই হলো আলস্নাহর নির্ধারিত বিধান। আলস্নাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।' (আত-তাওবা : ৬০)
জাকাত ব্যবস্থাই হলো বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সমাজের অসহায়, দরিদ্র, নিপীড়িত ও পিছিয়ে পড়া জনগণকে অভাব ও অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তি দিয়ে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী করার জন্য ইসলামে জাকাতের বিধান করা হয়েছে। তাই জাকাত হলো গরিবের সামাজিক নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি ও তাদের অর্থনৈতিক রক্ষাকবচ। সামাজিক সাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথই হচ্ছে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। এ পৃথিবীর সব কিছুর মালিক মহান আলস্নাহ। মানুষ তার প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর সব ধন-সম্পদ ভোগ করে মাত্র। এ সম্পর্কে আলস্নাহ বলেন- 'তুমি কি জানো না, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব ও আধিপত্য কেবল আলস্নাহরই, আর আলস্নাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক কিংবা সাহায্যকারী নেই।' (সুরা বাকারা, ১০৭) এই ভূমন্ডল সৃষ্টির পরে তিনি মানুষকে ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু,সাদা কালো ইত্যাদি শ্রণিতে ভাগ করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এটিও তার সৃষ্টির রহস্যের একটি। এর মাধ্যমে তিনি তার বান্দাকে পরীক্ষা করেন। কাউকে তিনি ধন-সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কাউকে দরিদ্র দিয়ে। ধনীদের পরীক্ষা করার জন্য জাকাত আলস্নাহর একটি উপলক্ষ মাত্র। এর মাধ্যমে সম্পদশালী ব্যক্তির আত্মার যেমন পরিশুদ্ধি আসে, তেমনি তার ধন-সম্পদ পবিত্র ও হালাল হয়। আর সমাজের অসহায়, ফকির, মিসকিন, দরিদ্ররা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পায়।
জাকাত প্রদানের খাত যেমন সুনির্দিষ্ট, তেমনি সুনির্দিষ্ট এর বণ্টন ব্যবস্থাও। জাকাতের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু গরিব-দুঃখীদের অভাব দূরীকরণের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন করা, তাই জাকাত যেন-তেনভাবে দিলে হবে না। দিলে সেটা হবে শুধু লোক দেখানো মাত্র। জাকাত এমনভাবে দিতে হবে যেন গ্রহীতার অভাব দূর হয়, সে স্বাবলম্বী হতে পারে। পরেরবার যাতে তাকে আবার সাহায্যের জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে না হয়। এ জন্য জাকাতের অর্থ শত শত, হাজার হাজার মানুষের মাঝে অল্প অল্প করে না দিয়ে নিজের বা পার্শ্ববর্তী এলাকার জাকাত পাওয়ার যোগ্য মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে টার্গেট করে বিতরণ করতে হবে। তাহলে সেটা হবে ফলপ্রসূ ও কার্যকর। জাকাতের মূল উদ্দেশ্যই হতে হবে স্থায়ীভাবে গ্রহীতার অভাব দূরীভূত করা এবং তাকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলা। উদাহরণস্বরূপ, জাকাত গ্রহীতা যদি রিকশা চালাতে পারে, তবে তাকে একটি রিকশা কিনে দেওয়া যেতে পারে, সে যদি সেলাই কাজ করতে জানে, তবে তাকে সেলাই মেশিন কিনে দেওয়া যেতে পারে, কাউকে চায়ের দোকান করে দেওয়া যেতে পারে, যে বা যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে চায়, তাদের কাঙ্ক্ষিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ এভাবে জাকাতের টাকা দিয়ে যদি গ্রহীতার একটি আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তবে সমাজের দারিদ্র্য নির্মূল হবে এবং টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। দেখা যাবে একসময় সমাজে একটি লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না জাকাত নেওয়ার জন্য। যেমনটি হয়েছিল খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের শাসনামলে। তার সময় আরব রাষ্ট্রে জাকাত গ্রহণের মতো কোনো দরিদ্র ব্যক্তি ছিল না। অথচ বর্তমান সমাজে জাকাত প্রদানের নামে চলছে প্রদর্শনের বিরাট মহড়া। জাকাতের নামে শত শত, হাজার হাজার মানুষকে জড়ো করে শাড়ি, লুঙ্গি বা কাপড় দেওয়ার যে সংস্কৃতি ধনীরা তৈরি করেছেন, তা ইসলামে সমর্থনযোগ্য নয়। ইসলামে জাকাতের শাড়ি, জাকাতের লুঙ্গি বা জাকাতের কাপড় বলে কোনো কিছু নেই। এগুলো বর্তমান সমাজের প্রদর্শন ইচ্ছুক ধনীদের নিজেদের জাহির করা, মিডিয়ায় প্রচার করা ও লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে না হয় জাকাত প্রদানকারীর জাকাত আদায়, না হয় গ্রহীতার অভাব মোচন। বরং এতে বাড়ে দরিদ্র-অসহায়দের দুর্ভোগ, বাড়ে পদপৃষ্ট হয়ে গরিবের আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনা। এ ধরনের জাকাতে দরিদ্রের ভাগ্যের পরিবর্তন তো হয়-ই না, পরিবর্তন হয় না সমাজের চিত্রও। তাই এ ধরনের লোক দেখানো জাকাত দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ ধরনের জাকাতে ইসলামের মূল উদ্দেশ্য ভূলুণ্ঠিত হয়। এটা স্মরণীয় যে, জাকাত কোনো রেওয়াজ নয়, এটা একজন ইমানদার বা মুমিনের ইমানের পরিচায়ক। এর মাধ্যমে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের যথাযথ ও সৌন্দর্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এ সম্পর্কে আলস্নাহতাআলা কোরআনে কারিমে বলেছেন, 'এরপর যদি তওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং জাকাত দেয়, তাহলে দ্বীনের সূত্রে তারা তোমাদের ভাই হবে।'(সুরা তওবা, ১১) জাকাত অস্বীকার করারও কোনো বিষয় নয়। জাকাত অস্বীকারকারীকে আলস্নাহ কাফির ও মুশরিক বলে অভিহিত করেছেন। পবিত্র কোরআনে আলস্নাহ বলেছেন, 'ধ্বংস সে সব মুশরিকদের জন্য, যারা জাকাত আদায় করে না এবং যারা পরকালে অবিশ্বাসী।' (সুরা হা-মীম সাজদাহ, ৬-৭) জাকাত ইসলামের মৌলিক ইবাদতের একটি। এটি বান্দার মন-মানসিকতা পরিশুদ্ধ করে সম্পদের মোহ ত্যাগ করার শিক্ষা দেয়। সাহায্য করে আলস্নাহর অনুগত ও প্রিয় বান্দা হতে। তাই শুধু লোক দেখানোর জন্য অনৈসলামিক ও অবৈজ্ঞানিক পন্থায় জাকাত না দিয়ে ইসলামের বিধান অনুযায়ী সঠিক নিয়মে, নির্দিষ্ট খাতে জাকাত দিলে জাকাতের উদ্দেশ্য যেমন সফল হবে তেমনি তা একটি বৈষম্যহীন টেকসই সাম্য ও ন্যায়ের সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
মনিরুল হক রনি
প্রভাষক
সমাজকর্ম বিভাগ
সাভার সরকারি কলেজ
সাভার, ঢাকা