পাঠক মত
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ও বাস্তবতা
প্রকাশ | ২১ জুলাই ২০২২, ০০:০০
অনলাইন ডেস্ক
শিক্ষক মর্যাদায় বাবা-মায়ের তুল্য। আমরা বাবা-মাকে যেভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করি, তেমনি শিক্ষকও আমাদের থেকে সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য। বাবা-মায়ের কল্যাণে আমরা দুনিয়াতে এলেও সৎ ও আদর্শবান মানুষ হিসেবে আমাদের গড়ে তোলার কারিগর শিক্ষক। কোনো মানুষ যদি শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাও যায়, তিনিও কারও না কারোর কাছ থেকে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা পান। চলার পথে করণীয় ও বর্জনীয় কাজের রূপরেখা পান। যিনি শিক্ষা দেন ও ছাত্রের শিক্ষা গ্রহণে সামনে থেকে সহায়তা করেন, তিনিই শিক্ষক, তিনিই গুরুজন। তিনিই আমাদের মতো ও নিষ্ঠাবান মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মানবজাতির শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাসুলুলস্নাহ (সা.) বলেন যে, দুই ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারও পদ গৌরব বা লোভনীয় নয়। তা হলো ১) ধনাঢ্য ব্যক্তি, যাকে আলস্নাহ ধনসম্পদ দান করেছেন এবং তা সৎ পথে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন, ২) ওই ব্যক্তি, যাকে আলস্নাহ বিদ্যা দান করেছেন এবং সে অনুসারে সে কাজ করে ও অপরকে শিক্ষা দেয় (বুখারি: ৭১)। অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে 'আলস্নাহ ও রাসুল (সা.)-এর পরে ওই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব যে জ্ঞান অর্জন করে ও পরে তা প্রচার করে।
শিক্ষা গুরুর মর্যাদা অসীম হলেও বর্তমানে শিক্ষকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষকদের শারীরিক-মানসিকভাবে হেনস্তা করা এমনকি হত্যাকান্ডের ঘটনাও ঘটছে। ছাত্র কর্তৃক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার পেছনে অনেক সময় স্থানীয় রাজনীতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনীতি কিংবা শিক্ষকদের মধ্যে কোন্দল জড়িত থাকলেও ছাত্রদের মধ্যে এখন আর আগের মতো শিক্ষককে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার মানসিকতা ততটা নেই। ছাত্র কর্তৃক শিক্ষককে মান্য না করার চলমান সংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠেনি কিংবা এটি একক কোনো বিষয় নয় বরং বাবা-মায়ের আদেশ নিষেধ না মানা, এলাকার বড়দের সম্মান না করা, কেউ ভুল দেখে শাসন করলে তাদের মান্য না করার ঘটনাবলির ফলেই একজন ছাত্র কর্তৃক শিক্ষককে শারীরিক-মানসিক হেনস্তার ঘটনা ঘটছে অহরহ। বড়দের সম্মান না করার বর্তমান নষ্ট সংস্কৃতির বলি হচ্ছে শিক্ষকরাও। শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যকার এমন বৈরী সম্পর্ক ও পরিস্থিতি বিগত একযুগ আগেও ছিল না, যখন থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের শারীরিক আঘাত এবং বিভিন্ন উপায়ে মৃদু শাসন বন্ধ করা হয়েছে, তখন থেকেই ধীরে ধীরে বেপরোয়া হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা। কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির বিস্তার এবং স্থানীয় রাজনীতিতে স্কুলের শিক্ষার্থীরাও জড়িত হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমার কিছুই হবে না, বড় ভাই আছে, বাবার কাড়ি কাড়ি অর্থ আছে, আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি, এমন মানসিকতার বলে হচ্ছে স্বয়ং শিক্ষকরাও।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে শিক্ষার্থীদের হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, চক বা ডাস্টার-জাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেওয়া ও চিমটি কাটা, শরীরের কোনো স্থানে কামড় দেওয়া, চুল টানা বা কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা ও মোচড় দেওয়া, ঘাড় ধাক্কা দেওয়া, কান টানা বা ওঠ-বস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করে রাখা, রোদে দাঁড় করে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং শিক্ষার্থীদের দিয়ে শ্রম আইনে নিষিদ্ধ এমন কোনো কাজ করানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে 'শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১১' নামে নীতিমালা জারি করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক মানসিক শাস্তিকে সংবিধান পরিপন্থি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তবে শিক্ষার সঙ্গে শাসন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বর্তমান বাংলাদেশের সব মাধ্যমে যত সফল, গুণীজন-নামিদামি ব্যক্তিরা আছে, তাদের সবাই শিক্ষকের শাসনের শিকার হয়েছেন।
শিক্ষা ও শাসন একই সূত্রে গাঁথা। শাসন ছাড়া যে শিক্ষা প্রদান করা হয় তাহা সুশিক্ষা নয়। শিক্ষকের কাছে যখন ছাত্রকে শাসনের অধিকার থাকে না, তখন শিক্ষা প্রদানের জন্য ছাত্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পড়া না শিখলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনৈতিক কোনো কাজ করলে কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অমান্য করলে শিক্ষক শাসন করবে, এই ভয়টাই উঠে গেছে শিক্ষার্থীদের মন থেকে। ফলে বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষকদের আন্তরিকতা, সম্মান ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক বিনষ্ট হতে যাচ্ছে। একথা ঠিক যে, কখনো কখনো শিক্ষকরাও শাসনের নামে বর্বোরোচিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন- যা কাম্য নয়। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রকে বর্বোরোচিত শাসনের কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে বিবেচনা করলে শাসন শিক্ষার্থীর জন্য আশীর্বাদ। শিক্ষকরা পাঠদানকালীন শিক্ষার্থীদের নূ্যনতম শাসন করার অধিকার রাখতে পারলে ছাত্র-শিক্ষক্ষের মধ্যে আন্তরিকতা, সম্মান ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং সুশিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ জাতি গঠন কঠিন কাজ হবে না।
জুবায়ের আহমেদ
ঢাকা