আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও বঙ্গবন্ধু

তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

প্রকাশ | ২৯ জুলাই ২০২২, ০০:০০

আর কে চৌধুরী
১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে- যা ইতিহাসে 'আগরতলা মামলা' বা 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' নামে সুপরিচিত। সরকারি নথিতে অবশ্য এর নাম ভিন্ন ছিল। এর নাম ছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য' মামলা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। \হনিরাপত্তা আইনে ১৯৬৬ সালের ৯ মে থেকে জেলে আটককৃত শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যের জেল থেকে মুক্তি দিয়ে সামরিক আইনে পুনরায় গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে প্রথমে কোর্ট মার্শাল করার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচনের কথা মনে রেখে পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও উচ্চপদস্থ বাঙালি অফিসারদের বেসামরিক আইনে অভিযুক্ত করে। এ মামলায় অভিযুক্ত যে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয় তারা হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, সাবেক এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ, সিডিআই নূর মোহাম্মদ, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফিজউলস্নাহ, সাবেক করপোরাল আবুল বাশার, মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, সাবেক হাবিলদার দলিল উদ্দিন, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক, ভূপতিভুষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, বিধানকৃষ্ণ সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, সাবেক হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, সাবেক ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. আবদুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহুরুল হক, মো. খুরশীদ, খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান সিএসপি, হাবিলদার আজিজুল হক, মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট শামসুল হক, শামসুল আলম এএমসি, ক্যাপ্টেন মো. আবদুল মোতালেব, ক্যাপ্টেন এ শওকত আলী মিয়া, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা এএমসি, ক্যাপ্টেন এ এন এম নুরুজ্জামান, সার্জেন্ট আবদুল জলিল, মো. মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, লে. এস এম এম রহমান, সাবেক সুবেদার এ কে এম তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ এএমসি এবং লে. আবদুর রউফ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে সাধারণ জনতা। প্রবল গণ-আন্দোলন তথা উত্তাল ঊনসত্তরের গণ-অভু্যত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সরকার পিছু হটতে শুরু করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে একান্ত বাধ্য হয়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্যের মুক্তির দাবি করেছিল। ফলশ্রম্নতিতে, সরকারপ্রধান হিসেবে আইয়ুব খান সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রম্নয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব কারাবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়। পরের দিন, ২৩ ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৬৯ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ মামলায় অভিযুক্তদের এক গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। একই দিনে শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ উপাধিতে ভূষিত করেন তৎকালীন ডাকসু ভিপি এবং সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ। 'ঊনসত্তরের গণ-অভু্যত্থান' নামক এই গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটে এবং ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া খান। ঐতিহাসিকরা এই মামলা এবং মামলা থেকে সৃষ্ট গণ-আন্দোলনকে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পেছনে প্রেরণাদানকারী অন্যতম প্রধান ঘটনা বলে গণ্য করে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্যবাদী মনোভাব শুরু থেকেই ছিল। বাঙালিরা ছিল শোষিত ও নির্যাতিত। এই শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে। এর আগে ১৯৬৬ সালেই শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করেন- যা বাঙালির মুক্তি সনদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। আগরতলা মামলার বিচারকাজ চলার সময় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বাঙালির আস্থা আরও বৃদ্ধি পায়, স্বাধীনতাকামী বাঙালি তাদের নেতার বিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সারাদেশে হরতাল, অবরোধের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতি গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা কারফিউ ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে। এর মধ্যে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে এই মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই খবর বাইরে এলে সারাদেশে আন্দোলনের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আসাদ, নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর শামসুজ্জোহার মতো মুক্তিকামী বাঙালিদের হত্যার ঘটনায় গোটা পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠে। এই গণ-আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা আইয়ুব সরকারের ছিল না। একপর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আইয়ুব সরকার দেশে আসন্ন একটি গৃহযুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা হিসেবে মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। আগতলা বাংলা ও বাঙালির অতীত এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সীমান্ত ঘেঁষা ক্ষুদ্র ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী, আমাদের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ভারতীয় ঠিকানা। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য ত্রিপুরার আগরতলা। ত্রিপুরার মহারাজাদের বাঙালি-প্রীতি ইতিহাসের সম্পদ। রবীন্দ্র সাহিত্যের একটি অংশ জুড়ে আছে ত্রিপুরার রাজা-মহারাজা আর তাদের অতীত জীবন। আগরতলা, এক অর্থে ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অলিখিত রাজধানী। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকামীদের প্রথম এবং সহজতম আশ্রয়স্থল ছিল ত্রিপুরার আগরতলা। বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, যে মামলাকে কেন্দ্র করেই ফাঁসিতে ঝোলানোর চেষ্টা করা হয়েছিল জাতির পিতাকে। বিস্ময়করভাবে সেই আগরতলাই হয়ে উঠল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ডেডলাইন। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। ত্রিপুরার ভৌগোলিক অবস্থান অদ্ভুতভাবে গাথা বাংলাদেশের সঙ্গে। ভারতের অন্যান্য অংশ যেখানে একদিক থেকে বেঁধে রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ তিন দিক থেকে আলিঙ্গন করে আছে ত্রিপুরাকে। ত্রিপুরার ৯১৭ কিলোমিটার সীমান্তের ৮৩৯ কিলোমিটারই বাংলাদেশের সঙ্গে। রাজধানী আগরতলা, যেখানে আর্যদের পা পড়েনি, আসেনি কোনো বিদেশি। সারা বাংলায় যখন বাংলাভাষার সরকারি মর্যাদা ছিল না, ইংরেজি ও ফার্সি যখন সবকিছুর ওপর দাঁড়িয়ে ত্রিপুরার রাজভাষা তখনো বাংলা। পাহাড়ি ত্রিপুরার যে হৃদ্যতা, সেই হৃদ্যতা ক্রমশ বাড়া বৈ কমেনি। মহারাজাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা যেমন ইতিহাস তেমনি ১৯৭১-এর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধেপরবর্তী প্রজন্মের ত্রিপুরাবাসীর তেমন ইতিহাস। ১৯৭১ সালে সমগ্র ত্রিপুরার জনসংখ্যা ছিল ১৫.৫৩ লাখ অথচ ত্রিপুরা ধারণ করেছিল ১৩.৪২ লাখ বাংলাদেশ ত্যাগী শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা। আর কে চৌধুরী :মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ