বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

বাংলাদেশে গ্রন্থাগার উন্নয়ন

মো. কবির হাসান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক
  ০২ জুলাই ২০২২, ০০:০০

জ্ঞানভিত্তিক আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একটি গ্রন্থাগার, যেখানে বৈচিত্র্যময় গ্রন্থের সংগ্রহ, পৃথিবীর সর্বকালের অভিজ্ঞতা, বিদ্যা, জ্ঞান এবং আবিষ্কারের সারাংশ সংরক্ষিত থাকে। গণগ্রন্থাগারে পাঠকসেবা, তথ্যসেবা, গবেষণা কার্যক্রমসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য সেবা প্রাপ্তির বাধাহীন সুযোগ থাকায় গণগ্রন্থাগারকে জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। প্রযুক্তির বিবর্তনের ফলে স্মার্ট মুঠোফোনের মতো নানা ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি মানুষকে প্রায় যন্ত্রে পরিণত করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সব পর্যায়ে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের ব্যাপক ব্যবহার একটি উত্তম চর্চা হতে পারে।

শুরুর দিকে গ্রন্থাগার ছিল শুধু প্রার্থনাগৃহ বা রাজসভার নিয়ন্ত্রাধীন, পরে গণগ্রন্থাগারের মাধ্যমে তা সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বাংলার ময়নামতি ও মহাস্থানগড়সহ অন্যান্য বৌদ্ধ বিহারগুলোতে গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এসব বৌদ্ধ বিহারের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত উপকরণ থেকে জ্ঞান আহরণের জন্য দূর দেশের জ্ঞানঅনুসন্ধিৎসু মানুষের আসা-যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। ৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে বাংলাদেশে গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়।

১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ বিভক্ত হলো। এ বিভক্তির পর মূলত পাঞ্জাব, লাহোর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারই সজীব ছিল। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য সম্পদ ও সম্পত্তি ভাগাভাগির ন্যায় লাইব্রেরিসমূহের ভাগ পাকিস্তান না পাওয়ায় বেশ ক্ষতিই হয়েছিল। কলকাতার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি (বর্তমানে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লাইব্রেরি), ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম ও দিলিস্ন এবং অন্যান্য শহরে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারি গ্রন্থাগারের পাওনা কোনো অংশই পাকিস্তান লাভ করেনি। গ্রন্থাগার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশের দৈন্যের সূচনা তখন থেকেই। তবে ১৯৫৪ সালের ৫ ফেব্রম্নয়ারি যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুফ্রিুর রহমান গণগ্রন্থাগারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে একটি মাইলফলক উন্মোচন করেন। প্রায় ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যা হোক নানান শোষণ বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার অব্যবহিত পরেই পূর্ব পকিস্তান গ্রন্থাগার সমিতির পুনঃনামকরণ করে বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতি নির্ধারণ করা হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংযুক্ত অসংখ্য গ্রন্থাগারের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শিক্ষা উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে 'ডক্টর কুদরত-ই-খুদার' নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২-এ কমিশন যুগান্তকারী প্রতিবেদন পেশ করে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের প্রতিটি থানা সদরে একটি করে গণগ্রন্থাগার স্থাপন করতে হবে। প্রাথমিক স্কুলে বই পরিবেশনই গ্রন্থাগারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হবে। থানা গ্রন্থাগার স্থাপনের ব্যয়ভার বহন করবে জাতীয় সরকার। আমাদের জাতীয় লক্ষ্য হতে হবে দেশের প্রতিটি প্রাথমিক স্কুলে গ্রন্থাগার স্থাপন। কলেজ গ্রন্থাগারের উন্নয়নের ন্যূনতম মান সম্পর্কে কমিশনের সুপারিশ ছিল 'কলেজ গ্রন্থাগারের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ অপরিহার্য। কলেজ গ্রন্থাগার সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে'। কমিশন আরও বলেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বই, সাময়িকীর বরাদ্দ বাড়াতে হবে, গবেষণাকর্মকে জোরদার করার জন্য রেফারেন্স বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে এবং বিদেশি বই, ফিল্ম ইত্যাদি আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সাহিত্য-সংস্কৃতির মূল্যাবান উপাদানগুলো সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই ৬ নভেম্বর ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় 'জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর'। এরই অধীনে বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রকাশ পায় ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৩ সালে গৃহীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্রন্থাগারের উন্নয়নে সরকার ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করে।

বিশেষভাবে উলেস্নখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনে বই ছিল একটি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত পারিবারিক গ্রন্থাগারটি ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনন্য সম্পদ। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে বন্দিজীবনের কষ্ট ও প্রিয়জনের অভাব বোধ থেকে তিনি বইপ্রেমী হয়ে ওঠেন। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে, ১০ জানুয়ারি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর একাকিত্ব জীবনে একমাত্র সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বইকে। নিঃসঙ্গ জীবনে বইকে যেভাবে আকড়ে থেকে বেঁচেছিলেন সেইভাবে তিনি তার পরিবারকে পাননি। বঙ্গবন্ধু তার রোজনামচায় ২০ জুলাই ১৯৬৬, বুধবার লিখেছেন, 'দিনভরই আমি বই নিয়ে পড়ে থাকি। কারণ সময় কাটাবার আমার আর তো কোনো উপায় নাই। কারও সঙ্গেদুই-এক মিনিট কথা বলব তা-ও সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।' ১ মার্চ ১৯৬৭, বুধবার তিনি একই কথা আবার লিখেছেন, 'বইপড়া ছাড়া আর তো কোন উপায় নাই। খবরের কাগজ আর বই'। বইপ্রেম থেকে গ্রন্থাগারের প্রতি ভালোবাসা জন্মানো, খুবই স্বাভাবিক। তার শাসনামলেই শুরু হয় গ্রাম-গঞ্জের ভাঙাচোরা, জ্বালিয়ে দেওয়া অথবা লুণ্ঠিত গ্রন্থাগারগুলোকে দাঁড় করানোর আয়োজন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে