বাড়াতে হবে খাদ্য উৎপাদন

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
দেশের আমজনতার কাছে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় প্রত্যক্ষভাবে ভুগছে দেশের ১৪ থেকে ১৫ কোটি মানুষ। সরকারেরও প্রধান মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ সমস্যা। বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগায় চাল। চালের দাম বাড়লেই স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে যায় অন্য সব নিত্যপণ্য। মূল্যস্ফীতিতে সৃষ্টি হয় অপ্রতিরোধ্য গতি। এ বছর আগাম বন্যার কারণে চালের উৎপাদন কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। পরিণতিতে বেড়ে গেছে চালের দাম। ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম লাগামহীন বাড়লেও সরকার এ ব্যাপারে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে কার্পণ্য করছে না। একদিকে ভোজ্য ও জ্বালানি তেলের দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি, অন্যদিকে উচ্চ দামে চাল ও গম কিনতে গিয়ে সরকারকে দিশেহারা অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। তার পরও সার্বিক পরিস্থিতিতে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশলকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির এ প্রধান কারণটি ঠেকাতে চাল আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারের কৌশল বিবেচনায় আনা হচ্ছে। সরকারের এ কৌশল অর্থাৎ চাল আমদানি করে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা বাস্তবতার আলোকে যৌক্তিক তবে ভবিষ্যতের কথা মনে করে চালের উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়াতে হবে। চালের পাশাপাশি গম ও ভুট্টা চাষে উৎসাহ দিতে হবে। উৎপাদন খরচ কমাতে কৃষিকে পুরোপুরিভাবে যান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে যাতে কৃষক খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহী হয়। হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করার চেয়ে কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ অনেক বেশি লাভজনক। আমাদের বিশ্বাস, সরকার খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিকে তাদের অগ্রাধিকার কর্মসূচি হিসেবে নেবে। উৎপাদনের সুফল যাতে কৃষক ভোগ করে এমন কৌশলও উদ্ভাবন করা জরুরি। দারিদ্র্য বিমোচনে সস্তা দরে খাদ্য বিক্রি নয়, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় প্রতি ইঞ্চি জমির সদ্ব্যবহারের উপদেশ দিয়ে বসে থাকলে চলবে না, ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাও জরুরি। তা হলেই খাদ্য উৎপাদন বাড়বে। খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্যের লভ্যতা ও প্রাপ্তির বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যলভ্যতা প্রধানত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, বাণিজ্য ও মজুতের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর যেমন তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই বিশ্বের প্রায় ১৭০টি ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আমদানি করে। কিন্তু খাদ্য বণ্টনব্যবস্থায় যাতে কোনো ধরনের অসঙ্গতি তৈরি না হয় সে জন্য সরকারের ফুড এজেন্সি কর্তৃপক্ষ সার্বিকভাবে বিষয়গুলো নজরদারি করে। অভ্যন্তরীণ বণ্টনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং বণ্টনব্যবস্থা এমনভাবে করা হয় যাতে ক্রয়ক্ষমতা জনগণের হাতেই থাকে। কোভিডকালের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকেও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বণ্টনব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। বেশ কিছুদিন ধরেই দেশে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। বন্যার কারণে ধান উৎপাদন কম হয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্যে প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম বাড়াতে হবে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য পরিবহণ ও বিক্রয় নিশ্চিত করা, বিক্রেতার সঙ্গে ভোক্তার সংযোগ স্থাপনে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য হ্রাস করা জরুরি। নিশ্চিত করতে হবে বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পণ্যের ন্যায্যমূল্যও। উচ্চফলন ও লাভজনক লাগসই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও অবলম্বনের মাধ্যমে কৃষিতে অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষাকল্পে টেকসই কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ছোট ছোট খামারভিত্তিক চাষাবাদের কারণে প্রায়ই জমিতে উন্নত যন্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে সমবায়ের ভিত্তিতে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। পাশাপাশি ছোট খামার উপযোগী যন্ত্র উদ্ভাবন করতে হবে। টেকসই কৃষিব্যবস্থায় চাষাবাদের সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অন্যদিকগুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। টেকসই কৃষি এমনভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে যেন তা সম্পদ সাশ্রয়ী, সামাজিকভাবে সহায়ক, বাণিজ্যিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশবান্ধব হয়। টেকসই খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা অর্জনে সুষম ও টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা আবশ্যক। স্বল্প উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে অধিকতর খাদ্য উৎপাদন কৌশল বের করতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্যশস্যের অপচয় ও বিনষ্ট হওয়া থেকে রক্ষায় কার্যকর মজুত ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে গুদামের নিম্নমানের পরিবেশের কারণে পোকার আক্রমণে খাদ্যশস্য নষ্ট হয়। গুদামের পরিবেশের উন্নতি করতে হবে। রিমোট সেন্সিং টুল ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ও ফসলের ক্ষতিবিষয়ক গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ফসল ও ফসল উত্তোলন-পরবর্তী ক্ষতি কমায়, উৎপাদন ব্যয় ও খাটুনি কমায়, উচ্চমানসম্মত পণ্য উৎপাদনে দ্রম্নততম ও সময়ানুগ পরিচালনা নিশ্চিত করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রায় শূন্য হাতে শুরু করা বাংলাদেশের খাদ্যশস্য (ধান ও গম) উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি টন। গত পাঁচ দশকে কৃষিজমি আশঙ্কাজনক হারে কমলেও শস্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। বাংলাদেশে এখন বছরে প্রায় ৫ কোটি টনের কাছাকাছি ধান উৎপাদন হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য মতে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। এ ছাড়া আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম। পোল্ট্রি ও ডিম ১৭ কোটি মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে। ১ হাজার ৭০০ কোটি পিস এখন বাংলাদেশের বার্ষিক ডিম উৎপাদন। কলা চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। এ সময় উদ্ভব ঘটেছে স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট, বাউকুল, আপেলকুল, আরবি খেজুর ইত্যাদি ফলের। আয়াতনে বিশ্বের খুব ছোট একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের এ সাফল্যকে খুব বড় ধরনের অর্জন হিসেবে দেখছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। ভুট্টা উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪৬ লাখ মে. টন। নিবিড় চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। সবজি উৎপাদন বেড়ে ১ কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত এবং বিশ্বে সপ্তম। বছরে এখন আলু উৎপাদন ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারায় অষ্টম। আম উৎপাদন প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। মূলত কৃষিতে পাওয়া ঈর্ষণীয় সাফল্যকে পুঁজি করেই বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ এখন দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে নিরাপদ স্তরে আপৎকালীন মজুত রেখেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে উদ্বৃত্ত খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য। কৃষিতে যুগোপযোগী পরিকল্পনা, উন্নত প্রযুক্তি, বীজ ও সারের ব্যবহার, কৃষি বিজ্ঞানীদের উচ্চফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন বাংলাদেশের এই অর্জনের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে। দিলীপ কুমার আগরওয়ালা পরিচালক, এফবিসিসিআই, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড