বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ অভিযান ও আগামীর বিশ্ব

রাশিয়া জয়লাভ করলে বিশ্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের পেট্রো-ডলারের কর্তৃত্ব শেষ হবে। রাশিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ইরান ও তুরস্কসহ আরও কয়েকটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হবে। মিসর ও সৌদি আরবসহ আরও কিছু দেশও পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে পারে। ইসরাইলের বাড়াবাড়ি হ্রাস পাবে। আফ্রো-এশিয়ার প্রাক্তন কলোনিগুলোর উপরে ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশের নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ হ্রাস পাবে। একাধিক শক্তির উত্থানের কারণে বিশ্ব ব্যবস্থায় একটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য আসবে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জি এম কামরুল ইসলাম, এসপিপি
  ২৪ মে ২০২২, ০০:০০

সূচনা : বিশ্ব যুদ্ধোত্তর শীতল/স্নায়ুযুদ্ধ যুদ্ধের সময় আমেরিকা ও তার মিত্ররা ন্যাটো আর রাশিয়া মিত্রদের নিয়ে ও'য়াশ প্যাক্ট করে নিজেদের নিরাপত্তা এবং প্রভাব বলয় বৃদ্ধির চেষ্টা করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার ফলে ও'য়াশ প্যাক্টের স্বভাবিক মৃতু্য হলেও ন্যাটো প্যাক্ট কার্যকর থেকে প্রভাব বলয় বিস্তৃতি এবং রাশিয়াকে দাবিয়ে রাখার কাজ চালু রাখে। এই অবস্থায় রাশিয়া আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্থান ও তাজিকিস্তানকে নিয়ে সমন্বিত নিরাপত্তা ট্রিটি সংস্থা (ঈড়ষষবপঃরাব ঝবপঁৎরঃু ঞৎবধঃু ঙৎমধহরুধঃরড়হ-ঈঝঞঙ) তৈরি করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। সার্বিয়া, চায়না, কিউবা, ইরান ও উজবেকিস্তান ঈঝঞঙ-র অবজারভার সদস্য। কিন্তু ন্যাটোর আগ্রাসী কর্মকান্ডে সৃষ্ট নিরাপত্তা হুমকির কারণে রাশিয়া কিছু আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে যার সর্বশেষ হলো ২৪ ফেব্রম্নয়ারিতে ইউক্রেনের 'বিশেষ সামরিক অভিযান'।

কেন এই আক্রমণ :এখন প্রশ্ন হতে পারে নিজের নিরাপত্তার কথা বলে একটি দেশ (রাশিয়া) আর একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আক্রমণ/দখল করতে পারে কিনা? স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিতে অনেক কিছু বলা গেলেও বাস্তবতা হলো বিশ্ব ব্যবস্থায় নিজেদের বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে সব সময়ই একটি দেশ অপর একটি দেশে আক্রমণ বা আগ্রাসন চালিয়ে থাকে এবং আমেরিকা, ফ্রান্স, পর্তুগিজ, ইতালি ও ন্যাটোসহ পশ্চিমারা তা আরও কঠিন, কঠোর এবং নির্মমভাবে প্রয়োগ করে থাকে। এই কারণেই অতীতে যেমন মরক্কো, তিউনিশিয়া ও কঙ্গোসহ আফ্রো-এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার বহু দেশ ও সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে তেমনি সম্প্রতি ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেন ধ্বংস হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র্র আর যুক্তরাজ্যের প্রত্যক্ষ মদতে প্যালেস্টইনিদের উপর ইহুদিবাদী ইসরাইলের ক্রমাগত দীর্ঘদিনের অমানবিক কর্মকান্ড, জমি দখল আর সীমাহীন ধ্বংসযজ্ঞের করুণ কাহিনীতো আছে। তাই বলা যায় যথাযথ প্রস্তুতি বা ভবিষ্যৎ চিন্তায় না নিয়ে ইউক্রেনের অতিউৎসাহী কার্যক্রম বিশেষ করে ন্যাটো জোটে যোগদানের চেষ্টা রাশিয়াকে এই আক্রমণ করতে বাধ্য করেছে।

২০১০ থেকে ২০২১ সাল অবধি মূলত ডনবাস, লুটেন্সক, ক্রিমিয়া, মারাইউপোল এবং আরও কিছু শহরে সীমাবদ্ধ রুশ ভাষাভাষী এবং ইউক্রেনিয়ান নাগরিকদের মধ্যে একটা গৃহযুদ্ধ চলছিল যাকে জাতিগত নিধন অপারেশনও বলা যেতে পারে। ২য় মহাযুদ্ধে হিটলারের সময়ের ইন্সিগ্নিয়া ব্যবহার করে তার ইহুদিযজ্ঞের ন্যায় একই ছক, একই পস্ন্যান, একই সিস্টেমে স্পেশাল ফোর্স আজব ব্যাটালিয়ান রুশ ভাষাভাষী এবং রাশিয়ার প্রতি সহোনাভূত নাগরিকদের নির্বিচারে গুম ও হত্যা করেছে। ছোট ছোট ইউক্রেনিয়ান বাচ্চাদেরকে স্কুল-কলেজে শিক্ষা দেয়া হতো যাতে তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে, রাশিয়া ইউক্রেনের শত্রম্ন। এই ৮ বছরের নিধনযঞ্জে ইউরোপিয়ান কোনো দেশ, বা পশ্চিমারা কোনো প্রকারের প্রতিবাদ ও প্রতিকারতো করেইনি বরং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তাদের মিত্ররা ইউক্রেনকে ক্রমাগত আর্থিক সাহাজ্য-সহযোগিতা দিয়েছে। এ সময় প্রতিটি প্রেসিডেন্টের (ভিক্টোর ইউনিকোভিচ, ওলেক্সান্দার টুরচিউনোভ, পেট্রো প্রোসেঙ্কো এবং বর্তমান জেলেনেস্কী) স্ট্রাটেজি ছিল এক ও অভিন্ন। তা হলো 'রাশিয়ান স্পিকিং নাগরিক বা রাশিয়ার প্রতি ইনক্লাইনেশন আছে এমন ইউক্রেনিয়ান নাগরিক কিংবা দাম্পত্য জীবনে মিক্সড রাশিয়ান নাগরিকদেরকে নিধন করা'।

আর এবার সেই যুদ্ধ শুরু হয়েছে গোটা দেশ জুড়ে।

ন্যাটো ও পশ্চিমা শক্তির সম্পৃক্ততা : এবার একটু অন্যদিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। যুদ্ধটা হচ্ছে ইউক্রেনে যে কিনা ইউই বা ন্যাটোর সদস্য নয়। অথচ ইউই এবং ন্যাটো যুদ্ধটাকে নিজের যুদ্ধ মনে করে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু তারা ইউক্রেনকে গত ১৪ বছর ধরে আশা দিয়েও ইউই বা ন্যাটো তাকে কোনো সদস্যপদ দিতে নারাজ ছিল। তাহলে হঠাৎ করে সবাই ইউক্রেনের জন্য এতো উঠেপড়ে লাগল কেন? কার কি স্বার্থ আছে এখানে? যে পরিমাণ ডলার আর অস্ত্র ইউক্রেনে এ যাবত দেওয়া হয়েছে তা কার কাছে যাচ্ছে, কে কীভাবে ব্যবহার করছে তা কিন্তু ফলোআপ হচ্ছে না। অথচ এই পরিমাণ অর্থ যদি যুদ্ধের আগে ইউক্রেনকে দেওয়া হতো, তাহলে ইউক্রেন ধনী দেশসমূহের মধ্যে একটা হয়ে যেত। তাই প্রশ্ন আসে এই অশ্রম্ন আর অর্থ কি রাশিয়াকে ধ্বংস করার জন্যে দেওয়া হচ্ছে?

যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের জৈব এবং রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবসা

দীর্ঘদিন থেকে শোনা যাচ্ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ পশ্চিমারা ইউক্রেনে মারাত্মক জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করেছে। সম্প্রতি কানাডার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ট্রেভর জন কাদিয়ের মারিউপোলের আজভস্টাল কারখানা থেকে পালানোর সময় রাশিয়ার সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি সেখানকার একটি জৈব ও রাসায়নিক গবেষণাগারে একটি মারাত্মক ভাইরাস তৈরির দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির জামাতা ক্রিস্টোফার হেইঞ্জ ইউক্রেনে ২৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে ২০টির বেশি জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্রের কারাখানা পরিচালনা করে। সেখানে আরও বিদেশি সৈন্য ও বিদেশি এজেন্ট ছিল। এটাও ইউক্রেনকে সহযোগিতা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

ইউই-এর স্বার্থের সংঘাত : তাছাড়া জ্বালানিসহ কিছু ইসু্যতে ইতোমধ্যে ইউই-তে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলসহ জ্বালানি ব্যতীত জার্মানিসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশই অচল। তাই হাঙ্গেরি কিন্তু তুরস্ক, লিথুনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়াকে চাপের মধ্যে রেখেছে। তাছাড়া শত্রম্ন দেশগুলোকে রুবলে মূল্য শোধের রাশিয়ার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে প্রথমে জার্মানিসহ ইউই-র অধিকাংশ দেশ শক্ত অবস্থান নিয়েও পরবর্তীতে কম্প্রোমাইজ করতে বাধ্য হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও তারা বিকল্প হিসেবে আরব দেশসহ আফ্রিকা থেকে তেল-গ্যাস ও জ্বালানি সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেনে একদিকে ডলারের মান হুমকির মুখে পড়েছে এবং অন্যদিকে রুবল শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ রাশিয়া অর্থনৈতিক যুদ্ধে ইতোমধ্যে জয়লাভ করেছে।

নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা :রাশিয়াকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো হাজার হাজার অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েও কোনো কিছু করতে পারছে না। ইইউ শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে যে, রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা কোনো কাজে আসেনি। রাশিয়ার রুবলকে দুর্বল করার জন্য সুইফট থেকে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কেটে দেওয়া হয়েছিল। তখন বাধ্য হয়ে অন্যরা সুইফটের বাইরে গিয়ে রাশিয়ার শর্ত মেনে নিয়েই রুবলে তাদের লেনদেন করতে বাধ্য হয়েছে। যেই রুবল যুদ্ধের আগে ছিল ১ ডলার= ৭২ এখন সেই রুবল চলে এসেছে ১ ডলার= ৬৭। অথচ নিষেধাজ্ঞার ঠিক পরপরই ১ ডলারের সমান ছিল ১৩৯ রুবল। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এখন ডলারের চেয়ে বেশি প্রবাহ হচ্ছে রুবলের। এভাবে চলতে থাকলে পেট্রো-ডলারের নির্ভরতা অনেক কমে ডলার তার শক্তিশালী অবস্থা হারাবে, ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের আধিপত্যতা হারাবে, চীন, দুবাই ও আরব দেশগুলোসহ অন্যরাও হয় রাশিয়ান রুবল, বা চীনের আরএমবি, অথবা নিজস্ব কারেন্সিতে লেনদেন করা শুরু করবে।

ডলারের প্রাধান্য খর্ব নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের ৪৪টি দেশ ব্রেটন উডস অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ডলারকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে রাখতে একমত হলে ডলারের আধিপত্য শুরু। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭১ সালে ঘোষণা করলেন, স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য নির্ধারিত না করার ঘোষণা এবং ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের সাথে পেট্রো ডলার চুক্তির মাধ্যমে ডলারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়। আমেরিকার মাল্টিন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান সাচি সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ১৯২০ সালের দিকে ব্রিটিশ পাউন্ড তাদের আধিপত্য হারানোর আগে যে ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল এখন আমেরিকান ডলারের ক্ষেত্রেও সেটি হচ্ছে।

ধীরে ধীরে ডলারের একচেটিয়া অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। কারণ রাজনৈতিক স্বার্থে ডলারকে ক্রমাগত মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারে অনেক দেশ এখন ত্যক্ত-বিরক্ত। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া পর্যন্ত সবার ডলার-রিজার্ভ ইচ্ছেমতো আটকে দিচ্ছে, তাতে মধ্যপন্থী দেশগুলোর ভেতরও ভয় ঢুকেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ভীতিকে কাজে লাগিয়ে ডলার আধিপত্যের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে চায় বিভিন্ন দেশ। রাশিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তান এমনকি ভারত ও সৌদিআরবও এই প্রতিরোধের শরিক। তাই এ যুদ্ধের ফলাফলে এখন আর কেবল ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নয় বরং বৈশ্বিক পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, তারও নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এ যুদ্ধের ফায়সালা হবে সমরবিদদের হাতে নয়, অর্থনীতিবিদদের দ্বারা।

ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোতে যোগদান প্রসঙ্গ : ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রেক্ষাপটে উত্তর ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটোতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বা নিচ্ছে। ন্যাটোর সচিবালয় থেকেও পরিষ্কার বলা হয়েছে যে দেশ দুটি সদস্যপদের আবেদন করলে যত দ্রম্নত সম্ভব তা অনুমোদনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অনুমোদনের জন্য ন্যাটোর বর্তমান ৩০টি দেশের প্রত্যেকেরই সম্মতি প্রয়োজন। তাদের ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে ইউই দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি তুরস্কের আপত্তি আছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গ্রিসের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন যে, ১৯৫২ সালে ন্যাটোতে গ্রিসের সদস্যপদ সমর্থন করে তুরস্ক যে ভুল করেছিল সে ভুল তিনি আর করতে চান না। কূটনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন, বিশেষ করে সুইডেন বেশ কয়েক বছর ধরে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী পিকেকে ও কুর্দিস্থানে সিরিয়ার মিলিশিয়া গ্রম্নপ ওয়াইপিজিকে অনৈতিকভাবে সমর্থন যুগিয়ে আসছে। তাই তুরস্কের মতে এই দুই দেশ সন্ত্রাসীদের সরাইখানা। এই সরাইখানাতে সন্ত্রাসীদের আপ্যায়ন করা হয়, থাকার ব্যবস্থা হয়, অর্থের যোগান দেওয়া হয়। তাই তুরস্ক এই দুই দেশের ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে ভেটো দেবে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে আধুনিক ফাইটার জেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেওয়ার মুলা ঝুলিয়ে কাজটি সারতে চাইবে। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দিলে রাশিয়ার কি ক্ষতি? রাশিয়ার সাথে লাটভিয়া, লিথুনিয়া, এস্তোনিয়ার কমন বর্ডার আছে এবং তারা ন্যাটোর সদস্যই। রাশিয়াকে সাইজ করার জন্য ন্যাটো ইচ্ছে করলেই এই তিন দেশে মারাত্মক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারত। কিন্তু করে নাই কেন? সুইডেনের সাথে রাশিয়ার শুধু ম্যারিটাইম বর্ডার। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক খারাপ করলে সুইডেনেরই সমস্যা হবে। ফিনল্যান্ডের ব্যাপারটা আলাদা। ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধান ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে গণভোট করতে চায় না। কিন্তু জনগণ ভোট চাচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। তবে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে রাশিয়া বলেছে যে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তারা (যে কেউ) ন্যাটোতে যোগ দিলে আপত্তি নেই এবং কখনো নিরাপত্তার হুমকি হলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। তারা ইতোমধ্যে ফিনল্যান্ড সীমান্তে শক্তিশালী ইসকেন্দার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়ে দিয়েছে।

রাশিয়াকে ভুল মূল্যায়ন : আমেরিকা ও তার মিত্ররা বার বার ভুলে যাচ্ছে যে, রাশিয়া কোনোভাবেই প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। ভস্নাদিমির পুতিনের রাশিয়া বর্তমান বিশ্বের একমাত্র সামগ্রিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র। বর্তমান রাশিয়া খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা, জ্বালানি, সামরিক সরঞ্জাম, ইত্যাদির পাশাপাশি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বিশ্বের বৃহৎ রপ্তানিকারক একটি দেশ। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার উপর পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হয়ে উল্টো সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতি ও জীবন-যাপনকে চরম সংকটে ফেলে দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ যদি অনেক দীর্ঘায়িত হয় তাহলে আমেরিকা ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সামগ্রিক অর্থনীতি চরম দুরবস্থার মধ্যে যাওয়ার সম্ভাবনা ফুটে উঠেছে।

দীর্ঘায়িত যুদ্ধ এবং বিশ্বের দুঃখ-কষ্ট : আমেরিকা ও ইউইসহ পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে অর্থ ও অস্ত্রসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করার ফলে যুদ্ধ শুধু দীর্ঘায়িতই হচ্ছে না বরং একদিকে ইউক্রেন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অপরদিকে সমগ্র বিশ্ব খাদ্য ও জ্বালানিসহ চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। তাই এই যুদ্ধ যত দ্রম্নত শেষ করা যায় বিশ্বের জন্যে ততই মঙ্গল।

পশ্চিমাদের মিডিয়া ও ক্রীড়া শক্তির ব্যবহার বনাম রাশিয়ার ধৈর্য ও মানবিকতার যুদ্ধ : এই যুদ্ধে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব তাদের শক্তিশালী মিডিয়া ও ক্রীড়া (ফিফা ও অলিম্পিক এসোসিয়েশনসহ সকল ক্রীড়া সংস্থা) শক্তিকে রাশিয়ার বিপক্ষে সর্বাত্মকভাবে ব্যবহার করছে। পশ্চিমা মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদের মাধ্যমে প্রতিদিন ইউক্রেনকে জয়ী এবং রাশিয়াকে পরাজিত করছে, তারা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে যুদ্ধবীর বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু তাদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে বলা যায় যে এখনো পর্যন্ত রাশিয়া শুধু এগিয়েই নেই বরং তারা সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সংযম নিয়ে খুবই মানবিকতার সাথে (যুদ্ধের মধ্যেও বেসামরিক লোকদের জানমালের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা রক্ষা করে) এই যুদ্ধ পরিচালনা করছে। তারা মাত্রাতিরিক্ত শক্তি, অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমানসহ ক্ষেপণাস্ত্র, ইত্যাদির কোনোটাই ব্যবহার করেনি। সাধারণ মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া এবং বেসামরিক জানমালের নিরাপত্তার জন্যে নিজেদের ক্ষতি স্বীকার করেও সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে। এমন কি ইউক্রেনের সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটি মারিওপোলেও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ না চালিয়ে সুনাম ও ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন আবরোধের পর দখল নিয়ে আহত আজব সেনাদের চিকিৎসা নিশ্চিত এবং বাকিদের নিরাপদ বন্দি করে মানবতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। চেচেন কমান্ডার রমজান কাদির প্রতিরোধকারী সৈনিকদেরসহ সম্পূর্ণ স্টিল কারখানাটি ধ্বংস করে দিতে চাইলে পুতিন অনুমোদন দেননি। এখানে তথাকথিত পশ্চিমা মানবতাবাদী যে কোনো দেশ থাকলে কি করত তা চিন্তা করা যায়? কৃষ্ণসাগর উপকূলবর্তী খেরসন অঞ্চলটি ক্রিমিয়া অঞ্চলের সঙ্গে ইউক্রেনের পূর্বের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলগুলোর সংযোগের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তা দখল করে মেয়র নিয়োগপূর্বক সেখানকার আঞ্চলিক দপ্তরগুলোতে নিজস্ব প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে রুশ টেলিভিশন ও বেতার সম্প্রচার শুরু করেছে। তারা সেখানে ০১ মে থেকে ইউক্রেইনীয় মুদ্রা হিভ্রনিয়ার সঙ্গে রুশ মুদ্রা চালু করেছে। তবে ৪ মাসের মধ্যে খোরাসানে পুরোপুরি রুশ মুদ্রার প্রচলন হবে।

তথাকথিত মুক্ত বিশ্বের মানবতাবাদীদের দ্বিমুখিতার উন্মোচিত : এই যুদ্ধের ফলে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বসহ তথাকথিত গণতান্ত্রিক মুক্ত বিশ্ব ও মানবতাবাদীদের দ্বিমুখিতা চরমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ষাট লাখ সাদা চামড়ার ইউরোপীয় বাস্তুহারা/শরণার্থীদের কষ্টের মাধ্যমে তারা সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়ামেন, লেবানন, মিয়ানমার ও প্যালেস্টাইনসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের লাখক্ষ-কোটি কালো মানুষের যন্ত্রণার কিছুটা আঁচ পেয়েছে।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ : ইতোমধ্যে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে জ্বালানি ও খাদ্যসহ যে অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক সংকট শুরু হয়েছে তা আরও প্রলম্বিত ও চরম আকার ধারণ করতে পারে। ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার মানুষকে চরম মূল্য দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা : আমার মতো অনেকের মনে আর একটা প্রশ্ন আসতে পারে যে, এই যুদ্ধে আমেরিকার স্বার্থ কি? আমেরিকা ন্যাটোর সদস্য হলেও ইইউ সদস্য নয়। তবে এই যুদ্ধে তারা এত বেশি সংশ্লিষ্ট হচ্ছে কেন? তারা কি ইউক্রেনকে ভালোবেসে এত টাকা-পয়সা, এত অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে? আমরা লয়েড অস্টিনের সর্বশেষ বক্তব্য বিশ্লেষণ করি তবে তাদের স্বার্থ এবং সংশ্লিষ্টতা পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি বলেছেন যে, 'আমরা রাশিয়াকে অতটাই দুর্বল দেখতে চাই যতটা হলে রাশিয়া আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না'। আর ঠিক এই বক্তব্যটাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও আগ্রহের কারণ। তাছাড়া তারা এখানে অস্ত্র বিক্রির ব্যবসায়িক সুযোগও পেয়েছে। যতদিন এই যুদ্ধটা থাকবে, অস্ত্র বিক্রির বাজারও ততদিন থাকবে। কারণ রাশিয়ার সাথে বর্ডারিং দেশগুলো নিরাপত্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে খাবারের থেকে বেশি অস্ত্র কিনতে আগ্রহী হবে। এখানে আরেকটা বিষয় আছে। সেটা হলো, রাশিয়ার সঙ্গে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে আমেরিকাতো রাশিয়ার সঙ্গেই যুদ্ধ করছে, কিন্তু যুদ্ধটা নিজের দেশের মধ্যে নয় আবার রাশিয়াকে সরাসরি আক্রমণ করতেও হলো না। পেন্টাগন স্বীকার করেছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্যে তারা জার্মানিতে ইউক্রেনের অনেক নাগরিককে মিলিটারি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। অন্যদিকে আমেরিকা রাশিয়ার তেল, গ্যাস কিংবা অন্যান্য কমোডিটির উপরেও ততটা নির্ভরশীল নয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট একচ্ছত্র ২২ বছর ক্ষমতায় থাকাতে একদিকে চিরশত্রম্ন রাশিয়া শক্তিশালী হচ্ছে অপরদিকে রিজিম পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, যা পশ্চিমাদের জন্য একটা বড় মাথাব্যথার কারণ। আর এই যুদ্ধের মাধ্যমে যদি সেটা অর্জিত হয়, খারাপ কি? তাহলে এমন একটা যুদ্ধ আমেরিকা থামাতে যাবে কেন? ইউক্রেন ঠিক সেই ট্রাপটাতে পা দিয়েছে যেই ট্র্যাপটা রাশিয়া দিয়েছিল আফগানিস্তান যুদ্ধে।

অবাধ অস্ত্র প্রবাহের ভবিষ্যৎ : ইউক্রেনে অজস্র অস্ত্র প্রবাহ একটা সময়ে বুমেরাং হতে পারে। আফগানিস্তানে যেসব অস্ত্র আমেরিকা ফেলে এসেছিল বা সরবরাহ করেছিল, ওইসব অস্ত্র শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানের মিলিশিয়ারা আমেরিকার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে শুরু করলে তারা কোনো বিকল্প ছাড়াই তড়িঘড়ি করে তাদের আফগানিস্তান ছেড়ে আসতে হয়েছিল। তাই আমেরিকাসহ ইইউ-এর দেশগুলোকে সবকিছুই মাত্রার মধ্যে করতে হবে।

বিভক্ত বিশ্ব : আমেরিকাসহ পশ্চিমারা কূটনৈতিকভাবে রাশিয়াকে কোণঠাসা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। শেষ বিচারে চীন, ভারত, বাংলাদেশসহ আফ্রো-এশিয়ান ও আরব দেশগুলো কিন্তু এখনো রাশিয়ার বিরুদ্ধে যায়নি। অনেকে আবার খুব ট্যাক্টফুলি ভোটদান থেকে বিরত থেকে এটাই প্রমাণ করেছে যে, অন্তত তারা পশ্চিমাদের সিদ্ধান্তের সাথে একমত নয়। চীন, ভারত, আফ্রিকা কিংবা অন্যান্য এশিয়ান দেশের কি স্বার্থ তা বিস্তারিত না বললেও বোঝা যায় যে, তাদের ইউক্রেনের চেয়ে রাশিয়াকে প্রয়োজন বেশি।

উপসংহার : ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি। এ যুদ্ধে ইউক্রেন ধ্বংস হবে এবং এক পক্ষের জয় আর অপর পক্ষের পরাজয় হবে। আমেরিকা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার স্বার্থে সবকিছু করবে। যদি তারা জিততে পারে তবে রাশিয়ার শক্তি ও শত্রম্নতা অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ হবে। পরবর্তীতে চীনসহ অন্যদের সায়েস্তা করতে সুবিধা হবে। আমেরিকা তার মিত্রদের নিয়ে বিশ্বকে ইচ্ছেমত শাসন ও শোষণ করবে।

রাশিয়া জয়লাভ করলে বিশ্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের পেট্রো-ডলারের কর্তৃত্ব শেষ হবে। রাশিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ইরান ও তুরস্কসহ আরও কয়েকটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হবে। মিসর ও সৌদি আরবসহ আরও কিছু দেশও পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে পারে। ইসরাইলের বাড়াবাড়ি হ্রাস পাবে। আফ্রো-এশিয়ার প্রাক্তন কলোনিগুলোর উপরে ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশের নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ হ্রাস পাবে। একাধিক শক্তির উত্থানের কারণে বিশ্ব ব্যবস্থায় একটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য আসবে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জি এম কামরুল ইসলাম : এসপিপি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও সমাজকর্মী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে