শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাউন্সিলিংয়ের বিকল্প নেই

প্রকাশ | ২৯ মে ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
করোনা মহামারিতে হঠাৎ করেই বেড়েছে আত্মহত্যা। করোনায় মৃতু্যর সংখ্যাকেও ছাপিয়ে গেছে আত্মহত্যায় মৃতু্যর সংখ্যা। শুধু বয়স্ক নারী-পুরুষ নয়, অল্পবয়সি কিশোর-কিশোরী এমনকি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এককালে মানুষ আত্মহত্যা করত অন্যের জীবন রক্ষার জন্য, কখনো শোকের কারণে, কেউবা ধর্ষণের জন্য লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে। শিল্পবিপস্নবের চতুর্থ পর্যায়ের দ্বারপ্রান্তে এসে আমাদের জীবনধারা ও বোধ একেবারেই আগের মতো নেই। কিন্তু আত্মহত্যা কখনো থামেনি। বরং আরও বেড়েছে পত্রিকায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়। বর্তমানে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে হতাশা ও মানসিক চাপ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই হতাশার পেছনে আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থা দায়ী। এ ছাড়া আরও অনেক কারণ যেমন-জীবিকার জন্য চাকরি না পাওয়া, সম্পর্কে ভাঙন, অপমান সহ্য করতে না পারা, পরীক্ষায় ফেল করা, সাইবার বুলিং-এর শিকার, তর্ক-বিবাদ, পরিবারে আর্থিক অনটনসহ ক্ষেত্র বিশেষে পারিপার্শ্বিক নানান কারণে তরুণরা আত্মহত্যা করছে। এ ছাড়া সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহ, মাদক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন ফিকে হয়ে আসার মতো কারণগুলো প্রকট আকার ধারণ করায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। তাছাড়া নৈতিক স্খলন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, বস্ন্যাকমেইলিং অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তরুণদের আত্মহত্যাপ্রবণতা বাড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখন অনলাইনভিত্তিক মিডিয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেটভিত্তিক নানা ভিডিও বা বস্নগে আত্মহত্যার বিবরণটির সঙ্গে এই কাজটির বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করায় কেউ কেউ। আঁচলের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের মধ্যে বেশি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আত্মহত্যা করা ১০১ জনের মধ্যে ৬২ জন অর্থাৎ ৬১ দশমিক ৩৯ শতাংশই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একই সময়ে মেডিকেল কলেজ ও অনার্স কলেজের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। আর এই সংখ্যাটি মোট আত্মহত্যাকারীর ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা সংখ্যায় ২৩। আঁচল ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। দেখা গেছে, ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই বয়সসীমার ৬০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ২৭ জন। আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি থেকে আমাদের উত্তরণ পেতে হলে পরিবারে বাড়াতে হবে ধর্মীয় ও নৈতিকতার চর্চা, মাকে খেয়াল রাখতে হবে সন্তান বাসা থেকে বের হয়, কখন ফেরে, রুমে কি করে। এ ছাড়া বাবা-মায়ের খোঁজ রাখতে হবে ছেলেমেয়েরা কোথায় যায়, কি করে, কার সঙ্গে মেশে বা তার বন্ধু-বান্ধবরা কেমন প্রকৃতির। দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজ আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দায় এড়াতে পারে না। আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে- একজন শিক্ষার্থী কেন আত্মহনন করেছে সে বিষয়টি জানতে হবে এবং নিয়মিত শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা জানার চেষ্টা করতে হবে এবং তা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য ও গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হবে, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক কাজের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। শুধু তাই নয়- রাষ্ট্রও আত্মহত্যার দায় এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রের উচিত কাউন্সেলিং পদ্ধতি জোরদার করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং ইউনিট গঠন করা। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্র আত্মহত্যার দায় থেকে কিছুতেই নিজেকে এড়িয়ে যেতে পারে না। যারা আত্মহত্যা করে, তারা বুঝে হোক কিংবা না বুঝে হোক আত্মহত্যা করে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত তারাও সম্মানিত একজন নাগরিক। তাদেরও বেঁচে থাকার যথেষ্ট অধিকার রয়েছে। প্রতিটি মেডিকেল কলেজে বিনামূল্যে হটলাইন সেবা চালু করতে হবে। তা ছাড়া প্রতিটি ইউনিয়নে তরুণদের নিয়ে ছোট ছোট ইউনিট গড়ে তুললে আত্মহত্যা কিছুটা হলেও রোধ করা যাবে। গণমাধ্যমকে হতে হবে অনেক বেশি দায়িত্বশীল। পাঠ্যপুস্তকে আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কিত নিবন্ধ সংযোজন, প্রতিটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা। হাসপাতালগুলোতে হটলাইন স্থাপন যেখানে যে কেউ ফোনে নিজের হতাশার কথা জানাতে পারবে এবং প্রতিকার পাবে। সভা-সেমিনারের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। তবে সব থেকে বেশি জরুরি অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। আত্মহত্যা কোনো প্রতিবাদের ভাষা নয়, এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আমাদের জীবনকে উপভোগ করতে শিখতে হবে। সেই অভাব পূরণ করতে আমাদের ঘুমিয়ে নয়, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে হবে। আকস্মিক দুর্যোগ, বিপদে ভেঙে না পড়ে সব প্রতিকূলতা মোকাবেলায় ধৈর্য ধরতে হবে দৃঢ়চিত্তে। এগুলোকে জয় করার জন্য চালাতে হবে দৃঢ় প্রচেষ্টা। আবির হাসান সুজন ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়