ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিচিতি

বাংলাদেশে বর্তমানে যে জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত, সেগুলো হলো : চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মগ, কুকি, লুসাই, পাংখো, বনযোগী, খুমি, গারো, হাজং, মণিপুরী, পাঙ্গন, খাসিয়া, সাঁওতাল, ওরাও, রাজবংশী প্রভৃতি ২৯টি জনগোষ্ঠী। এসব জনগোষ্ঠীতে ধর্মীয় দিক থেকে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টান এমনকি ইসলাম ধর্য়ের অনুসারীও রয়েছে (মৌলভীবাজার জেলায় প্রায় ৩০ হাজার মুনিপুরী/পাঙ্গন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মুসলিম ধর্মাবলম্বী)।

প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

এম রুহুল আমিন
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু দিন যাবত উপজাতিদের সঠিক পরিচিতি নিয়ে নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একটি বিশেষ মহল বারবার বিষয়টিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে পরিস্থিতিকে বেসামাল করতে উঠে পড়ে লেগেছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নিয়েই এ প্রপাগান্ডা চলে বেশি। ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, সমতলের ক্ষুদ্র্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক সম্প্রদায় হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের ভূখন্ডে বসবাস করে আসছেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, তারা বিভিন্ন সময় দফায় দফায় বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রবেশ করে বসবাস করছে। আর তা কোনোভাবেই ৪শ' বছরের বেশি নয়। বাংলাদেশে তারা অভিবাসী। ঐতিহাসিক তথ্য সূত্রানুযায়ী, তারা বাংলাদেশের আদিবাসী না হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করছে। অপরদিকে, আদিবাসীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না মর্মে জাতিসংঘের সঙ্গে পশ্চিমারা সম্প্রতি খুব হইচই শুরু করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, জাতিসংঘের যেসব সদস্য দেশে আদিবাসী রয়েছে, তাদের এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। অন্যদিকে, জাতিসংঘ পশ্চিমাদের বিশেষ কূটকৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাদামি এবং কালো চামড়ার দেশগুলোর ওপর নৈতিকতার দোহাই দিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক প্রণীত কনভেনশন-১৬৯ চাপিয়ে দিতে চাইছে। এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এই সনদে স্বাক্ষর করার চাপ দিচ্ছেন। তাই ইতিহাসভিত্তিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুসারে বাংলাদেশে আদিবাসী অভিধাযোগ্য কোনো জনগোষ্ঠী আছে কিনা, তা পর্যালোচনা করা অতি জরুরিভাবে দরকার। নিম্নে এ পর্যালোচনা তুলে ধরা হলো: বাংলাদেশে বর্তমানে যে জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত, সেগুলো হলো : চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মগ, কুকি, লুসাই, পাংখো, বনযোগী, খুমি, গারো, হাজং, মণিপুরী, পাঙ্গন, খাসিয়া, সাঁওতাল, ওরাও, রাজবংশী প্রভৃতি ২৯টি জনগোষ্ঠী। এসব জনগোষ্ঠীতে ধর্মীয় দিক থেকে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টান এমনকি ইসলাম ধর্য়ের অনুসারীও রয়েছে (মৌলভীবাজার জেলায় প্রায় ৩০ হাজার মুনিপুরী/পাঙ্গন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মুসলিম ধর্মাবলম্বী)। তারা রাষ্ট্রের সাধারণ মানবমন্ডলী তথা নাগরিকমন্ডলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ, যাদের কল্যাণে ও উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে অন্যান্য নাগরিকের মতোই। এখানে এ মুহূর্তে যে বিষয়টা গুরুত্ববহ সেটা হলো, নৃ-বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানের স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুসারে উপরে বর্ণিত জনগোষ্ঠীকে ভূমিজ সন্তান বলা যায় কিনা? এসব উপজাতিদের নিজস্ব যে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়, তাতে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে যে, তাদের পূর্বপুরুষরা অদূর অতীতে বাংলাদেশের সীমানার বাইরে অপরাপর রাজ্য কিংবা অঞ্চল থেকে রাজনৈতিক কারণে এবং বিশেষ করে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে। তারা সবাই কোনো না কোনো ধর্মানুসারী ছিল, সভ্য জীবনযাপন করত, রাজ্যশাসন করত, প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ এবং যুদ্ধে হেরে বাংলাদেশের কোনো না কোনো স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা উলেস্নখযোগ্য। স্বীকৃত সব নৃ-তত্ত্ববিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এরা কোনোভাবেই, কোন সংজ্ঞায় 'আদিবাসী' হিসেবে অভিহিত হতে পারে না। আদিবাসী বলতে কী বোঝায় : ইংরেজি ওহফরমবহড়ঁং শব্দটির বাংলা হচ্ছে আদিবাসী। 'অ ঢ়বৎংড়হ ড়ৎ ষরারহম :যরহম :যধঃ যধং বীরংঃবফ রহ ধ পড়ঁহঃৎু ড়ৎ পড়হঃরহবহঃ ংরহপব :যব বধৎষরবংঃ :রসব শহড়হি :ড় ঢ়বড়ঢ়ষব'. অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে কোনো এলাকার বিশেষ জনগোষ্ঠী যদি ওই এলাকায় বসবাস করে তাহলে তাদের ওই এলাকার আদিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। ওহফরমবহড়ঁং শব্দটির অর্থ হচ্ছে ঘধঃরড়হ নড়ৎহ ড়ৎরমরহধঃরহম ড়ৎ ঢ়ৎড়ফঁপবফ হধঃঁৎধষষু রহ ধ পড়ঁহঃৎু, হড়ঃ রসঢ়ড়ৎঃবফ. \হঅর্থাৎ আদিবাসী হতে হলে অভিবাসী হলে হবে না, বরং সত্যিকারভাবে একটি দেশে প্রাচীনকাল থেকে উৎপত্তি হতে হবে। এ ব্যাপারে আমেরিকার প্রখ্যাত নৃ-তত্ত্ববিদ লুইজ মর্গান আদিবাসীকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে, 'ঞযব অনড়ৎরমরহধষং ধৎব :যব মৎড়ঁঢ়ং ড়ভ যঁসধহ ৎধপব যিড় যধাব নববহ ৎবংরফরহম রহ ধ ঢ়ষধপব ভৎড়স :রসব রসসবসড়ৎরধষ ু ঞযবু ধৎব :যব ঝড়হং ড়ভ :যব ংড়রষ'. আদিবাসী হতে হলে একটি বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য থাকতে হবে- যা হলো ' ভূমিপুত্র' বা 'ঝড়হং ড়ভ :যব ংড়রষ'. জাতিসংঘ থেকে টঘচঋওও (টহরঃবফ ঘধঃরড়হ চবৎসধহবহঃ ঋড়ৎঁস ভড়ৎ ওহফরমবহড়ঁং ওংংঁবং)- এর মাধ্যমে কারা আদিবাসী হবে তার একটি মানদন্ড ঠিক করা হয়েছে। জাতিসংঘ কমিশনের স্পেশালর্ যাপটিয়ার হোসে মার্টিনেজ কোবে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, 'কোনো ভূখন্ডের আদিবাসী সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠী বা জাতি বলতে তাদের বোঝায়, যাদের ওই ভূখন্ডে প্রাক-আগ্রাসন এবং প্রাক-উপনিবেশকাল থেকে বিকশিত সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে, যারা নিজেদের ওই ভূখন্ডে বা ভূখন্ডের কিয়দাংশে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক জনগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। সেই সঙ্গে তারা নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পূর্বপুরুষের ভূখন্ড ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ'। জাতিসংঘের সংজ্ঞায় মূলত তিনটি বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে- যা হলো : ১. যারা কোনো উপনিবেশ স্থাপনের আগে থেকেই ওই ভূখন্ডে বাস করছিল, ২. যারা ভূখন্ডের নিজস্ব জাতিসত্ত্বার সংস্কৃতি ধরে রেখেছে এবং তা ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ৩. যারা নিজেদের স্বতন্ত্র মনে করে। এই সংজ্ঞাসমূহের আওতায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকরা সত্যিকার অর্থে কারা আদিবাসী তার উদাহরণ দিতে যেয়ে বলেছেন যে, খর্বাকৃতি, স্ফীত চ্যাপ্টা নাক, কুঁকড়ানো কেশবিশিষ্ট কৃষ্ণবর্ণের 'বুমেরাংম্যান'রা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী বা যথার্থ অ্যাবোরিজিন্যালস। তারা ওখানকার ভূমিপুত্র বটে। ঠিক একইভাবে মাউরি নামের সংখ্যালঘু পশ্চাৎপদ প্রকৃতিপূজারি নিউজিল্যান্ডের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সেখানকার আদিবাসী। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা এসব সংজ্ঞার অন্তর্ভূত নয়। তারা বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে চট্টগ্রাম তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছে ১৭শ খ্রিষ্টাব্দ ও ১৮শ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ের দিকে। উপরোক্ত সূত্রের আলোকে অবশ্যই বলা যায়, একমাত্র বাঙালিরাই এই এলাকার আদিবাসী, যারা ব্রিটিশ কলোনি স্থাপনের আগে তো বটেই, সেই প্রাচীনকাল থেকে বংশ পরম্পরায় ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, স্বতন্ত্র, সামাজিকতা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত স্বতন্ত্রবোধ বজায় রেখেছে। সে হিসেবে বাঙালিরাই এখানকার একমাত্র 'ভূমিপুত্র'। এখানে আরেকটা কথা উলেস্নখ্য যে, ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশরা সেটেলমেন্ট কলোনাইজেশন না করায় এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা বাঙালিদের কখনই মূল ভূখন্ড থেকে উৎখাত করার পরিকল্পনাতো দূরের কথা, এমনকি বাঙালিদের ভাষা, কৃষ্টি, কালচার এর ওপরও কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি। সুতরাং, এই বিবেচনায়ও বাঙালিরাই এই এলাকার প্রাচীনতম ও একমাত্র আদিবাসী। এ ক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলাদেশের সমতলে কিংবা পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিচয় তাহলে কী হবে? আদিবাসীর সংজ্ঞা ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে এটাই বোঝা যায় যে, সমতলে কিংবা পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগুলো বহিরাগত এবং তারা অভিবাসী জনগোষ্ঠী, কোনো কোনো গোষ্ঠীকে উপজাতি বলা যায়। তবে কোনোভাবেই আদিবাসী নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে জনবসতির সূত্রপাত এবং যে কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আদিবাসী নয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বৃহত্তর চট্টগ্রামেরই অংশ। প্রশাসনিক কারণে ইংরেজ শাসানমলে চট্টগ্রামের পূর্বের অরণ্য এলাকাটি পৃথক করে এর নামকরণ করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। পৃথক হওয়ার পূর্বে থেকে সমগ্র চট্টগ্রাম জুড়েই চট্টগ্রামীরা বসবাস করে আসছে। এমনকি মোগল শাসনামলে সীমান্ত পাহারায় রাঙ্গামাটিতেও একটি সামরিক দুর্গ ছিল। এই দুর্গকে কেন্দ্র করে আশপাশে বিপুলসংখ্যক চট্টগ্রামী বসবাস করত। সে বিষয়ে মোগল শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তে স্পষ্টই জানা যায়। চট্টগ্রামীরা বনজসম্পদ আহরণে অরণ্যে যাতায়াত করত এবং কর্ণফুলি নদীর তীরবর্তী কোনো কোনো এলাকায় ব্যবসাবাণিজ্যও গড়ে তুলেছিল। এমনই সময় অর্থাৎ ১৬শ' খ্রিষ্টাব্দের দিকে উত্তরাংশে অর্থাৎ আজকের খাগড়াছড়ি এলাকায় কিছুসংখ্যক ত্রিপুরা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে এসে গহিন অরণ্যে জুম চাষাবাদ শুরু করে। এছাড়া আসামের মিজোরামের অরণ্য থেকে কুকি নামক এক উলঙ্গ জাতিও মাঝে মধ্যে বিচরণ করত চট্টগ্রামের এই অরণ্য পথে। তারা কিছুদিন এদিক সেদিক ঘুরে-ফিরে আবার চলে যেত মিজোরামে। স্থানীয় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসবিদ ও জাতীয় পর্যায়ের ইতিহাসবিদদের লিখিত ইতিহাস অনুযায়ী দেখা যায়, ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আরাকান থেকে বিতাড়িত একদল চাকমা সর্বপ্রথম নাফ নদী পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের কক্সবাজারে রামু থানার অদূরে নদী তীরে অবস্থান নেয়। তারা সেখানে সল্প সময় অবস্থানের পর গভীর অরণ্যে (বর্তমান আলীকদম উপজেলা) চলে যায়। চাকমারা কেন রামু থেকে আলীকদম এবং আলীকদম থেকে রাঙ্গামাটির দিকে এলো তার একটা ঐতিহাসিক ও ধারাবাহিক তাৎপর্যও পাওয়া যায়। তা হলো: ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ সুজা আপনভাই সম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামের প্রাচীন বন্দর শহর দেওয়াঙ-এ (বর্তমানে আনোয়ারা উপজেলা) আশ্রয় নেয়। একপর্যায়ে তিনি তার অনুগত ১৮ জন সেনাপতির নেতৃতে সেনাবাহিনীকে রামুতে রেখে শুধু তার নিকটাত্মীয়দের নিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আরাকানের রাজধানীতে যান। উলেস্নখ্য যে, প্রায় একই সময়ে আরাকান থেকে বিতাড়িত চাকমাদের প্রথম দলটি রামুর নদী তীরে (চাকমারকুল) অবস্থান নিয়েছিল। সে সময়ে মোগল সৈনিকদের সঙ্গে চাকমা শরণার্থীদের যোগাযোগ ঘটে। এদিকে, আরাকানের রাজধানীতে আশ্রয়ের কিছু সময়ের মধ্যে আরাকানের তৎকালীন তরুণ রাজা সুবেদার শাহ সুজার এক কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সুজা তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে আরাকানের রাজার সঙ্গে বাকবিতন্ডা ও ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে আরাকানের রাজার হাতে সপরিবারের নিহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রামুতে অবস্থানরত মোগল যোদ্ধাদের সঙ্গে আরাকানী সৈনিকদের খন্ড খন্ড যুদ্ধ বেঁধে যায় এবং মোগল যোদ্ধারা রামু ত্যাগ করে পূর্বে গভীর অরণ্যে গিয়ে পুনরায় দুর্গ স্থাপন করে। মোগল যোদ্ধারা ইসলামের অন্যতম খলিফা হযরত আলী (রাঃ)-এর অনুসারী শিয়া সম্প্রদায়ের হওয়ায় তারা হযরত আলীর নামানুসারে ওই এলাকার নামকরণ করেন 'আলীকদম' (বর্তমানে আলীকদম উপজেলা)। মোগলযোদ্ধাদের পিছু পিছু চাকমারকুলের চাকমারাও চলে যায় আলীকদমে। মূলত এখানেই নারীবিহীন মোগল যোদ্ধাদের সঙ্গে চাকমাদের এমন এক সমাজ গড়ে ওঠে যাতে বহু মোগলযোদ্ধা চাকমা রমণী বিয়ে করে সংসার জীবনও শুরু করে। এদিকে সহোদর শাহ সুজা হত্যাকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে দিলিস্নর সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেনাপতি শায়েস্তা খাঁকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করে বাংলায় পদার্পণ করেন। ১৬৬৬ সালের প্রথম দিকে শায়েস্তা খাঁ আপন পুত্র উমেদ খাঁকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে আরাকানের অভিযানের নির্দেশ দেন। ২৭ জানুয়ারি, ১৬৬৬ তারিখে মোগলরা ব্যাপক হতাহতের মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রাম বিজয় করে নেয়। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর প্রধান সেনাপতি উমেদ খাঁ চট্টগ্রামের নবাব হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন এবং আলীকদমে আশ্রিত মোগলদের মাধ্যমে কার্পাস-কর প্রদানের শর্তে আলীকদমে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। আর এ জমিদারির প্রজা হয় বার্মা থেকে বিতাড়িত সেই জুমিয়া চাকমারা। এভাবেই চলছিল কয়েক বছর। পরবর্তী সময়ে মোগল ও আরাকানিদের অব্যাহত খন্ড খন্ড যুদ্ধের কারণে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল ওই সময় 'নো-ম্যান্সল্যান্ড' নামে অভিহিত হয়। ওই এলাকা চট্টগ্রামের নবাবের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকলেও সেখানকার জমিদার শের জালাল খাঁ নিকটবর্তী আরাকানিদের বারংবার হামলার কারণে আরাকানীদের সঙ্গে মিত্রতা ও তাদের পক্ষাবলম্বন করেন এবং চট্টগ্রামের তৎকালীন নবাব মীরহাদীকে কর না দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এতে চট্টগ্রামের নবাব ক্ষুব্ধ হয়ে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে জমিদার জালাল খাঁ'র প্রাসাদ ও যাবতীয় স্থাপনা ধ্বংস করে দেন। সেই সঙ্গে জুমিয়া চাকমাদের ওপরও হামলা চালিয়ে তাদের সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। ফলে অনন্যোপায় জালাল খাঁ আরাকানের অভ্যন্তরে গিয়ে আশ্রয়গ্রহণ করেন। সেখানেও তিনি আরাকানিদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। জুমিয়া চাকমারাও প্রাণ রক্ষার্থে নানাস্থানে আশ্রয় নেয়। সে সময় চট্টগ্রামের দেওয়াঙে (আনোয়ারায় থানা) বসবাসরত জালাল খাঁ'র সহযোদ্ধা সেনাপতি শেরমস্ত খাঁ'র ছিল বিশাল প্রতিপত্তি যিনি ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণে চকরিয়া-রামু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূমির জমিদারি লাভ করেছিলেন। আলীকদম ট্র্যাজেডির ১৩ বছর পর ওই শেরমস্ত খাঁ-ই মোগল নবাব জুলকদর খানের কাছ থেকে রাঙ্গুনিয়ার কোদালা-পদুয়া এলাকা (বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার একাংশ) বন্দোবস্তি এবং পার্বত্য অঞ্চলের জুমকর আদায়ের তহশিলদারি লাভ করেন। সেখানে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত আলীকদম থেকে সহযোদ্ধা মোগল সৈনিক ও তাদের পরিবার-পরিজন এবং জুমিয়া চাকমা প্রজাদের নিয়ে এসে বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। উদ্বাস্তু এসব চাকমারা শেরমস্ত খাঁর খামার আবাদে নিয়োজিত হয়। উলেস্নখ্য যে, সপ্তদশ শতাব্দীতে শেরমস্ত খাঁর অনুসারী হয়ে কোদালা, পদুয়ায় আগত চাকমারা অনেকে মোগলদের ধর্ম গ্রহণ করে। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার নবাব মীর কাসিম ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে চট্টগ্রামের শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ প্রশাসকরা রাঙ্গুনিয়ার কোদালা-পদুয়া থেকে অনতিদূরে সাঙ্গু নদী এবং সীতাকুন্ডের নিজামপুর রোড পর্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে পদুয়া-কোদালার জমিদারির সীমানা নির্দেশ করে দিয়েছিলেন যার দায়িত্বে ছিলেন শেরমস্ত খাঁর উত্তরসূরি শের জব্বার খাঁ। তিনি মোগল শাসামলের নিয়মেই ইংরেজদের কর প্রদান করতে থাকেন এবং ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই কর প্রদান করেছিলেন। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বার্মার রাজা বোধপায়া ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে নাফ নদীর তীরবর্তী আরাকান রাজ্য আক্রমণ করে দখল করে নেয়। বর্মী সৈন্যদের নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের ফলে প্রাণ রক্ষার্থে হাজার হাজার মারমা, চাকমা ও অন্যন্য ক্ষুদ্র্র জনগোষ্ঠী নাফ নদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার আশ্রয় গ্রহণ করলে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এসব শরণার্থীদের কর প্রদানের শর্তে পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষের সুযোগ করে দেয়। আরাকান থেকে দ্বিতীয় দফায় আগত এ জনগোষ্ঠী চট্টগ্রামের অরণ্যে প্রবেশ করে চলে আসে পদুয়া-কোদালায় এবং পূর্বে আগত গোষ্ঠীগদ চাকমাদের সঙ্গে সহজেই মিশে যায়। ফলে এসব জুমিয়া চাকমা ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। প্রজার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইংরেজ কর্তৃপক্ষ জমিদারে ওপর করও বাড়িয়ে দেয়। তৎকালীন জমিদার জানবক্স খাঁ কর বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেন এবং কর প্রদান বন্ধ করে দেয়। তাতে সরকার তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালালে তিনি কলিকাতায় গিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন এবং পুনরায় জমিদারি পরিচালায় চুক্তিবদ্ধ হন। পুনরায় যাতে বিদ্রোহ না হয় সে জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে উত্তর রাঙ্গুনিয়ার সমতলভূমিতে জমিদারি কাচারি প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করে, তারই জমিদারবাড়ির নামানুসারে ওই এলাকার নামকরণ হয়ে যায় রাজানগর। রাজানগরে মোগল বংশজাত সর্বশেষ জমিদার বা চাকমাদের রাজা ছিলেন ধরমবক্স খাঁ। তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন চাকমা রমণী কালিন্দীর সঙ্গে এবং মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে মৃতু্যবরণ করেন। তার মৃতু্যর পর জমিদারির উত্তরাধিকার নিয়ে তারই স্বগোত্রীয় মীর্জা হোসেন খাঁর সঙ্গে রানী কালিন্দীর দ্বিমত দেখা দেয়। একদিকে মীর্জা হোসেন খাঁর নেতৃত্বে মোগল বংশজাত মুসলিমরা অন্যদিকে রাণী কালিন্দীর নেতৃত্বে চাকমা জুমিয়ারা। অপরদিকে বার্মা থেকে বিতাড়িত প্রায় ৪ হাজার বিদ্রোহী তঞ্চঙ্গ্যা রানী কালিন্দীর সঙ্গে যোগ দিয়ে চাকমাদের শক্তি বৃদ্ধি করত পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। ফলে এসব বাঙালি তথা মোগল পরিবারগুলো প্রাণভয়ে সমতলের দিকে ছুটে যায় এবং পার্বত্য জমিদারি পরিচালনায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে আদালত ধরমবক্স খাঁর স্ত্রী হিসেবে রানী কালিন্দীর পক্ষে রায় ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে রানী কালিন্দীর খড়গতলে শত বছরের মোগল জমিদারি মুসলিম পরিবারের হাতছাড়া হয়ে যায়। রানী কালিন্দী তার জমিদারিকালে মোগল ঐতিহ্য দেওয়ান পদবি বাতিল করে তদস্থলে তালুকদার নামক একটি নতুন পদ চালু করেন। তার উত্তরসূরি হরিশচন্দ্র পুনরায় মোগলদের সঙ্গে মামলায় জড়িয়ে পড়লে আদালত মোগলদের পক্ষে রায় দেয় (উলেস্নখ্য যে, বেশ কটি মোগল পরিবার আজও রাঙ্গুনিয়ায় বসবাস করে আসছে)। এতে হরিশচন্দ্র ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং নতুনভাবে বসবাস স্থাপন করেছিলেন রাঙ্গামাটিতে। এভাবেই ১৭শ-১৮শ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক চাকমা, মারমা এবং ক্ষুদ্র্র জাতিগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত হয়ে যায়। পূর্ববর্তী আলোচনায় নৃ-তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, পাহাড়ের বর্তমান ক্ষুদ্র্র নৃ- গোষ্ঠী হলো অভিবাসী। সুতরাং তারা চট্টগ্রাম তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের 'ভূমিপুত্র' না হওয়ায় আদিবাসী হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। বহিরাগত হওয়ার কারণে ইংরেজ সরকার তাদের নিজ শাসনাধীন মনে করতেন না। চট্টগ্রামের কমিশনার মি. হলহেড ১৮২৯ সালে মন্তব্য করেন যে, 'ঞযব যরষষ :ৎরনবং ধৎব হড়ঃ ইৎরঃরংয ংঁনলবপঃং নঁঃ সবৎবষু :ৎরনঁঃধৎরবং ধহফ :যধঃ বি ৎবপড়মহরুবফ হড় ৎরমযঃ ড়হ ড়ঁৎ ঢ়ধৎঃ :ড় রহঃবৎভবৎব রিঃয :যবরৎ রহঃবৎহধষ ধৎৎধহমবসবহঃ'. ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েলে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলকে নন-রেগুলেটড এরিয়া বা অশাসিত-এলাকা হিসেবে উলেস্নখ করে এবং ১৯২০ সালে এলাকাটিকে ঊীপষঁংরাব অৎবধ- হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার এলাকাটিকে একান্ত ঊীপষঁংরাব অৎবধ-এর পরিবর্তে উপজাতি এলাকা হিসেবে অভিহিত করে। যদি ১৯০০ সাল থেকেও ধরি তাহলে দেখা যাবে কোথাও কোন পর্যায়ে এ এলাকাকে আদিবাসী এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। ১৯৯৭ সালে যে শান্তিচুক্তি সারিত হয়েছে তাতেও স্থান পায়নি আদিবাসী শব্দটি। এমনকি এসব ক্ষুদ্র্র নৃ-গোষ্ঠী তাদের অধিকার আদায়ের দীর্ঘ বছরের সংগ্রামেও নিজেদের আদিবাসী হিসেবে উলেস্নখ করেছে এমন প্রমাণ কোথাও নেই। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক প্রণীত কনভেনশন-১০৭ (যা বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে) অনুসারেও এ এলাকায় কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী থাকলে তারা একমাত্র চাঁটগাইয়া বাঙালিরা (চট্টগ্রামের বাঙালি) ছাড়া আর কেউ নয়। \হ এম রুহুল আমিন :মানবাধিকার কর্মী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ পিসিএনপি