শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবারের ঈদ কতটা শঙ্কামুক্ত

সাধারণভাবে, যা প্রতিটি ঈদের প্রাক্কালেই দেখা যায়, অসৎ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট (এক বা একাধিক) করে সব ধরনের পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে থাকেন। এর আগে সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়, দেশে পণ্যসম্ভ্রার সরবরাহ ঠিকমতোই অব্যাহত রয়েছে- তাই পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। এ সত্ত্বেও যদি কেউ ঈদের আগে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করেন- তাকে কঠোরভাবে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে। ব্যবসায়ীরা কে কোন দলের তা না দেখে যে কোনো অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। সরকার এ ব্যাপারে, 'নো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ করেছে।
রণেশ মৈত্র
  ০২ জুলাই ২০২২, ০০:০০

ঈদ অর্থাৎ কোরবানির ঈদ, শুদ্ধ করে যাকে বলে ঈদুল আজহা- সম্ভবত ৯ জুলাই বা তার এক-দু'দিন আগে বা পরে পালিত হবে। কিন্তু কীভাবে পালিত হবে- সব মুসলমানই কি সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন- সে প্রশ্নের জবাব পাওয়ার সময় এখনো আসেনি। এই বিষয়গুলো প্রতিটি ঈদের আগেই মানুষকে ভাবিয়ে তোলে।

সাধারণভাবে, যা প্রতিটি ঈদের প্রাক্কালেই দেখা যায়, অসৎ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট (এক বা একাধিক) করে সব ধরনের পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে থাকেন। এর আগে সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়, দেশে পণ্যসম্ভ্রার সরবরাহ ঠিকমতোই অব্যাহত রয়েছে- তাই পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। এ সত্ত্বেও যদি কেউ ঈদের আগে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করেন- তাকে কঠোরভাবে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে। ব্যবসায়ীরা কে কোন দলের তা না দেখে যে কোনো অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। সরকার এ ব্যাপারে, 'নো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ করেছে।

এমন ঘোষণা সরকারের তরফ থেকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের মূল্য অনেক পরিমাণে বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু কে? ব্যবসায়ীদের যে সিন্ডিকেট, অর্থাৎ যারা পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে মূল অপশক্তি, দিব্যি নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে হেসেখেলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিই শুধু ঘাঁননি- দোকানে টাঙানো 'মূল্য তালিকা' ও দিব্যি সবাই সরিয়ে ফেলেছেন এক অকল্পনীয় বিড়ম্বনার শিকারে পরিণত হলেন সাধারণ নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষ।

অতঃপর দেখা যায়, দিন কয়েক বাজারে চালানো হয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই আদালতের বাজারে আসার খবর জানামাত্র বড় বড় দোকানদাররা তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে অন্যত্র চলে যান- তবে ফুটপাতের এবং ছোট ছোট খুচরা দোকানদার বা ব্যবসায়ীরা ওই আদালতের শাস্তি পেলেন যদিও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পুরো দায় দায়িত্বই বড় বড় ব্যসায়ীদের ওপর বর্তায় এবং সরকারেরও তা দিব্যি জানা। কিন্তু কোথায় যেন একটা গোপন শক্তিশালী সম্পর্ক ওই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে থাকায় আইনের হাতও হয়ত বা তাদের স্পর্শ করবে না।

এবারকার ঈদের আগে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার বেশ নতুনত্ব্বের চমক দেখলেন। সরকার দিব্যি বাড়িয়ে দিলেন গ্যাসের দাম, ভোজ্যতেলের দাম এবং জ্বালানি তেলের দামও। সবার আশঙ্কা, আর খুব একটা বেশি দেরি নেই বিদু্যতের মূল্য পুনরায় বৃদ্ধির। সরকার যদি স্বয়ং এ জাতীয় গণবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তড়িঘড়ি করে ঈদের প্রাক্কালে- তবে ওই সিন্ডিকেট ওয়ালা ব্যবসায়ীরা, যারা প্রকৃত প্রস্তাবে গণ-দুশমন, কেন সাহস পাবে না ব্যাপকভাবে মূল্যবৃদ্ধির?

পকেটকাটার এখানেই সমাপ্তি কি? না, তা নয়। আরও আছে। এমনিতেই তো প্রতি বছর ঈদের আগে পরিবহণ মালিকরা বাস ও লঞ্চভাড়া বাড়িয়ে দেন, অকস্মাৎ টিকেট নেই বলে কাউন্টার বন্ধ করে দিয়ে কালোবাজারীতে অনেক বেশি দামে টিকেট বিক্রি করে থাকেন এবং কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তারা তা দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন। সরকারি পদক্ষেপের কারণেও এবার বাস, ট্রাক, লঞ্চ এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিও পরিপ্রেক্ষিতে তা খুব একটা অযৌক্তিকও হবে না।

\হদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবন করে সরকার যদি অবিলম্বে ঘোষণা দিয়ে গ্যাস, ভোজ্য ও জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে অপরাপর পণ্যের বর্ধিত মূল্য ও ব্যবসায়ীদের প্রত্যাহারের আবেদন জানান- তা হলে তা দেশের বাজারের প্রতিটি কর্ণাহর অত্যন্ত ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হবে। কিন্তু তেমন কোনো রেকর্ড বাংলাদেশ সরকার গড়তে পারেনি আজও তাই তেমন কিছু আশাও কেউ করে না।

এবার ঈদের আগে হঠাৎ করেই করোনায় আক্রান্তের দৈনন্দিন সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে জনমনে উচ্চ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। ঈদ উপলক্ষে যত বেশিসংখ্যক নারী-পুরুষ-শিশুর হাজার হাজার বৃহৎ বৃহৎ জামায়েত হয়, প্রত্যেকের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন দূরদূরান্ত থেকে এসে মফঃস্বল এলাকাগুলোর প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মানুষ কমপক্ষে এক সপ্তাহের জন্য ভরপুর হয়ে ওঠে- তা আর কোনো উৎসবে ঘটতে দেখা যায় না। করোনা মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় প্রতিটি পরিবারের, প্রতিটি ঈদ যাত্রীর, প্রতিটি যানবাহনের, প্রতিটি পরিবহণ কর্মচারীর স্বাস্থ্যবিধি কড়াকড়ি মানায় এবং মানানোর প্রয়োজনীয়তা সমধিক। যদি এর বিপরীতটা ঘটে ঈদের আনন্দ উপে গিয়ে দেশটা বিষাদময় হয়ে পড়া স্বাভাবিক নয়। তবে যেহেতু করোনা রোগীকে স্পর্শমাত্রই কেউ করোনা আক্রান্ত হন না-সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগে নেগেটিভ হতে- তাই বিষয়টির প্রতি অবহেলা ও কম নয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভিন্নভাবে বিষয়টি দেখতে পারেন। প্রতিটি পরিবহণকে স্প্রে করা হয়েছে কিনা, সব কর্মী টিকা নিয়েছেন কিনা তা কঠোরভাবে নজর দাবি করা এবং কোনো বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমার বা বিমানের টিকেট দেওয়ার আগে যাত্রীরা প্রত্যেকে তিনটি করে টিকা নিয়েছেন কিনা কড়াকড়িভাবে তা দেখার ব্যবস্থা করতে পারেন। এক কথায় বুস্টার ডোজ টিকা নেননি এমন কোনো পরিবহণ কর্মী, কাউন্টারের কর্মী বা যাত্রী কোনো প্রকার যানবাহনের টিকেট কিনতে বা বিক্রি করতে পারবেন না- করলে তিন বছরের জেল বা ১০,০০০ টাকা তাৎক্ষণিক জরিমানা করা হবে মর্মে ঘোষণা যদি সরকার করেন এবং ব্যাপকভাবে টিকা দান অভিযান এখন থেকেই শুরু করেন- তা হলে মানুষকে করোনা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে বহুলাংশে মুক্ত করা সম্ভব।

এবার ইতিবাচকের সন্ধান করা যাক

পবিত্র ঈদুল-আজহা নিয়ে লিখতে বসে এ যাবত একের পর এক নেতিবাচক কথা বা তথ্য পাঠক-পাঠিকাদের জন্য লিখে ফেললাম। লিখে ফেললে কি হবে? যাদের সমীপে বিষয়গুলোর উপস্থাপনা করলাম- তাদের নজরে যে কিছুই পড়বে না তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করি না। তাই এক ভ্যান্তা প্যাচাল বা পাগলের প্রলাপ বা অরণ্যে রোদন বলে মনে করা যেতে পারে।

এবারে তাই খোঁজ করে দেখা যাক জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত হতে পারি এমন বিশেষ কোনো বার্তার সন্ধান পাওয়া যায় কি না? অবশ্যই তা পাওয়া যাবে এবং গত ১৬ জুন তা আমাদেও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ঝড় তুলেছে এবং পরদিন সংবাদপত্রগুলোর শিরোনাম হয়েছে।

শ্রেষ্ঠ খরব-সুইস ব্যাংককে বলে আমাদের টাকা পয়সা নেই, পকেটে লাখ লাখ টাকা- ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা নেই। আছে, নিশ্চয় আছে। যত টাকা থাকলে আমরা সন্তুষ্ট হই তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি আছে। কোথায়? সুইস ব্যাংকে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সঞ্চয়ই সুইস ব্যাংকে সর্বাধিক।

ব্যানার শিরোনাম (তিন কলামব্যাপী) করে ছেপেছে একটি জাতীয় দৈনিক 'সুইস ব্যাংকে উলস্নম্ফন বাংলাদেশের অর্থের' এমন শিরোনাম বিগত ১৭ জুন তারিখে।

সংক্ষেপে খবরটির বিবরণ তুলে ধরি। 'সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি ব্যক্তি এবং ব্যাংকের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ এক বছরে ৫৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি হারে। গত বৃহস্পতিবার সে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক( এস এন বি) বিশ্বেও সব দেশের সঙ্গে তাদের দায় ও সম্পদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। 'ব্যাংক ইন সুইজারল্যান্ড' নামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ২০২১ সালের সে দেশের ২৩৯টি ব্যাংক।

প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশের কাছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের দায় রয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা দাঁড়ায় ৮,২৭৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। ফলে আগের বছরের চেয়ে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থ অনেক বেড়েছে।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করল তার কয়েকদিন আগে এ জাতীয় বাজেটে আসছে অর্থবছরে বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের অপ্রদর্শিত সম্পদ নির্দিষ্ট হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে। এত বলা হয়েছে, বিদেশে থাকা যে কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়করসহ অন্য যে কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রশ্ন করবে না। বিদেশে থাকা স্থাবর সম্পত্তি দেশ আনা হলে তার মূল্যে ওপর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রির্টানে দেখা যাবে। অস্থাবর সম্পদ বাংলাদেশে না আনলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর দিলে একই সুবিধা পাওয়া যাবে। আর বাংলাদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ আনলে তার ওপর কর মাত্র ৭ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বিশেষত দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টার-ন্যাশনাল, বাংলাদেশ, সরকারের এ পদক্ষেপের সমালোচনা করছে। তারা দাবি করেন এ ধরনের সুযোগ অর্থ পাচারকেই বরং উৎসাহিত করবে এবং সৎ করদাতা যাদের অনেকেই ২৫ শতাংশ কর দেন, তারা নিরুৎসাহিত হবেন।

যা হোক, ইতিবাচক যে দিকটি লক্ষণীয় তা হলো আমাদের টাকা আজ বিদেশি ব্যাংকে গিয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করছে। ইতোমধ্যে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ স্থানে- সারা পৃথিবীর মধ্যে শীর্ষ স্থানে যাওয়াও কঠিন হবে না কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ স্থানে অধিকারের অভিজ্ঞতা তো সঞ্চিত থাকল। হবোই হবো একদিন আমরা গোটা পৃথিবীর মধ্যে শীর্ষ স্থান অধিকার বিদেশে সম্পদ রাখা ব্যাপারে।

আলো ঝলমল পদ্মা সেতু

বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে অস্বীকৃতি জানানোর পর যখন নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিতর্ক চলছিল- তখন সংবাদপত্রে একটি নিবন্ধ লিখে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলাম। পরবর্র্তী সিদ্ধান্ত পাকা পোক্ত করে গ্রহণের পর সরকারকে এ ব্যাপারে অভিন্দন জানিয়েও লিখেছিলাম যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শেষ- তার উদ্বোধন হতে চলেছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এই চেষ্টা অবশ্যই অভিন্দযোগ্য। এরপর অবকাঠামো নির্মাণে মেগা প্রকল্প গ্রহণ কমিয়ে উৎপাদনশীল অর্থনীতি গড়তে শিল্প ও কৃষির ব্যাপক প্রসারের ওপর জোর দিতে হবে।

রণেশ মৈত্র : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে