শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ পাচারকারীর সহায়ক কারা?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থ পাচার ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত বিষয়গুলোর একটি। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কারণ, অর্থ পাচার হয় বেআইনি বহুমুখী পথে। আন্ডার ইনভয়েস-ওভার ইনভয়েস, হুন্ডিসহ নানাভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। ফলে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে বলা অনেকটাই অসম্ভব।
জহির চৌধুরী
  ০২ জুলাই ২০২২, ০০:০০

জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থ-বছরের প্রস্তাবিত বাজেট পাশ হয়েছে। এর আগে প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে রাজনৈতিক দল, অর্থনীতিবিদসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা বরাবরের মতো লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবার লক্ষণীয় যে, বাজেট পাশ হওয়ার আগে অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণে তুলনামূলক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা বিনা প্রশ্নে দেশে আনার, নামমাত্র কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ রাখার বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা 'ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ' (টিআইবি) বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে বিনা প্রশ্নে পাচার করা অর্থ দেশে আনার সুযোগ দেওয়া অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নামমাত্র কর দিয়ে প্রশ্নহীনভাবে পাচার করা অর্থ বিদেশ থেকে আনার সুযোগ স্পষ্টতই অর্থ পাচারকারীদের অনৈতিক সুরক্ষা ও পুরস্কার প্রদান। এ সুযোগ অর্থ পাচার তথা সার্বিকভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে, যা সংবিধান পরিপন্থি এবং প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণার অবমাননাকর। এভাবে পাচার হওয়া টাকার বৈধতা দিলে যারা নিয়মিত কর দেন তারা হতাশ হবেন। যারা সৎভাবে ব্যবসা করছেন তারা নিরুৎসাহিত হবেন। এমনকি দেশের টাকা এখন উল্টো বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। এ সুযোগ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক তিনভাবেই অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেন, 'বাজেটে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার প্রস্তাব বেআইনি।' ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বলেছে, 'পাচারের অর্থ ফেরতের উদ্যোগ সমর্থন করে না এফবিসিসিআই।' বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়েছে। জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনার প্রথমদিনেই সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা পাচার হওয়া অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে আনার সুযোগের বিরোধিতা করে বলেছেন, অর্থ পাচারকারীদের দায়মুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। যারা দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরি করে বিদেশে পাচার করেছে, তাদের বিচারের আওতায় না এনে দায়মুক্তি দেওয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থ পাচার ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত বিষয়গুলোর একটি। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কারণ, অর্থ পাচার হয় বেআইনি বহুমুখী পথে। আন্ডার ইনভয়েস-ওভার ইনভয়েস, হুন্ডিসহ নানাভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। ফলে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে বলা অনেকটাই অসম্ভব।

\হদেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে ধারণা করা যায় বাংলাদেশ থেকে বছরে কম-বেশি এক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৯ লাখ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হয়- এটা বাস্তবতা। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ স্থানান্তরের আইনগত কোনো সুযোগ বাংলাদেশিদের বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি প্রদানের আগ পর্যন্ত ছিল না। বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি প্রদানের পর যে অর্থ সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশে বিনিয়োগ হয়েছে সে অর্থ বা সে অর্থের অংশ বিশেষ, বিনিয়োগের লভ্যাংশ দেশে আনার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা বা বাধা নেই। পাচারকৃত অর্থ আইন বহির্ভূতভাবে বিদেশে পাঠানো বা প্রেরণ করা হয়েছে বলেই পাচারকৃত অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে আনার এবং নামমাত্র কর দিয়ে বৈধকরণের সুযোগের বিরোধিতা-সমালোচনা হচ্ছে। পাচারকৃত বেশিরভাগ অর্থের উৎস্য এবং বিদেশে প্রেরণের পদ্ধতি আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের মতে, পাচারকৃত অর্থের প্রায় পুরোটাই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত এবং পাচার পদ্ধতি মানি লন্ডারিং আইনে দন্ডনীয়। নির্দ্বিধায় বলা যায়, আইনের চোখে পাচারকৃত অর্থ অর্জন এবং পাচার দুই ক্ষেত্রেই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে- এ কারণে পাচারকারী অপরাধী সাব্যস্ত হবেন। উচ্চ আদালত এক মামলার শুনানিতে বলেছেন, 'অর্থপাচারকারীরা দেশ-জাতির শক্র।' উচ্চ আদালতের এ মন্তব্যে অর্থ পাচারকারীর অপরাধের মাত্রা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। দেশ-জাতির শক্রদের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয় অর্থ পাচারকারীদের প্রতিও একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা যথার্থ। দেশ-জাতির শক্রদের কোনো বিচারেই, কোনো যুক্তিতেই খায়-খাতির দেখানোর সুযোগ নেই বা থাকতে পারে না। সরকার দেশ-জাতির শক্রদের পাচারকৃত অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে আনার, নামমাত্র কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দিলে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ অর্জন এবং অর্জিত অর্থ পাচার উৎসাহিত হবে তা বলা প্রয়োজন পড়ে না। পাচারকৃত অর্থ আইনের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনার এবং পাচারকারীদের আইনের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করার সুযোগ আছে। সময় সাপেক্ষ হলেও আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় আইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা এবং পাচারকারীদের শাস্তি দেওয়া সম্ভব। পাচারকৃত অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে আনার এবং নামমাত্র কর প্রদান করে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া কোনো বিচারেই যৌক্তিক হতে পারে না যে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে অন্যায় প্রশ্রয়-পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। দেশে ব্যাংকিং খাত ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে কিছু লোকের ব্যাংক ঋণের নামে ব্যাংকের তহবিল লোপাটে লিপ্ত থাকার কারণে। এরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করছে না। এদের ঋণ খেলাপি ঘোষণা দিয়ে একের পর এক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তাতে মনে হয় ব্যাংক ঋণের অর্থ ফেরত না দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ, যথানিয়মে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা বোকামি। কালো টাকা বৈধ করার সুযোগও অবারিত বলা যায়। কালো টাকা বৈধ করার অবারিত সুযোগ দেশে সৎভাবে আয়-রোজগারকে বেকুবের কাজ গণ্য করছে। অর্থ পাচারকারীদের বিনা প্রশ্নে পাচারকৃত অর্থ দেশে আনার, নামমাত্র কর প্রদান করে বৈধ করার, কালো টাকা সাদা/বৈধ করার, ব্যাংক ঋণ নিয়ে যথাসময়-নিয়মে প্রদান না করে ঋণ খেলাপি হওয়াদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের নীতি/সংস্কৃতি অর্থ পাচার, কালো টাকা অর্জন, ব্যাংক ঋণের অর্থ লোপাট উৎসাহিত করবে তাতে সন্দেহ-সংশয় থাকতে পারে না। এ সংস্কৃিত/নীতির কুফল ইতিমধ্যেই কম-বেশি পরিলক্ষিতও হচ্ছে। এ সংস্কৃতি/নীতির কুফলে দেশে দুর্বৃত্তায়নের অর্থনীতি-দুর্বৃত্তের সমাজ শক্তিশালী হচ্ছে, ন্যায়-নীতি অযোগ্যতা সাব্যস্ত হচ্ছে, ন্যায়-নীতিবানরা সমাজে হাসি-তামাশার পাত্রে পরিণত হচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বৈষম্যহীন, সাম্য, ন্যায়ের সমাজ গঠন বাধাগ্রস্ত করছে। সামাজিক স্থিতিশীলতা, টেকসই উন্নয়ন, আইনের শাসনের স্বার্থে-প্রয়োজনে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট উৎসাহিত হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। অর্থ পাচার ফৌজদারি অফেন্স। অর্থ পাচারকারীদের ছাড় দেওয়ার, খাতির দেখানোর সুযোগ নেই। অর্থ পাচারকারীদের ছাড় দেওয়া, পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে খাতির দেখানো অর্থ পাচার ও পাচারকারীদের সহায়ক হওয়ার বাসনা প্রকারান্তরে ব্যক্তের শামিল। অর্থ পাচার ও পাচারকারীর সহায়ক সরকার-রাষ্ট্র হতে পারে না।

জহির চৌধুরী :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে