হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডি শোক হোক শক্তি

হলি আর্টিজানের হামলার শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। এই শক্তি পুরোটাই ব্যবহার করতে হবে সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ উৎখাতের কাজে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এই জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সমাজে জঙ্গিবাদবিরোধী এক দৃঢ় সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একটি সমাজে তখনই জঙ্গিবাদবিরোধী দৃঢ় সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠবে- যখন সেই সমাজের জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে।

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

মনিরা নাজমী জাহান
২০১৬ সালের সালের ১ জুলাই। বাংলাদেশের ইতিহাসে এসেছিল এমন এক কালো রাত, যে রাতটি ছিল বিভীষিকার, আতঙ্কের এবং ভয়ের। গুটিকয়েক জঙ্গি মতবাদে বিশ্বাসী সশস্ত্র তরুণের জঙ্গি আক্রমণের ফলে এক রাতেই বদলে দিয়েছিল গোটা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক চিত্র। ভয়াবহ ও নিন্দনীয় জঙ্গি হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল গুলশান নামক এক জায়গায়। যে জায়গাটি মূলত পরিচিত ছিল অভিজাত কূটনীতিক পাড়া হিসেবে। সেই রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে জাপান, ইতালি ও ভারতের ১৭ জন নাগরিককে নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। দুইজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশের কয়েকজন মানুষকেও প্রাণ দিতে হয়েছিল ওই হামলাকারী জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হাতে। এ ধরনের নাটকীয় এবং নরকীয় হামলা যে বাংলাদেশে হতে পারে তা হয়তো হলি আর্টিজান হামলার পূর্বে বাংলাদেশের মানুষের কল্পনাতেও ছিল না। বরং সন্ত্রাসীরা কোনো রেস্টুরেন্ট কিংবা ব্যাংকে ঢুকে অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে ফেলে, সিনেমা-নাটকেই এ ধরনের দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত ছিল বাঙালি জাতি। কিন্তু এই ধরনের নাটকীয় হামলা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার বাস্তব চিত্র দেখা গেছে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঘটে যাওয়া ওই হামলার পর আতঙ্ক ও শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা জাতি। জাতির ওপর নেমে আসে কালো বিষাদের ছায়া। তবে যে প্রশ্নটি প্রথম মাথায় আসে তা হলো, হলি আর্টিজান হামলার পেছনে আসলে কি উদ্দেশ্য ছিল? দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন। সেখানে বলা হয়, হলি আর্টিজানে হামলার পেছনে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিদের- ১, কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেওয়া; ২, বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটানো এবং ৩, দেশে-বিদেশে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পাওয়া এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা। আদালত তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, বাংলাদেশ তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকান্ড ঘটায়। হলি আর্টিজান হামলার পরে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি ব্যাপক হারে উচ্চারিত হয় তা হলো, যারা জঙ্গিবাদে উৎসাহিত হচ্ছে বা জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হচ্ছে তারা আসলে কোন প্রক্রিয়ার বা কীভাবে হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে অপরাধ বিজ্ঞানীরা কোনো সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা বা বস্নু প্রিন্ট দিতে পারেননি। তবে মোটা দাগে পুরো প্রক্রিয়াতে ৩টি ধাপের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। প্রথম ধাপে একজন মানুষের প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় প্রতি এক ধরনের হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম নেয়। তিনি নিজেকে বঞ্চনার শিকার বলে মনে করতে থাকেন এবং সেই পরিস্থিতি থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন এক পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার। দ্বিতীয় ধাপে তিনি সুনির্দিষ্ট মতবাদ বা মতাদর্শ গ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বাস করতে থাকেন এই মতবাদ বা মতাদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারলে তিনি যে বঞ্চনার শিকার তা দূর হয়ে যাবে। তিনি যে সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন তা এই মতবাদ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। তখন তিনি এই মতাদর্শ দ্বারা গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হতে থাকেন। সর্বশেষ স্তরে যে বিষয়টি ঘটে তা হচ্ছে তিনি খুঁজে বের করেন তার সেই উদ্বুদ্ধ হওয়া মতবাদের অনুসারীর অন্যান্য মানুষের। তিনি সেই মতবাদের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তলার মাধ্যমে তাদের দলে যোগদান করেন। হলি আর্টিজান হামলার পরে তৃতীয় যে প্রশ্নটি মানুষের মনে উদ্রেক হয়েছে তা হলো ঠিক কারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়? কারণ হলি আর্টিজান হামলার আগে সবাই ভাবতো হয়তো মাদ্রাসা পড়ুয়া বা অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের সদস্যরা জঙ্গি হয়। কিন্তু হলি আর্টিজান হামলা সব হিসাব ওলটপালট করে দেখিয়েছে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া, নামকরা বেসরকারি বিশ্ব বিদ্যালয়ের সচ্ছল পরিবারের ছেলেরা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। অপরাধ বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েও বেশ হিমশিম খেয়েছেন। কারণ সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে ঠিক কোন গোত্র-ধর্ম-বর্ণের লোক জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হবে। নিবরাসের মতো উদার মনা পাশ্চাত্য শিক্ষায় বিশ্বাসী ছেলের যেমন জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ত হওয়ার ইতিহাস আছে ঠিক তেমনি আছে রিচার্ড রেইড নামক অল্প শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল ব্রিটিশ যুবকের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়ার ইতিহাস যে কিনা ২০০১ সালে আমেরিকান এয়ারলাইনসের প্যারিস থেকে মিয়ামিগামী একটি বিমানে আগুন লাগাবার চেষ্টা করেছিল অথবা রয়েছে নিদাল মালিক হাসান নামক যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর মেজরের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার ইতিহাস। যিনি ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর একাই খুন করেছেন ১৩ জন মানুষকে এবং মারাত্মকভাবে আহত করেন ৩০ জন মানুষকে। তাই এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, কোন কোন গোত্র-ধর্ম-বর্ণের লোক জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তবে যে বিষয়টিতে আমাদের যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করতে হবে তা হচ্ছে এই জঙ্গিবাদকে মোকাবিলার কৌশল নিয়ে। হলি আর্টিসান হামলার শোককে আমাদের শক্তিতে পরিণত করতে হবে। করোনাকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবনযাত্রা এখন অনেকাংশেই অনলাইন নির্ভর। সেই অনলাইন নির্ভরতার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে জঙ্গিগোষ্ঠীদের মধ্যেও। জঙ্গিগোষ্ঠীর এই অনলাইনভিত্তিক অপতৎপরতা বিষয়ক অভিযোগ উঠে এসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কণ্ঠেও। এই জঙ্গিবাদ নির্মূলে যেমন প্রয়োজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান ঠিক তেমনি প্রয়োজন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান দিয়ে হয়তো সাময়িকভাবে দমানো যাবে তবে জঙ্গিবাদের শিকার সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। সমাজের প্রতিটি মানুষের তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। হলি আর্টিজানের কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়েছে বটে কিন্তু চক্রান্তকারীরা সফল হতে পারেনি। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ ও শান্তিপ্রিয়। তাই তাদের ধর্মের অপব্যাখ্যা বা জঙ্গিবাদের উন্মাদনা বিপদগামী করতে পারেনি। হলি আর্টিজানের হামলার শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। এই শক্তি পুরোটাই ব্যবহার করতে হবে সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ উৎখাতের কাজে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এই জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সমাজে জঙ্গিবাদবিরোধী এক দৃঢ় সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একটি সমাজে তখনই জঙ্গিবাদবিরোধী দৃঢ় সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠবে- যখন সেই সমাজের জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে। মনিরা নাজমী জাহান : শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়