বগুড়া-সিরাজগঞ্জ নতুন রেলপথ ডুয়েলগেজ নয়, ডাবল লাইন নির্মাণ জরুরি

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে রেল যোগাযোগকে প্রাধান্য দেওয়ার বিকল্প নেই। স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি মহলের চক্রান্তে রেল ব্যবস্থাকে উন্নত করার বদলে একে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকার সেই অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে রেল ব্যবস্থার আধুনিকায়নের ওপর জোর দিয়েছে।

প্রকাশ | ২৩ মে ২০২২, ০০:০০

এম রেজাউল করিম
ঈদ এসে চলে গেল। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দু'টি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ঈদুল ফিতর অন্যতম। প্রতি বছর এই ঈদে সারাদেশে প্রায় কোটিখানেক মানুষ আপনজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে যান কর্মস্থল থেকে। বিগত দু'টি বছর করোনা অতিমারির কারণে অনেক মানুষ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আপন জনদের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়িতে যেতে পারেননি। এবার পরিস্থিতি অনেক উন্নতি হওয়ায় রেকর্ডসংখ্যক মানুষ ট্রেন, বাস, লঞ্চ ও বিমানসহ অন্যান্য মাধ্যমে কর্মস্থল ত্যাগ করে প্রিয়জনের কাছে ছুটে গেছেন। এর মধ্যে ঢাকা থেকেই গেছেন সিংহভাগ মানুষ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়। কিন্তু, এই ঈদযাত্রা তাদের কী প্রশান্তিময় হয়েছে? না, ট্রেনের টিকেট বিড়ম্বনা, মহাসড়কসমূহের খানাখন্দ এবং চলমান নির্মাণকাজের কারণে তীব্র যানজট এবং নদীপথে লঞ্চের সংখ্যাসল্পতা ঘরমুখো মানুষকে মহাদুর্যোগে ফেলে দিয়েছে। পত্রপত্রিকার খবরেও প্রকাশ আগের মতো ভয়াবহ যানজট না থাকলেও ঘরমুখো যাত্রীদের অনেক রাত পর্যন্ত জ্যামে আটকে থাকতে হয়েছে। বর্তমান সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় এ বছর ৩০/৪০ কিলোমিটার পথ জুড়ে যানজট না হলেও মানুষের দুর্ভোগ কিন্তু সে পরিমাণে কমেনি। বিশেষ করে অধিকতর নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ট্রেনে যাতায়াতের সুফল মানুষ ঘরে তুলতে পারেনি। এর মধ্যে আবার উত্তরাঞ্চলের ট্রেন যাত্রীরা বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এ পথে চলাচলকারী রংপুর ও লালমনি এক্সপ্রেস বগুড়া হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করে। এছাড়া পঞ্চগড়, একতা, চিলাহাটি, দ্রম্নতযান এবং কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস পার্বতীপুর হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করে। এ ট্রেনগুলো কখনোই নির্ধারিত সময়ে ছাড়তে এবং পৌঁছাতে পারে না। বিলম্বে ছাড়া ও পৌঁছানোর কারণগুলো মধ্যে রয়েছে: দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ওই একই ট্রেনের ফিরে আসার মান্ধাতা আমলের ব্যবস্থা চালু রাখা, লক্কড়-ঝক্কড় বগী ও ইঞ্জিন সংযোজন, একমুখী ব্রডগেজ লাইনের সীমাবদ্ধতা, 'রেললাইন' ও 'স্স্নিপার' সমান্তরালকরণ ও সংস্কারে দীর্ঘসূত্রিতা এবং পরিশেষে লাইন ক্লিয়ার দেওয়ার ক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চলের ট্রেনগুলোকে কম গুরুত্বদানের মানসিকতা। অভিযোগ রয়েছে যে, দেশে কোনো নতুন ইঞ্জিন বা বগী আমদানি করা হলে প্রথমে সেগুলো পূর্বাঞ্চলে ব্যবহারের পর তা উত্তরাঞ্চলে স্থানান্তর করা হয়। ফলে উত্তরাঞ্চলবাসীর কখনোই আনকোড়া নতুন বগীতে চড়ার সুভাগ্য হয় না। ট্রেনে ভ্রমণকালে লক্ষ্য করা যায়, চলন্ত ট্রেনে এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যেতে কিংবা টয়লেট ব্যবহার করতে গেলে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে যাত্রীদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয় কিংবা টয়লেটের 'লোহার কলে' মাথা ঠুকে যায়। কত যুগ আগে রেল 'স্স্নিপার' এবং 'লাইনগুলো' সমান্তরালের কাজ করা হয়েছে- তা কেউ জানে না। ট্রেনের ঘটাং ঘটাং আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড ঝাঁকুনি করে বন্ধ হবে তা ভবিতব্যই বলতে পারে। শুধু তাই নয়, অতি মাত্রায় এই ঝাঁকুনির ফলে যে কোনো সময় ট্রেন উল্টে গিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। ট্রেনে ভ্রমণকালে কয়েক দফায় লক্ষ্য করা গেছে যে, র্দীঘ ১০/১২ ঘণ্টা ধরে মোটামুটি সঠিক সময়ে কমলাপুর স্টেশনে ঢোকার রুহূর্তে আকস্মিকভাবে ট্রেন থেমে যায়। পরে ২০/৩০ মিনিট অপেক্ষার পর লাইন ক্লিয়ার পেয়ে পস্ন্যাটফর্মে প্রবেশ করে। অপর দিকে প্রায় সময়েই পস্ন্যাটফর্মে ঢোকার মাত্র ৫/৭ মিনিট আগে 'ডিসপেস্ন বোর্ডে' পস্ন্যাটফর্ম নম্বর দেওয়া হয়। ফলে সংক্ষিপ্ত সময় পাওয়ায় যাত্রীরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করে নিজেদের আসন খুঁজে পেতে হয়রানির শিকার হন। রাজধানী শহরের প্রথম শ্রেণির স্টেশন হওয়া সত্ত্বেও এবং এখানে পর্যাপ্ত লাইন সংলগ্ন পস্ন্যাটফর্ম থাকলেও কেন এত গাফিলতি তার ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট কেউ দিতে পারেননি। আরো দেখা গেছে, কমলাপুর স্টেশনে ঢাকার বাইরে গমনেচ্ছু যাত্রীদের ২০ টাকার বিনিময়ে যে ট্রলিগুলো দেওয়া হয় সেগুলোর সামনের চাকা ঘোরে না। অভিযোগ আছে- গুদামে ভালো ট্রলি থাকলেও সেগুলো বস্তাবন্দি করে রাখা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের ট্রেনগুলোর দুরাবস্থার কথা সরকারি পর্যায়ে স্বীকৃত হওয়ায় তা নিরসনে নানান উদ্যোগ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সম্প্রতি (২৩ এপ্রিল) বগুড়া রেলস্টেশনে সাংবাদিকদের জানান, জাতীয় নির্বাচনের আগেই শেষ হবে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণকাজ। প্রায় ৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৬ কিলোমিটার 'মেইন লাইন' এবং ১৬ কিলোমিটার 'লুপ লাইন' নির্মিত হলে বগুড়া থেকে ঢাকার দূরত্ব কমবে ১২০ কিলোমিটার। আর এতে সময় কমবে ৩ (তিন) ঘণ্টা। এতে ভারত সরকার ঋণ দেবে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। বাকি টাকার সংস্থান করবে বাংলাদেশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের এই নতুন রেলপথ নির্মিত হলে উত্তরাঞ্চলের ৯টি জেলার মানুষের অনেক উপকার হবে সন্দেহ নেই। তবে, বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, একটি রেলপথ নির্মাণ করা হয়ে থাকে সাধারণভাবে ১৫০/২০০ বছরের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিষয় বিবেচনা করে। সেখানে এমনিতেই পিছিয়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করে 'ডুয়েল গেজ' নয়, 'ডাবল লাইন' স্থাপন করাই যুক্তিযুক্ত ছিল। এখনো যেহেতু 'ভূমি অধিগ্রহণের' কাজ শুরু হয়নি সেহেতু বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে 'ডাবল লাইন' স্থাপন করা উচিত। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে রেল যোগাযোগকে প্রাধান্য দেওয়ার বিকল্প নেই। স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি মহলের চক্রান্তে রেল ব্যবস্থাকে উন্নত করার বদলে একে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকার সেই অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে রেল ব্যবস্থার আধুনিকায়নের ওপর জোর দিয়েছে। \হগত মাসের শেষাংশে ব্যক্তিগত কাজে লালমনির এক্সপ্রেসে গাইবান্ধা গিয়েছিলাম। যাত্রাপথে খেয়াল করে দেখেছি- প্রায় প্রত্যেক স্টেশনে পস্ন্যাটফর্ম এবং ওপরে মানসম্মত ছাউনি নির্মাণকাজ চলছে জোরেশোরে। উন্নয়নের গতি সচল রয়েছে- এটাই বড় কথা নয়। লালমনিরহাট রেলের বিভাগীয় প্রকৌশলী জানালেন, তার বিভাগে ৮টি স্টেশনে এবং পাকশী রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী জানালেন, তার বিভাগে ১৪টি স্টেশনে পস্ন্যাটফর্ম ও শেড নির্মাণকাজ চলছে। সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে উপসংহারে তাই বলা অতু্যক্তি হবে না যে, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার সঠিক সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের যে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা যথোচিত এবং এর মাধ্যমে দেশ সমৃদ্ধির মহাসড়কে দ্ব্যর্থহীনভাবে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। এম রেজাউল করিম : কলাম লেখক