ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় বানভাসি মানুষ

সরকার বর্তমান সমস্যা মোকাবিলায় যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি এনজিও, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমাজের প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করতে হবে পুনর্বাসনের কাজ।

প্রকাশ | ০৫ জুলাই ২০২২, ০০:০০

অনজন কুমার রায়
'পানি তো গেছেগি, আমরা ওখন কোয়াই যাই? ১০ দিন পানির তলে থাইক্কা বাসার সবতা নষ্ট ওই গিছে। মঙ্গলবারে চাউলের বস্তা আনছি আর বৃহস্পতিবারে বাসায় কোমরপানি। সব শেষ। ইকানো (আশ্রয়কেন্দ্র) তো দু-একবেলা খাবার পাচ্ছি। বাসায় ফিরে তো তারও নিশ্চয়তা নাই।'- গত ২৫ জুন দুপুরে এভাবেই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার কথা বলেছিলেন হারাধন নম। ১৬ জুন সিলেট নগরীর মাছুদীঘিরপাড় এলাকায় নিজের বাড়িটি বানের পানিতে তলিয়ে গেলে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। পানি নেমে যাওয়ায় অনেক পরিবার চলে গেলেও কিছু কিছু পরিবারের আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা এখনো হয়নি। তাদের দেখা দিয়েছে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা। সাধারণ মানুষের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে খাবারের নিশ্চয়তা, বাড়িঘর এবং সড়ক পুনর্গঠন। তাই বন্যা-পরবর্তী শঙ্কায় অনেকেই দিন যাপন করছে। সিলেট এবং সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু, খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার্ত মানুষের আর্তনাদ এখনো থামেনি। বানভাসি মানুষের আর্তনাদেই জানান দেয় বন্যার বিভীষিকার রূপ। যে আর্তনাদের পেছনে লুকিয়ে আছে হারানোর বেদনা, ঘরের ভেতরের শূন্যতা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে শুরু করতে হবে নতুন জীবন। যাদের সঞ্চিত টাকা আছে তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে। অন্যদিকে সহায়-সম্বলহীন মানুষের বাড়বে অসহায়ত্ব। এ মুহূর্তে তারা কাজও পাবে না পরিবার চালানোর মতো কোনো সংস্থানও হবে না। ফলে একবেলা খাবার জোটানো দুষ্কর হয়ে পড়ছে। যারা বন্যার কবলে ঘর ফেলে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসেছিল বাড়িতে গিয়ে হয়তো দেখবে তাদের ঘরটি অক্ষত নেই। বন্যায় সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। ঘরের ভেতর প্রিয় জিনিসগুলো নষ্ট হয়ে আছে। কিছু কিছু জিনিস মাটি এবং পানিতে মিশে একাকার হয়ে আছে। ছোটদের শিক্ষার উপকরণ ভেসে গেছে। চুলায় আগুন ধরানোর মতো পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা নেই। চেনা জায়গা তাদের বেশি অসহায় করে তুলবে। অনেকে এক কাপড় পড়ে দিন পাড়ি দিচ্ছে। অন্যদিকে, বড়রা রান্না করা খাবারের পাশাপাশি শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকলেও শিশু সন্তানদের নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। ঘরের যে শিশুটির জন্য আলাদা খাবার কেনা হতো আজ তার জন্য পানি এবং ব্রেডই যথেষ্ট! বয়স্কদের সাথে তাকেও খাবারের জন্য হাহাকার করতে হয়, ত্রাণের জন্য পথ চেয়ে থাকতে হয়। ক্ষুধার্ত শিশুটি খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলেও হাতে দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় কিছু নেই। ক্ষুধার তীব্র জ্বালায় কোথায় যেন স্মিত হাসি হারিয়ে গেছে। এ মুহূর্তে পানিবাহিত রোগ, জ্বর, স্বর্দি, কাশি ছড়িয়ে পড়ছে। বন্যার্তদের সংকট মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ অনেকেই সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে, নানা পেশার লোক যথাসাধ্য পাশে থাকার চেষ্টা করছেন। তাদের অনেকেই নৌকা নিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন। কেউ কেউ ত্রাণের তহবিলে টাকা তুলে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ পরনের জামা-কাপড় সংগ্রহ করে বন্যার্তদের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন। দেশের বাইরে থেকেও অনেকেই বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন। যে যেভাবে পারে মানবতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বিশেষ করে আমাদের সমাজের তরুণরা সাবলীলভাবে বানভাসি মানুষের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। অভাবের তাড়নায় অনেকেই গরু, ছাগল, হাস-মুরগি সস্তায় বিক্রি করে দিচ্ছে। কোনোভাবে বেঁচে থাকাই এখন তাদের আশা। অথচ, কিছুদিন আগেও তাদের চোখে স্বপ্ন ছিল সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার। গেল দু'বছর কোভিডের থাবায় অর্থনীতির চাকা হঠাৎ থমকে যায়। কোভিডের নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে-না উঠতেই বন্যার মতো দুর্যোগের হানা। কোভিডের হানা কাটিয়ে উঠতে পারলেও বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। সব মিলিয়ে তারা অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছে। তাই, এখনো তারা ত্রাণের নৌকার অপেক্ষায় থাকে! কয়েকটি উপজেলা সদরের হাসপাতাল বন্যার পানিতে পস্নাবিত হয়েছে। ফলে সেখানকার ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই চিকিৎসা সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক ফার্মেসিতে প্রয়োজনীয় সব ওষুধ মিলছে না। তবে, বন্যা-পরবর্তী অসুখ মোকাবিলায় ১৪০টিরও বেশি মেডিকেল টিম সিলেটে কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারলেও এর বিরূপ প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারি। বন্যায় যা ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। যে কৃষক বোরো ধান কেটে গোলা ভরে রেখেছিল তা বন্যায় ভেসে গেছে নতুবা পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। যার ফলে খাদ্য জোগানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। চলতি মৌসুমে আউশ, আমন ও সবজি মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। এর মধ্যে পানিতে ডুবেছে ৮৮ হাজার ৬২২ হেক্টর জমি। ভেসে যাওয়া ফসলের ক্ষেতে নতুন করে শুরু করতে হবে উৎপাদন। যারা ঋণ নিয়ে কৃষি কাজ শুরু করেছিল তাদের আরও কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। সবাইকে শূন্য থেকে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু, সে কাজটুকু সহজ নয়। তবে, সবার সহযোগিতা পেলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে। বন্যা-পরবর্তী উত্তরণের জন্য এখন থেকেই এমন কিছু কাজ করতে হবে যাতে যা সক্ষমতা হারানো লোকদের জন্য সহায়ক হবে। সেজন্য ক্ষতিগ্রস্ত সবার জন্য কয়েক মাস নিরবচ্ছিন্ন খাদ্য সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখা যেতে পারে। বন্যা-পরবর্তী রোগ-বালাই প্রতিরোধে মেডিকেল টিম বহাল রাখতে হবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট মেরামত করতে হবে। অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষা উপকরণ নষ্ট হয়ে গেছে। তাই, তাদের শিক্ষা উপকরণ প্রদান করতে হবে। যেহেতু, সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বোরো ধানের ক্ষতি বেশি হয়েছে তাই সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার কারণে ধান বীজের সমস্যা থেকেই যাবে। ধানের বীজ এবং বীজতলার সমস্যা যেন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। বীজতলায় চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও হালচাষ সমস্যা নিরসনে কাজ করতে হবে। প্রান্তিক মানুষকে স্বাবলম্বী করে তুলতে সহজ উপায়ে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমনটি করেছে হবিগঞ্জ উন্নয়ন সংস্থা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নআয়ের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ২০০ নারীকে সহজশর্তে ৫০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে হবিগঞ্জ উন্নয়ন সংস্থা। সরকারের পলস্নী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (চকঝঋ)- এর মাধ্যমে এই ঋণের উপকারভোগীরা ৪ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিয়ে তা পরিশোধের জন্য সময় পাবেন আড়াই বছর। হবিগঞ্জের ৯টি উপজেলায় বানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়ন সংস্থার ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সদস্যরা এ ঋণ পাবেন। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৯ জুন, ২০২২) সরকার বর্তমান সমস্যা মোকাবিলায় যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি এনজিও, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমাজের প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করতে হবে পুনর্বাসনের কাজ। তবেই বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত থেকে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। বস্তুত, নদীর পৃথক সত্তাকে মেনে নিয়ে আমাদের উন্নয়ন পরিকাঠামোসহ সব কাজ করতে হবে। অনজন কুমার রায় :কলাম লেখক