জগন্নাথদেবের উদ্ভব ও বিকাশ

শাস্ত্রীয় বিবরণ অনুযায়ী পুরাণ কাহিনী থেকে পাওয়া যায়, দ্বাপরের শেষ দিকে পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জরা নামক শবরের তীর বিদ্ধ হয়ে দেহরক্ষা করেন। রীতি অনুযায়ী তারই পার্থিব শরীরকে আত্মীয়স্বজনদের উপস্থিতিতে দাহ করা হয়। কিন্তু সেই সময় এক বিচিত্র পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সারা শরীর অগ্নিদগ্ধ হলেও তার নাভিপিন্ডটি কিছুতেই আগুনে স্পর্শ করছে না। তখন শ্মশানে সমাগত আত্মীয়স্বজনরা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। এমন সময় হঠাৎ দৈববাণী শোনা যায়- 'অদগ্ধ নাভিপিন্ডটিকে সাগরে বিসর্জন দাও, এটাই কলিযুগে দারুব্রহ্ম রূপে পূজিত হবে। এই দারুব্রহ্মই শ্রীশ্রীজগন্নাথ রূপে পূজিত। আর এই শ্রীশ্রীজগন্নাথকে নিয়েই রথযাত্রা উৎসব।

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

তারাপদ আচার্য্য
জগন্নাথদেব সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবতা। ইনি শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীবিষ্ণুর একটি বিশেষ রূপ। জগন্নাথ শব্দের আক্ষরিক অর্থ 'জগতের নাথ বা প্রভু'। ভারতের প্রাচীনতম তথা সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ জগন্নাথ মন্দিরটি ওড়িষ্যার পুরী শহরে অবস্থিত। জগন্নাথ পুরী নামে সমধিক পরিচিত এই শহরে প্রতি বছর বিখ্যাত রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়। পুরীর জগন্নাথ মন্দির চারধাম অর্থাৎ ভারতের চারটি পবিত্রতম তীর্থক্ষেত্রের অন্যতম। তবে ভারতের অনেক অঞ্চলেই জগন্নাথ মন্দিরের অস্তিত্ব আছে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, মাহেশ, মহিষাদল প্রভৃতি অঞ্চলে একাধিক জগন্নাথ মন্দিরের দেখা মেলে। সত্য যুগে রাজা ইন্দ্রদু্যম্ন সাক্ষাৎ ভগবান নীলমাধবকে খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থমনোরথ হয়ে স্বারাজ্যে ফিরে আসেন। তখন রাজা নীলমাধবের অদর্শন বেদনায় কাতর হয়ে অনশনে জীবনাহুতি দিতে প্রস্তুত হলে নীলমাধব দৈববাণীতে জানান, 'হে মহারাজ, তুমি আমার কথা শোন, তুমি নীলমাধব স্বরূপ আমার দর্শন কখনো পাবে না। নীলাচল পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে দারুব্রহ্মরূপে তুমি আমার দর্শন পাবে।' অন্য মতে, বৃন্দাবন ত্যাগ করে মহারাজ নন্দসূত শ্রীকৃষ্ণ তার দ্বারকা লীলারত হন। সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে শ্রীকৃষ্ণ যখন কুরুক্ষেত্রে যান তখন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম ও ভগিণী সুভদ্রা এবং দ্বারকা থেকে অনেকেই তার সঙ্গে ছিল। সে সময় ব্রজবাসীরাও সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে কুরুক্ষেত্রে ছিল। করুক্ষেত্রে বৃন্দাবনের গোপ-গোপীদের সঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয়। এ সময় ব্রজবাসীরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার বাল্যলীলাস্থল বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু ব্রজবাসীরা শ্রীকৃষ্ণকে রাজবেশে দেখতে চান না। তারা শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবনের গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে ব্রজের বেশে দেখতে চান এবং তার সহচর্য পেতে চান। তখন ব্রজবাসীরা কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর রথের ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই রথ টানতে টানতে বৃন্দাবনে নিয়ে যান। সেই লীলাকে স্মরণ করে ভক্তরা আজও পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা জগন্নাথদেবকে রথে করে টেনে বৃন্দাবনে (গুন্ডিচা মন্দির) নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। সেই থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে রথযাত্রা উৎসব। শাস্ত্রীয় বিবরণ অনুযায়ী পুরাণ কাহিনী থেকে পাওয়া যায়, দ্বাপরের শেষ দিকে পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জরা নামক শবরের তীর বিদ্ধ হয়ে দেহরক্ষা করেন। রীতি অনুযায়ী তারই পার্থিব শরীরকে আত্মীয়স্বজনদের উপস্থিতিতে দাহ করা হয়। কিন্তু সেই সময় এক বিচিত্র পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সারা শরীর অগ্নিদগ্ধ হলেও তার নাভিপিন্ডটি কিছুতেই আগুনে স্পর্শ করছে না। তখন শ্মশানে সমাগত আত্মীয়স্বজনরা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। এমন সময় হঠাৎ দৈববাণী শোনা যায়- 'অদগ্ধ নাভিপিন্ডটিকে সাগরে বিসর্জন দাও, এটাই কলিযুগে দারুব্রহ্ম রূপে পূজিত হবে। এই দারুব্রহ্মই শ্রীশ্রীজগন্নাথ রূপে পূজিত। আর এই শ্রীশ্রীজগন্নাথকে নিয়েই রথযাত্রা উৎসব। কেউ কেউ অভিমত পোষণ করেন যে, মহান ভক্ত শ্রীইন্দ্রদু্যম্ন নামে সূর্য বংশীয় পরম এক বিষ্ণুভক্ত রাজা মালদেশের অবন্তী নগরীতে রাজত্ব করতেন। তিনি ভগবানের সাক্ষাৎকার লাভের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়েছিলেন। ভগবৎপ্রেরিত কোনো এক বৈষ্ণব তখন রাজসভায় উপস্থিত হয়ে কথা প্রসঙ্গে রাজাকে ভগবান শ্রীশ্রীনীলমাধবের কথা বিশ্লেষণ করলেন। রাজা এই সংবাদ শুনে বিভিন্ন দিকে নীলমাধবকে খোঁজার জন্য বিভিন্ন ব্রাহ্মণ প্রেরণ করলেন। সকলেই বিফল হয়ে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলেন। একমাত্র রাজ পুরোহিত বিদ্যাপতি নীলমাধবের সঠিক খবর জানালেন। বিদ্যাপতির পথ নির্দেশনায় রাজা ইন্দ্রদু্যম্ন, মন্ত্রীরা ও সৈন্যসামন্ত সমভিব্যহারে নীলমাধবের খোঁজে গেলেন। যেখানে বিদ্যাপতি নীলমাধবের খোঁজ পেয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে রাজা নীলমাধবের সন্ধান পেলেন না। নীলমাধব সেখানে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রাজা ইন্দ্রদু্যম্ন নীলমাধবের দর্শন না পেয়ে অনশনরত অবস্থায় প্রাণত্যাগের সংকল্প করলেন। তখন শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব স্বপ্নে রাজাকে বললেন, 'তুমি চিন্তা করো না, সমুদ্রে বাঙ্কমুহান নামক স্থানে দরুব্রহ্মরূপে ভাসতে ভাসতে আমি উপস্থিত হব।' রাজা তখন তার পর্ষদদের নিয়ে ওই স্থানে উপস্থিত হলেন এবং যথাসময়ে শঙ্খ-চক্র-গদা পদ্মঙ্কিত দারুব্রহ্ম দেখতে পেয়ে রথে করে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে এলেন। পরবর্তী সময়ে এই দারুব্রহ্ম দিয়ে এক অজ্ঞাত ভাস্করের মাধ্যমে শর্ত সাপেক্ষ মূর্তি তৈরি করতে শুরু করলেন। রাজা শর্তভঙ্গ করে ভাস্করের কর্মশালায় গিয়ে দেখতে গেলেন। ভাস্কর অদৃশ্য হলেন। তখনো মূর্তিগুলো অসম্পূর্ণ। অসম্পূর্ণ মূর্তিগুলো দেখে রাজা ইন্দ্রদু্যম্ন অনুশোচনায় কাঁদতে লাগলেন। তখন ভগবান শ্রীশ্রীজগন্নাথ রাজা ইন্দ্রদু্যম্নকে আবার স্বপ্নে বললেন, 'আমি এই রূপেই তোমার কাছে সেবা পেতে চাই। এটাই আমার করুণার মূর্তি।' রাজা তখন সেই মূর্তিগুলোকে সম্পূর্ণ বলে গ্রহণ করে শ্রীশ্রীজগন্নাথ, শ্রীশ্রীবলরাম ও সুভদ্রা দেবীর সেবা ও পূজা করতে শুরু করেন এবং পরবর্তী সময়ে পুরীতে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের একটি সুবিশাল মন্দির নির্মাণ করেন। সেই থেকেই রথযাত্রার প্রচলন শুরু বলে জানা যায়। শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব কৃষ্ণবর্ণ, বলরাম শ্বেতবর্ণ ও সুভদ্রার মূর্তি হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। তিনটি রথেই তিনজনকে বসানো হয়। আবার অনেক স্থানে একটি রথেই তিন মূর্তিকে বসানো হয়। তিনটি রথের শাস্ত্রীয় নাম রয়েছে- শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথের নাম 'নন্দিঘোষ', বলরামের রথের নাম 'তালিধ্বজ' আর সুভদ্রার রথের নাম 'বিজয়া'। শাস্ত্রে বলা হয়েছে- 'রথস্থ বামনং দৃষ্টা, পুনর্জন্ম না বিদ্যতে। অর্থাৎ 'রথস্থ খর্বাকৃতি বামন শ্রীশ্রীজগন্নাথকে দর্শন করলে মানুষের আর পুনর্জন্ম হয় না'। নারায়ণগঞ্জে রথ কয়েক শতাব্দী থেকে পালিত। বিশেষ করে নিতাইগঞ্জ বলদেব আখড়া হতে রথ চলত আমরা ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি। ২/৩টি মন্দির হতেও বের হতো। এই রথ উপলক্ষে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই। তারাপদ আচার্য্য : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ