কুমির বৃত্তান্ত

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত ৭নং শোভনা ইউনিয়নে কুমির দর্শন এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। ইউনিয়নের মধ্যবর্তী প্রবাহমান তেলিগাতী নদীতে কমপক্ষে ৪টি কুমির লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কুমিরকে কেন্দ্র করে দূর-দূরান্ত থেকে শত শত দর্শনার্থী প্রতিদিন ভিড় করছে স্থানীয় জিয়ালতলা বাজারে। স্থানীয় জনগণ গরু, ছাগল, ভেড়া বিভিন্ন ঝোপঝাড়ের নিচে বেঁধে দিচ্ছে এবং কুমির এসে অবলীলায় সেগুলো উদারস্ত করছে। আবার কখনো কখনো কুমির নিজ উদ্যোগে নদীর কূলে ছাগল পেলেই শিকার করছে। ইতিমধ্যেই ৩/৪টি ছাগল কুমিরের খাদ্যে পরিণত হয়েছে। আর এসব প্রত্যক্ষ করতে প্রতিদিন ব্যাপক জনসমাগম হচ্ছে। প্রবাহমান খরস্রোতা নদীতে কুমির-মানুষের এমন মেলবন্ধন রীতিমতো বিস্ময়কর ব্যাপার। কুমির পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী শিকারি প্রাণীগুলোর একটি। সর্বোচ্চ শক্তিশালী চোয়ালের অধিকারী প্রাণীটি কামড়ের সময় প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে প্রায় ১৭০০ কেজি পর্যন্ত বল প্রয়োগ করতে সক্ষম। গোপনে ওতপেতে থাকা এবং ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণ করার ক্ষমতা এদের প্রায় সব প্রাণীর কাছে মূর্তমান আতঙ্ক করে তুলেছে। তবে আফ্রিকার কিছু মানুষের সঙ্গে প্রাণীটির গড়ে উঠেছে এক অসাধারণ বন্ধুত্ব। ইতিহাস থেকে জানা যায় আফ্রিকার সবচেয়ে ঐতিহ্যপূর্ণ গোত্রগুলোর একটি 'ভগন' গোত্র। ভগনরাজ্যে কুমির একটি পবিত্র প্রাণী হিসেবে পরিচিত। কথিত আছে ভগনদের একজন পূর্বপুরুষকে কুমির নদীতে ভেসে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সেই সময় থেকে কুমিরকে এরা নিজেদের প্রতিবিম্ব হিসেবে বিবেচনা করে। ভগনদের বিশ্বাস একজন ভগন শিশুর জন্মের বিপরীতে একটি কুমির শিশুর জন্ম হয়। ফলে কুমিরের প্রতি আতিথেয়তা এদের সামাজিক কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। মালির পার্শ্ববর্তী দেশ বুর্কিনা ফাসোতেও কুমির ও মানুষের অসাধারণ এক মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে। দেশটির বাজুলে নামক গ্রামটি বন্ধুসুলভ কুমিরদের জন্য বিশ্বখ্যাত। শত শত বছর ধরে এখানকার মানুষ কুমিরের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে। গ্রামবাসীর ভাষ্যমতে প্রাচীনকালে এখানকার বাসিন্দারা যখন হ্রদটি থেকে পানি সংগ্রহে আসত কুমির কখনই তাদের আক্রমণ করত না। কুমিরগুলো নিরাপদে পানি সংগ্রহ করতে দেয় বলে গ্রামবাসীর বংশধারা চলমান রয়েছে। এখানকার মানুষ শিশুকাল থেকেই কুমিরদের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করতে শেখে। ফলে কুমিরগুলো হয়ে উঠেছে শিশু-কিশোরদের খেলার সাথী। বুর্কিনা ফাসো থেকে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দূরে চাঁদের 'গেল্টা ডি আর্কেই' হ্রদে আরেক দল শান্তিপ্রিয় কুমিরের বসবাস। সাহারা মরুভূমির এই ধু-ধু প্রান্তরে কুমিরের দেখা পাওয়া অত্যন্ত বিস্ময়কর। বিদিয়েত যাযাবররা তাদের উঠগুলোকে পানি পান করানোর জন্য এখানে নিয়ে আসে। এরা মনে করে কুমিরদের রক্ষা করা এদের জন্য পবিত্র দায়িত্ব। যদিও এই মহান দায়িত্বের সঠিক কারণ এদের অজানা। হ্রদটির পার্শ্ববর্তী স্যাবু গ্রামের ৪০০ মানুষের জন্য কুমিরের যত্ন নেওয়া ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ। এ গ্রামে কথিত আছে, বহুকাল আগে এদের একজন পূর্বপুরুষ তৃষ্ণায় মৃত প্রায় অবস্থায় পৌঁছান। একটি কুমির লেজের সাহায্যে পানি পান করিয়ে সেই পূর্বপুরুষের প্রাণ রক্ষা করে। সেই সময় থেকেই কুমির গ্রামবাসীর উপাস্য প্রাণী হয়ে ওঠে। রোগব্যাধিমুক্ত জীবন এবং শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে গ্রামবাসী মাঝেমধ্যেই কুমিরদের জন্য ছাগল ও মুরগী উৎসর্গ করে থাকেন। এখানেও কুমিরের সাথে মানুষের সহাবস্থান অত্যন্ত শান্তিপুর্ণ। গ্রামের বাসিন্দারা নির্ভয়ে কুমিরগুলোকে স্পর্শ করতে পারেন। কুমিরের সাথে এ ধরনের সম্পর্ক প্রানীর প্রতি মানুষের ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এবং অসাধারন এই ভালোবাসা জয় করেছে হিংস্রতাকেও। আমাদের নিকটবর্তী বাগেরহাটের খানজাহান আলীর দিঘীতে কুমির মানুষের সহাবস্থান সর্বজনবিদিত। সেখানকার কর্তৃপক্ষ কুমিরকে স্পর্শ করে, কুমিরের মুখে খাবার তুলে দেয় কিন্তু কুমির কখনই তাদের প্রতি হিংস্রতা প্রদর্শন করে না। অতি সম্প্রতি শোভনা ইউনিয়নের পাশ দিয়ে প্রবাহমান তেলিগাতী নদীতে আসা কুমিরগুলোর মধ্যে খুব বেশী হিংস্রতা লক্ষ্য করা যায় না। যেটুকু হচ্ছে শুধু মাত্র খাদ্যের অভাবে। অর্থাৎ পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করা হলে এগুলোর হিংস্রতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। আমাদের কুমির প্রজনন কেন্দ্র করমজল থেকে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ১০০টি কুমির অবমুক্ত করা হয়। সম্ভবত তার কয়েকটি কুমির পথভ্রষ্ট হয়ে শিবসা, হাপরখানা, ঘ্যাংরাইল হয়ে তেলিগাতি-ভদ্রা নদীতে এসেছে। এখন কুমিরগুলো প্রচুর খাদ্য সংকটে ভুগছে। এলাকাবাসী স্ব-উদ্যেগে গরু, ছাগল, ভেড়া দিলেও সেটা অপ্রতুল। সরকার ও বনবিভাগের দৃষ্টি আকর্ষন করছি কুমিরগুলোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করা হলে এখানে কুমিরের অভয়ারন্য গড়ে উঠতে পারে। গড়ে উঠতে পারে করমজলের মতো এখানেও সরকারী উদ্যোগে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সুরঞ্জিত বৈদ্য কবি ও প্রাবন্ধিক বারবার নির্বাচিত, চেয়ারম্যান, ৭নং শোভনা ইউনিয়ন পরিষদ ডুমুরিয়া, খুলনা।