সাম্প্রদায়িকতা ও নিবার্চন

সাম্প্রদায়িকতা লালন করে নিবার্চনে যারা বৈতরণী পার হবে তাদের দিয়ে কোনো দিন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সৃষ্টি হবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদশের্র সঙ্গে সাংঘষির্ক সব ধরনের রাজনৈতিক কমর্কাÐ এ দেশে নিষিদ্ধ করা দরকার।

প্রকাশ | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন। নিবার্চনে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমূহ জোটভুক্ত হচ্ছে। দলগুলো মোটামুটিভাবে দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। স্বাধীনতার পূবের্ও এ দেশের রাজনৈতিক ধারা দু’ভাগে বিভক্ত ছিল একটা সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানপন্থি অন্যটি এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধারা। মুক্তিযুদ্ধের পর সাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনীতি ধারাটির বিলুপ্তি ঘটে। বিলুপ্তি বললে ভুল হবে কারণ ওই সময় সাম্প্রদায়িক শক্তি গা ডাকা দেয়। তবে লুকিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক শক্তি নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৭৫ সালে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্রে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। আর ৭৫-এর পটপরিবর্তনের মধ্যদিয়ে উত্থান ঘটে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির। ৭৫-এর পর এ দেশে সেনা শাসন শুরু হয়। অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের জন্য সম্পৃক্ততা বাড়াতে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের পালনকারী ধমের্ক হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়, তাই দেখা যায়, ইসলাম ধমের্ক শাসকরা সেই সময় রাজনীতিতে ব্যবহার শুরু করে। এ দেশের সেনা শাসকরা কেউ বিসমিল্লাহ কেউ বা রাষ্ট্রধমর্ ইসলামকে বমর্ বানিয়ে রাজনীতিতে নেমে যায়। দুই স্বৈরশাসকেই জলপাই রঙের মোড়ককে জনরঙে রূপ দেয় ধমের্ক রাজনীতিতে ব্যবহার করার মাধ্যমে। ১৯৭৫-১৯৯০ এই দীঘর্ সময় এ দেশের মানুষ স্বৈরশাসনের পতন ঘটানোর জন্য আন্দোলন করে। ৯০-এ পতন ঘটেছে স্বৈরাচারের তবে তাদের পদাঙ্ক এখনো রাজনীতিতে অনুসৃত একটি পথ হয়েই আছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো চলে অবাধে ধমের্র ব্যবহার আর নিবার্চনের বৈতরণী পার হতে ধমর্ তো একটি মোক্ষম হাতিয়ার। একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে নিবার্চনী বৈতরণী পার হতে তার ব্যত্যয় ঘটছে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও মহাজোট উভয়েই ধমাির্শ্রত রাজনৈতিক দলগুলোকে জোটভুক্ত করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতাসীন হওয়ার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা এবং তার প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে এখন ভোটের ময়দানে। দেশে যতগুলো রাজনৈতিক দল রয়েছে তারা ৮০ শতাংশই রাজনৈতিক কাযর্ক্রম ধমের্ক ব্যবহার করে চালায়। যা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদির্শকতার সঙ্গে সাংঘষির্ক কারণ মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জনযুদ্ধ। রাষ্ট্রেরও নিজস্ব একটা ধমর্ থাকে বা থাকতে হবে তার প্রমাণ করেছিল এ দেশের দ্বিতীয় স্বৈরশাসক লে. জে. হু. মু এরশাদ। ৯০-এর গণআন্দোলনে এরশাদ সরকার পতিত হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হন। তবে এ ঘৃণার পাত্র হিসেবে তাকে বেশিদিন থাকতে হয়নি। তিনিও সমাদৃত হতে শুরু করেন সেই গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা। ১৪ দলের এই জোট আর এরশাদের জোট এই নিয়ে নিবার্চনী আওয়ামী লীগের যে জোটটি গঠিত হয়েছে তা মহাজোট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তা ছাড়া মহাজোট হেফাজতেরও নৈকট্য লাভ করেছে। ৫ মের সেই দানবীয় শক্তি নিবার্চনী ডামাডোলে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিতে পরিণত হয়েছে। অথচ হেফাজতে ইসলামই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে এবং গণজাগরণ মঞ্চের কমর্কাÐ বন্ধ করতে রাজধানীর মতিঝিলে দানবীয় উল্লাসে মেতে উঠেছিল, হেফাজতের দানবীয় পৈশাচিকতার হাত থেকে ইসলাম ধমের্র পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরিফ রক্ষা পায়নি, ৫ মের হেফাজতের তাÐবে বায়তুল মোকাররমের ফুটপাতে বিক্রি করার জন্য রাখা অসংখ্য কোরআন শরিফ পুড়ে ছাই হয়। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, মান্না রবের নেতৃত্বে গঠিত ঐক্যজোট, এবং ড. কামাল হোসেনের গণ ফোরাম নিয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল নেতা হলেন ড. কামাল হোসেন। তিনি ১৯৭২ সালের অসাম্প্রদায়িক সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল চালিকাশক্তি বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। বিশ দলের রয়েছে জামায়াত। যদিও জামায়াত নিবন্ধন হারিয়েছে তবে তার রাজনৈতিক তেজ বা শক্তির লোপ পায় নাই জামায়াতের বিভিন্ন স্তরের কমীর্রা ২০ দলের হয়েই রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজ করছে। তাই বলা যায়, ২০ দলের মূল আবরণটা ঘিরে রয়েছে জামায়াত। ১৯৭৫ সালের পরবতীর্ সময়ে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয় বিএনপির মাধ্যমে, ইঘচ রঃং ংবষভ রং ভঁহফধসবহঃধষরংস ঢ়ধৎঃু তাই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের জন্ম হয় বিএনপির আমলে। দেশের প্রথম স্বৈরশাসক মে. জে. জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের মোড়কে এ দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনবাির্সত করে এবং বহু যুদ্ধাপরাধীদের নিজ দল বিএনপির অন্তভুর্ক্ত করে। দেশের অসাম্প্রদায়িক সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যখন একটি সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে তখন অসাম্প্রদায়িকতার কথাটি রাজনৈতিক অঙ্গনে হারিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। মে. জে. জিয়ার হাত ধরে এ দেশে জামায়াতে ইসলামী তার পুনজের্ন্মর (১৯৭১ সালের মহামুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার মধ্যদিয়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক মৃত্যু হয়) রাজনৈতিক পথচলা শুরু করে। জিয়ার রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী ভাবনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবতের্ ধমীর্য় জাতীয়তাবাদ স্থান করে নেয়। জিয়ার বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ বপন করেন। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একটি অসাম্প্রদায়িক দল ছিল তাই আওয়ামীবিরোধী একটি প্লাটফমর্ তৈরি করতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই নিজ প্লাটফমের্ জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একত্রিত করেন। সুতরাং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিকাগার বললে ভুল বলা হবে না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে যে প্লাটফমির্ট হয়েছে মূলত তা এ দেশের সাম্প্রদায়িক এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয়স্থল। তবে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক জোটই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে বিশ্বাসী। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে রয়েছে অসাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের কথা কিন্তু বতর্মানের রাজনৈতিক দলগুলোর কমর্কাÐে তার ছাপ দেখা যায় না। নিবার্চন প্রাক্কালে আবার রাজনৈতিক জোটগুলো দেশে অন্য যে ধমর্গুলো রয়েছে যাদের জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০-১৫ শতাংশ তাদের ভোট পাওয়ার জন্যও ব্যাকুল। তাই তাদের মুখেও অসাম্প্রদায়িকতার কথা শোনা যায়। তা ছাড়া এক জোট অন্যজোটকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। আওযামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মুখপাত্র আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সাম্প্রদায়িক ফ্রন্ট হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ফ্রন্ট নিজেদের ৭১-এর চেতনার সোল এজেন্ট হিসেবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে মুখে তারা আবার উভয় জোটই অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলছেন। দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিকগোষ্ঠীর ধমীর্য় রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত তারাই আবার অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে। দুই জোটের কমর্কাÐ দেখে লালন সাইজির একটি গানের কথা মনে পড়ে যায়, তা হলো ‘এক কানা কয় আরেক কানারে, চল এবার ভবের পারে, নিজে কানা পথ চেনে না, পরকে ডাকে বারবার, এসব দেখি কানার হাটবাজার’। সাম্প্রদায়িকতা লালন করে নিবার্চনে যারা বৈতরণী পার হবে তাদের দিয়ে কোনো দিন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সৃষ্টি হবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদশের্র সঙ্গে সাংঘষির্ক সব ধরনের রাজনৈতিক কমর্কাÐ এ দেশে নিষিদ্ধ করা দরকার। এ দেশে কোনো সাম্প্রদায়িকতার বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেয়া উচিত নয় কারণ মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিশ্বাসে। বতর্মানে এ দেশে প্রগতি মোড়কে যে সাম্প্রদায়িকতা বিরাজ করছে তার ফলে যে কোনো সময় সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হতে পারে। এ দেশে মৌলবাদী সন্ত্রাসীগোষ্ঠী প্রগতির মোড়কের ভিতর থেকে নিজেদের শক্তি সঞ্চার করছে তাই ভবিষ্যতের কোনো এক সময় বাংলাদেশের অবস্থা আফগান বা পাকিস্তানের রূপ নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিকরা একটি প্লাটফমের্ সমবেত হয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অঙ্গন প্রতিষ্ঠা কাযর্ক্রম চালানোটা জরুরি হয়ে উঠেছে। তাই এই বিষয়টি ৭১-এর পক্ষের শক্তি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেয়াটা প্রয়োজন। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক