শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে কেন শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হবে? তারাপদ আচার্য্য

উচ্চ খাদ্যমূল্যের কারণে এখন শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশ প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে দাম বেড়ে গেলেও মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ শতাংশে ধরে রাখতে পেরেছে।
নতুনধারা
  ১৯ মে ২০২২, ০০:০০

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেমে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা তাদের ৭৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। ডলার সংকটে আমদানি করতে না পারায় প্রতিদিন দীর্ঘ সময় লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের। লাইনে দাঁড়িয়েও পাওয়া যাচ্ছে না জ্বালানি তেল। কাগজের অভাবে পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ রেখেছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শিক্ষিত জনসংখ্যার দেশটি। প্রস্তুতি ছাড়াই 'অর্গানিক ফার্মিং' চালু করায় কৃষি উৎপাদন ধসে যাওয়ায় ভয়াবহ খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে। এই জটিল অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে নেওয়া অপরিকল্পিত বিদেশি ঋণ। বাছবিচার না করে দ্বিপক্ষীয়ভাবে ধার নেওয়া ও তা শোধ করতে না পারায় এখন দেউলিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে একসময়ের দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা।

শ্রীলঙ্কার এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশের নামও উঠে আসছে। এর কারণ বাংলাদেশেও শ্রীলঙ্কার মতো অবকাঠামো খাতে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বিদেশি ঋণে বাস্তবায়ন চলছে। সতর্কতার কারণে এমন আলোচনা উঠলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তুলনা চলে না। একসময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা অগ্রসর অর্থনীতির দেশ থাকলেও সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের সক্ষমতার একটি বড় উদাহরণ। এর বাইরে বাংলাদেশে যেসব প্রকল্প চালু রয়েছে, তার বড় অংশই বহুপাক্ষিক ঋণে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব ঋণ একদিকে যেমন দীর্ঘমেয়াদি অন্যদিকে এর সুদের হারও নমনীয়। আর প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই যে লাভজনক হবে সে সমীক্ষা করেই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স পরিস্থিতিও শ্রীলঙ্কার তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। দেশের প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনও সন্তোষজনক। তবে অলাভজনক বা কম প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ নিয়ে দেশকে সতর্ক হতে বলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। প্রকল্প ঋণের জন্য কোনো একক দেশ বা সংস্থার ওপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের ভালো রিজার্ভ রয়েছে। রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স বাড়ছে। অপ্রয়োজনীয় বা কম প্রয়োজনীয় কোনো প্রকল্পও নেওয়া হচ্ছে না। ঋণ ব্যবস্থাপনাও ভালো। তাই বাংলাদেশের অবস্থা কখনোই শ্রীলঙ্কা হবে না।

তা ছাড়া বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এক রকম দেশ নয়। শ্রীলঙ্কা একটি ছোট দেশ, ছোট ভূখন্ড। ওদের অর্থনীতি মূলত পর্যটননির্ভর। বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈচিত্র্যময়। তাছাড়া শ্রীলঙ্কাতে যেটা ঘটেছে, সেটা বাংলাদেশে হঠাৎ করে ঘটার কোনো আশঙ্কা নেই।

শ্রীলঙ্কায় তামিল গেরিলা ও সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব এবং পরে সেখানে নানা ধরনের দুর্নীতির কারণে অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। করোনার সময় পর্যটন খাত বড় ধরনের বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেশটি আজকের অবস্থানে নেমে এসেছে।তবে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কার এই আর্থিক দেউলিয়াত্বের ঝুঁকি হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। ২০০৭ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়েই হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কলম্বোয় সমুদ্রবন্দরের কাছে চাইনিজ সিটি নির্মাণ, রাজাপাকসে বিমানবন্দর নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে একের পর এক সার্বভৌম বন্ড ছেড়েছে। এ ছাড়াও চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছে। এসব প্রকল্পের বেশির ভাগই পরবর্তীকালে লাভজনক বিবেচিত হয়নি। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে দ্রম্নত রিজার্ভ কমে গেছে। চীন থেকে নেওয়া বড় অঙ্কের ঋণ পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে দেশটি। চলতি বছর ঋণ পরিশোধের জন্য শ্রীলঙ্কাকে আরও ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করতে হবে। কিন্তু এখন দেশটির হাতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের।

অপরদিকে বর্তমানে বাংলাদেশের হাতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার- যা দিয়ে ৭-৮ মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে সর্বোচ্চ এক মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বেশি স্থিতিশীল। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার শ্রীলঙ্কার পাঁচ গুণ। বর্তমানে দেশের জিডিপির আকার হচ্ছে ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। আর শ্রীলঙ্কার জিডিপির আকার হচ্ছে ৮১ বিলিয়ন ডলার।

শ্রীলঙ্কার দুরবস্থার অন্যতম কারণ হলো, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া। এতে দেশটির বৈদেশিক ঋণের জন্য উচ্চ হারে সুদ গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের ভারিত (ওয়েটেড) গড় সুদহার ৮ শতাংশের বেশি। অথচ বিদেশি ঋণে বাংলাদেশের এ সুদহার ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

ঋণের ফাঁদে পড়ে দেউলিয়ার মুখে থাকা শ্রীলঙ্কার মুদ্রার মানও ধারাবাহিকভাবে কমছে। কিছুদিন আগেও এক ডলারে শ্রীলঙ্কার ১৯০ রুপি পাওয়া যেত। অথচ গত দুই মাসে সেটা বেড়ে ৩১৫ রুপি ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই টাকার মান ধরে রাখতে পেরেছে। বর্তমানে ১ ডলারের বিপরীতে ৮৬ দশমিক ২ টাকা পাওয়া যেত। যদিও বর্তমানে টাকার মান কমে গেছে। দেশে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। খোলা বাজারে এক ডলারের বিপরীতে ১০০ থেকে ১০৪ টাকা।

উচ্চ খাদ্যমূল্যের কারণে এখন শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশ প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে দাম বেড়ে গেলেও মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ শতাংশে ধরে রাখতে পেরেছে।

শ্রীলঙ্কায় নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পতন ঘটেছে রাজাপাকসে সরকারের। আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি, পরিকল্পনাহীন ও অপ্রয়োজনীয় বিলাসবহুল প্রকল্প, ঋণের জট, রিজার্ভ সংকটসহ সরকারের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। আমাদের সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই।

তারাপদ আচার্য্য : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে