এখন প্রয়োজন ফুড ব্যাংক

ফুড ব্যাংক স্থাপন করতে পারলে শিল্পপতিরা সিন্ডিকেট তৈরি করে চালের দাম বাড়াতে পারত না। সরকার এই ফুড ব্যাংক থেকে ধান নিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থায় চাল তৈরি করে টিসিবির মাধ্যমে বাজারজাত করতে পারত। আর এই প্রক্রিয়াটি চালু থাকলে কৃষকও তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেত।

প্রকাশ | ২৩ জুন ২০২২, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
চালের সিন্ডিকেট এখন পুরো চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চালের দাম। দিশেহারা সরকারি কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার ও নিম্ন আয়ের মানুষ। চালের বাজার তদারকি করতে মাঠে নেমেছন প্রশাসন। তারপর কতটা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে তা দেখার বিষয়। তবে সত্যিকার অর্থে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হতাম যদি চালের প্রকৃত উৎপাদনকারী (কৃষকরা) সিন্ডিকেট তৈরি করতে পারত। দেশের বিভিন্ন সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে প্রান্তিক কৃষকদের জীবন ধারণ প্রক্রিয়াটা প্রায় ওষ্ঠাগত। কৃষকরা যদি জোটবেঁধে আজকের মুনাফাটা পেত তাহলে ক্ষতির কিছু ছিল না। বর্তমানে সারাদেশে সব পণ্য উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ বড় বড় শিল্পপতিদের হাতে, এই কারণে দেখা যায় যাদের যখন খুশি তখন তারা সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেলে আর নিজেদের পণ্যের দাম যেমন ইচ্ছে তেমনটি বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই কোটি কোটি টাকার মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। আজ থেকে ৫০ বছর আগে দেশের ধান থেকে চাল করা হতো ঢেকি দিয়ে, গ্রামের নিন্মবিত্ত কিছু মানুষ হাট থেকে ধান কিনে এনে, সেই ধান সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে ঢেকি দিয়ে চাল তৈরি করত। এই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে তারা লাভ করে ব্যবসাটি ছিল তাদের জীবন জীবিকা। ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় এ ধরনের ধান কিনে চাল তৈরি করা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বলা হতো 'বাড়হি'। এই বাড়হি শিল্পটি এখন আর চলে না। চাল ভাঙানোর মেশিন ভালুকায় চলে আসায় বাড়হি শিল্পর সঙ্গে জড়িতরা বেকার হয়ে যায়। কারণ বাড়হি শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের পুঁজি ছিল খুবই কম। তাই দেখা গেছে, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা চালকলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারেনি। তাই নিজ পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বাড়হি শিল্পীরা। তারপর ধীরে ধীরে ধান মেশিনের মাধ্যমে সিদ্ধ ও ভাঙানোর কাজটি সম্পন্ন করে চাল তৈরির কাজটি শুরু হলে, পুরো ব্যবসাটা চলে যায় বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে। আগেকার দিনে ধান থেকে চাল তৈরি করে বাড়হি শিল্পীরা পাটের বস্তা করে নিয়ে বাজারে বিক্রি করত। এখন বৃহৎকারের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ ধান থেকে চাল তৈরি করার কাজে নিয়োজিত হওয়ায়, চাল বাজারে বিক্রি হয় রকমারি মোড়কে /প্যাকেটে। বিভিন্ন নামের এখন চালের ব্রান্ড তৈরি করেছে এ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে মূল উৎপাদক কৃষকের ধানের নামে চাল বাজারে খুব কম পাওয়া যায়। গ্রামের বাজারে বিক্রি করা প্রান্তিক কৃষকদের ধান পাইকাররা কিনে নিচ্ছে তারপর কয়েক দফায় মধ্যস্বত্ব ভোগীর হাত বদল করে গ্রামের উৎপন্ন ধান চলে যাচ্ছে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ধানের সঙ্গে নানা ধরনের কেমিক্যালের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি চাল তৈরি করছে, তাছাড়া, উন্নত ধরনের মেশিনে চাল ভাঙানোর ফলে বিভিন্ন সাইজের চালও বাজারে পাওয়া যায়, এই চালগুলোকে কেউ বলে মিনিকেট, কেউ বলে চিনি গুড়া, তার বাইরেও রয়েছে বাহারি ধরনের নাম। আগেরকার দিনে যেমন সাইজের ধানটি ছিল তা থেকে তেমন সাইজের চাল তৈরি হতো, বর্তমানে ধানের সাইজের সঙ্গে চালের মিল নেই। ফলে ধান থেকে চাল হওয়ার যে মৌলিক প্রক্রিয়াটা ছিল সেই মৌলিকত্ব আর নেই। আগেকার দিনে বাড়হি (যারা ধান কিনে চাল বাজারে বিক্রি করত) শিল্পী যারা ছিলেন, তাদের ধান স্টক করার ক্ষমতা ছিল না। কারণ তাদের যে পরিমাণ পুঁজি ছিল তা দিয়ে কিনতে পারতো বড় জোর ১০ থেকে ১৫ মণ ধান, আর এই ধান ১০ কি ১৫ দিন ধান মজুত থেকে গেলে তাদের ক্ষতি হয়ে যেত। বর্তমানে বাড়হি (শিল্পপতিরা) লাখ লাখ টন ধান কিনে বছরের পর বছর গুদামজাত করে রাখলেও এই ব্যবসায়ীদের কোনো ক্ষতি হয় না। তাই চালের বাজারের মূল্যবৃদ্ধির ক্রীড়নক কারা, এটা থেকেই বুঝা যায়। তারপরও কিন্তু দেখা যায়, রবিন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কারের কবিতার মতো শত শত বুদ্ধিজীবী চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে টেলিভিশনগুলোতে রাতের পর রাত টক শোতে মেতে উঠেন। অথচ একজন সামান্য মুচিই কিন্তু সেদিন জুতা আবিষ্কার করেছিল, হাজার হাজার পিপে নস্য গিলে বুদ্ধিজীবিরা কিন্তু জুতা আবিষ্কার করতে পারেননি। বর্তমানে প্রান্তিক কৃষকরাই খাদ্যভাবে পড়ছে। কারণ তারা ধান উৎপাদন করছে। বর্তমানে প্রান্তিক কৃষকরা ঢেঁকি দিয়ে চাল তৈরি করেন না। ধান ও চালের মূল্য আনুপাতিক হারে বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, প্রান্তিক কৃষক যে দামে ধান বিক্রি করে তার চেয়ে দেড় গুণ/দ্ধিগুণ দামে চাল কিনতে হয়। তাই কৃষকের জন্য সরকারের কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বর্তমানে সরকারের উন্নয়নে কথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে। কিন্তু কৃষকের জন্য কি কোনো প্রকার উন্নয় ঘটেছে? তা ভেবে দেখা দরকার। বাংলাদেশে ভৌত অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটেছে গত দুই দশকে ব্যাপক। বাংলাদেশের এই উন্নয়নের উপকারভোগী কারা? বাংলাদেশের শতকরা ৬৫-৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কৃষি পেশার সঙ্গে জড়িত বা এই পেশা দ্বারা অর্জিত আর্থিক সুবিধা দিয়েই তারা জীবন যাপন করে। গত দুই দশকে প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদিত শস্যের দাম তেমন একটা বাড়েনি। কৃষি শস্যের দাম না বাড়লে কৃষকের আয় বাড়বে না ফলে কৃষকের মজুরিও বাড়েনি। চলতি বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন ফলন কিছুটা কম হয়েছে। তবে প্রতি বছরই ধানের অভাবনীয় ফলন হয় বর্তমানে বাংলাদেশে। এ দেশের কৃষক ধানের নায্যমূল্য পায় না। প্রান্তিক কৃষকরা চাল বিক্রয় করতে পারে না তাই চালের দাম বাড়ার মুনাফাটা পায় দেশের মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়া এবং চাতাল কল মালিকরা। বাংলাদেশের কৃষকের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটাতে হলে কৃষকের খাদ্য মজুত বা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি খাদ্য কেনার খবর গণমাধ্যমগুলোতে দেখা যায়- যা উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়- আর সব উদাহরণকে জেনারালাইজড করাটাও ঠিক না, এতে করে কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। ব্রিজ কালভার্টসহ যে উন্নয়ন হচ্ছে সেই উন্নয়নের চেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে খাদ্য গুদাম এবং শস্য সংগ্রহাগার স্থাপন করা। মৌসুমে প্রতিটি কৃষক যেন তাদের উৎপাদিত খাদ্য সেই সংগ্রহাগারে জমা রাখতে পারেন। সরকারিভাবে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ করা দরকার। কৃষকরা ওই সব কোল্ড স্টোরেজে আলু, শসা, তরমুজসহ কৃষি শস্য জমা রাখতে পারবেন। বাংলাদেশের কৃষিভূমি প্রাকৃতিক রোদ্ররোষের কবলে পড়ে প্রতি বছরেই। শিলাবৃষ্টি ও বন্যায় এ দেশের শস্যহানি হয়। তাই কৃষককে ফসল হারাতে হয় প্রকৃতির রোষের ছোবলে প্রায় প্রতি বছরই। হঠাৎ বন্যায় হাওড়ের হাজার হাজার একরের বোরো ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চলেও খরার কবলে পড়ে নষ্ট হয় হাজার হাজার একর জমির ধান। সরকারের এখন উচিত, খাদ্য গুদাম এবং কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ করে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ইউনিয়ন ফুড ব্যাংক স্থাপন করা। যে ব্যাংকে প্রতিটি কৃষকের নামে একটি করে হিসাব নাম্বার খোলা হবে। মৌসুমে উৎপন্ন ফসল প্রতিটি কৃষক তার হিসাব নাম্বার অনুসারে ফুড ব্যাংকে জমা রাখবেন। এই ব্যাংকে এমন একটি নিয়ম থাকবে যা সরকারি ক্রয় কেন্দ্রের অনুরূপ। কৃষক মনে করলে তার জমাকৃত ধান সরকারি নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করে দিতে পারবেন। আবার কৃষকের আপদকালীন সময়ে এই ফুড ব্যাংক থেকে খাদ্য ঋণ হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন এবং মৌসুমে অর্থাৎ ফসলকাটার সময়ে তা ফেরত দিয়ে দেবেন। \হফুড ব্যাংক স্থাপন করতে পারলে শিল্পপতিরা সিন্ডিকেট তৈরি করে চালের দাম বাড়াতে পারত না। সরকার এই ফুড ব্যাংক থেকে ধান নিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থায় চাল তৈরি করে টিসিবির মাধ্যমে বাজারজাত করতে পারত। আর এই প্রক্রিয়াটি চালু থাকলে কৃষকও তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেত। কেউ আর তখন চাল নিয়ে চালবাজি করতে পারত না। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক