এমন 'বীর'দের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া হোক

আমরা মো. বাবুকে দেখছি একজন ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে। কিন্তু সেই বাবু যে সমাজের ড্রাইভার হতে পারে তা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? এই ধরনের মানুষ কি কখনো এলাকার চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেয়ে সমাজের সেবা করার সুযোগ পাবে?

প্রকাশ | ২০ মে ২০২২, ০০:০০

ড. আশেক মাহমুদ
করোনাকালীন দুর্যোগ অতিক্রম করে দেশের মানুষ এবার ফিরে পেল সেই চিরচেনা ঈদ। নিজ পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী সবার সঙ্গে ঈদ করার এই সুযোগ সমাজকে দিয়েছে নতুন এক প্রাণ। ঈদ হয়েছে অনেকটা সামাজিক বন্ধনের মালা গেঁথে। এটা অনন্য এক সামাজিকতা। এই সামাজিকতার মান প্রায়ই ধূসর হয়ে যায় কতগুলো ঘটনা দুর্ঘটনার কারণে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, পরিবহণ ভাড়ার উচ্চহার, সড়ক পথে প্রাণহানি, চাঁদাবাজি আর সামাজিক নিরাপত্তার অভাব সামাজিক শান্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এসব নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা তো আছেই। তবু বলতে হয়, একটা ভালো সংবাদ হতে পারে সামাজিক অগ্রগতির প্রাণ। কুড়িয়ে পাওয়া ২৫ লাখ টাকা মালিককে ফিরিয়ে দিলেন ট্রাকচালক মো. বাবু। গত ৭ মে তারিখের পত্রিকার মাধ্যমে সংবাদটি জানার পরে ভাবলাম, ঘুণে ধরা এই সমাজে এত উন্নত মহানুভব আচরণ কি করে সম্ভব? মো. বাবুর বাড়ি নাটোর, বয়স ২৮, টগবগে তরুণ, পেশায় ট্রাক ড্রাইভার। ট্রাক চালিয়ে দিনে তার আয় ৬০০ টাকা, এর মানে মাসে ১৮ হাজার টাকা। মাত্র এক বছর আগে সে বিয়ে করে। বিয়ের পর সংসারের উন্নতি নিয়ে সবাইকে চিন্তাক্লিষ্ট থাকতে হয়। সেই বাবু ২৫ লাখ টাকা নিয়ে বড় কোনো স্বপ্ন দেখতে পারতেন। অথচ লোভের সড়কে পা না দিয়ে বাবুর চিন্তা টাকার মালিককে ঘিরে। কীভাবে মালিকের কাছে টাকা ফিরিয়ে দেয়া যায় সে চিন্তায় অস্থির ছিলেন বাবু। মহাসড়কে ২৫ লাখ টাকার ব্যাগ পেয়ে লোভ সামলানো অন্তত আমাদের সমাজে শুধু বিরলই নয়, প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। অথচ মো. বাবু ট্রাকের মালিক মো. শাহনেওয়াজকে সঙ্গে নিয়ে টাকার ব্যাগ জমা দেন নাটোর সদর থানায়। থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি নির্দেশে গাজীপুর ও নাটোর পুলিশ অনুসন্ধান চালিয়ে টাকার প্রকৃত মালিকের সন্ধান পান। টাকার ব্যাগের মালিক ব্যবসায়ী লিটন মিয়া। টাকার ব্যাগ পেয়ে অতি আনন্দে কেঁদে ফেলেন। মালিক মো. বাবুকে ৩০ হাজার টাকা বকশিশ দিতে গেলে ফিরিয়ে দেন এই বলে যে, '২৫ লাখ টাকাই যখন ফেরত দিলাম, তখন ৩০ হাজার কেন নেব?' ঘটনাটা সিনেমার কোন কাহিনী নয়, বাস্তব। সিনেমায় এ ধরনের ঘটনাকে নায়কের মহানুভব চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়। নাটকে দেখানো হয় আরেকটু ভিন্নভাবে। যেমন, কেউ পথে টাকার ব্যাগ পেয়েছে কিন্তু মালিককে খুঁজে পাচ্ছে না। পরে চিন্তা করল, টাকার ব্যাগ থানায় জমা দেবে। পরক্ষণেই ভাবল, না! থানায় জমা দিলে সব টাকাই যদি পুলিশ খেয়ে ফেলে? এই চিন্তায় নায়ক টাকার ব্যাগ নিয়ে মালিককে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। অথচ নাটক সিনেমার সব গল্প পেরিয়ে মো. বাবু হয়েছেন এই সমাজের নায়ক। এই নায়ক কোনো উচ্চ ডিগ্রিধারী কেউ নন, এই নায়ক উচ্চবিত্তেরও কেউ নন, এই নায়ক মালিকশ্রেণির কেউ নন, এই নায়ক শ্রমিকশ্রেণির মধ্য থেকে উঠে আসা অনন্য পুরুষ। যে সমাজে বলা হয় শিক্ষিত না হলে মানুষ হবে কীভাবে! সেই সমাজে শিক্ষিতদের মধ্যে বিত্তশালী হওয়ার প্রতিযোগিতা এক সাধারণ ব্যাপার। নগর কেন্দ্রিক সমাজ জীবন ভোগবাদীতে আচ্ছন্ন, এখানে 'মানুষ' পাওয়া দুষ্কর, সবাই কম বেশি স্বার্থপর! অথচ অর্থবিত্তের প্রভাব আর উচ্চ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েও মো. বাবু কি করে নির্লোভ আর কঠিন প্রকৃতির সৎ মানুষে পরিণত হলেন, আর কেমন করে ট্রাক চালক বাবু এই সমাজের নায়ক হলেন? তা নিয়ে অনুসন্ধানী গবেষণা প্রয়োজন। যে সমাজে উচ্চশিক্ষিতদের অধিকাংশ লোভের রোগে আক্রান্ত, দুর্নীতিতে অফিসপাড়া ভারাক্রান্ত; সেই সমাজে বাবুর সততা আমাদের সমাজের প্রাণ। যে সমাজে উচ্চশিক্ষা শুধু বেকারত্ব ঘোচানোর মাধ্যম নয়, বরং পুঁজির মাত্রা বাড়ানোর হাতিয়ার; যে সমাজে শিক্ষার সার্টিফিকেট দিয়ে সামাজিক মর্যাদা ক্রয় করা হয়, আর শিক্ষার সার্টিফিকেট থেকে বঞ্চিতদের মর্যাদাহীন মনে করা হয়, আর শিক্ষাকে ভোগধর্মী সমাজ নির্মাণের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয়- সেই সমাজে বাবুর মত মানুষ কি করে সমাজের নায়কে পরিণত হলো? এই নিয়ে আমাদের ভাবনা অতি প্রয়োজন। আমাদের তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত আর অফিসারদের জন্য এখানে রয়েছে অনন্য এক শিক্ষা। আমরা মো. বাবুকে দেখছি একজন ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে। কিন্তু সেই বাবু যে সমাজের ড্রাইভার হতে পারে তা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? এই ধরনের মানুষ কি কখনো এলাকার চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেয়ে সমাজের সেবা করার সুযোগ পাবে? এই ধরনের নায়ককে কি কখনো ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব দেয়া হবে? মুস্তাফিজের মতো বিশ্বমানের ক্রিকেটারকে আমরা প্রান্তিক অঞ্চল থেকে খুঁজে পেয়েছি। ঠিক তেমনি সমাজের সেবার জন্য সরকারও বাবুর মতো অসম্ভব সৎ মানুষকে সমাজ সেবার দায়িত্বে নিয়োগ দিতে পারে। কেননা, মো. বাবু শ্রেণি চেতনা (পষধংং পড়হংপরড়ঁংহবংং) দিয়ে চলেন না, তিনি বস্তুবাদী নন। তিনি তথাকথিত অফিসারদের মতো লাফ দিয়ে টাকার বৃক্ষে উঠতে চান না। তিনি চান মানুষের কল্যাণ। এই ঘটনা থেকে শেখার অনেক কিছুই আছে। পুলিশপাড়ায় ভালো পুলিশও আছে, অফিসপাড়ায় সৎ অফিসারও আছে, শিক্ষকদের মাঝে ত্যাগী শিক্ষকও আছে, মালিকশ্রেণির মধ্যে কিছু ভালো মালিকও আছে, আর শ্রমিকদের মধ্যে অভাব থাকলেও মো. বাবুর মতো নির্লোভ বীর মানুষও আছে। কেননা, এ সমাজে সেই বড় বীর যে লোভের তলোয়ারকে সততা দিয়ে পরাস্ত করতে পারে। সে কারণে, এ সব নির্লোভ বীরদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পুরস্কার দেয়া জরুরি। আমি সরকারের কাছে জোর দাবি তুলছি, ট্রাক চালক মো. বাবু, ট্রাকের মালিক মো. শাহনেওয়াজ ও থানার ওসিসহ অনুসন্ধানকারী পুলিশ সদস্যদের সততা আর দায়িত্বশীলতার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিরল সম্মাননা পুরস্কার দেয়া হোক। তাদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কার প্রদান করে সব টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায় প্রচারের ব্যবস্থা করা হোক। সঙ্গে সঙ্গে সৎ অফিসারদের প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করলে এই সমাজ প্রাণ ফিরে পাবে। এই দেশে এমন বাবুদের হাতেই পরিচালিত হোক আগামীর ভবিষ্যৎ- এই প্রত্যাশা আমাদের সবার। ড. আশেক মাহমুদ : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা