শ্রীকৃষ্ণ :জ্যোতির্ময় পুরুষোত্তম

লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধরাধামে আবির্ভূত হয়ে আমাদের জন্য যে দিব্য জীবনের আদর্শ রচনা করে গেছেন, তার মূল রহস্য আত্মস্থ করে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়পরায়ণতায় ও অমৃতলোকের অন্বেষায় শুরু হোক আমাদের অভিযাত্রা।

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

তারাপদ আচার্য্য
আজ শুভ জন্মাষ্টমী। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি জন্মাষ্টমী নামে পরিচিত। দ্বাপর যুগে ভাদ্র মাসে রোহিনী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন এই ধরাধামে। শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি তার ভক্তদের কাছে 'জন্মাষ্টমী' নামে যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। গীতায় (জ্ঞানযোগ ৭/৮) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন অর্জুনের কাছে- যদাযদাহি ধর্মস্য গস্নানির্ভবতি ভারত। অভু্যত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌। পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভাবমি যুগে যুগে হে অর্জুন, পৃথিবীতে যখন অধর্ম বেড়ে যায় তখন আমি অবতীর্ণ হই। অবতীর্ণ হয়ে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করি, দুষ্টদের বিনাশ করি এবং সাধুদের রক্ষা করি। শাস্ত্রকারের ভাষায়, ধর্মগস্নানি হলে অধর্মকে বিনাশ করার জন্য, ধর্মকে পুনরায় স্থাপন করার উদ্দেশ্যে ভগবান অবতারের রূপ ধরে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। অবতার ভগবানের একটি অংশ মাত্র। বিশেষ বিশেষ যুগে বিশেষ বিশেষ ধর্মগস্নানি হয়। তাই যুগের প্রয়োজনে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে তিনি অবতীর্ণ হন এবং তাঁর বিচিত্র রূপ ও শক্তির প্রকাশ ঘটান। এছাড়া শ্রীকৃষ্ণ আরো বলেছেন, 'মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়, কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও অবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান হয়ে থাকি। অবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া- দুটোই আমার অলৌকিক লীলা।' দ্বাপর যুগে ভারতবর্ষে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ছিল। কতিপয় রাজা রাজধর্ম, কুলাচার, সদাচার ভুলে গিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যায়-অবিচারে মত্ত হয়ে উঠেছিল। মথুরার রাজা কংস পিতা উগ্রসেনকে উৎখাত করে নিজে সিংহাসনে আরোহণ করেছিল। একই রকম ত্রাসের শাসন চালিয়েছিল জরাসন্ধ, চেদিরাজ শিশুপালসহ অনেক রাজা। রাজা জরাসন্ধ একাই ৮৬ জন রাজাকে বলি দেয়ার জন্য কারাগারে রেখেছিল। এছাড়া হস্তিনাপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল দুর্যোধন-দুঃশাসন। মহাভারতের কাহিনীতে বর্ণিত দুঃশাসন কর্তৃক সভাসমক্ষে কূলবধূ দ্রৌপদীর অবমাননা এক লজ্জাকর অধ্যায়। জনসমক্ষে নারীর এমন অবমাননার প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না তখন সৎ-ধার্মিক ব্যক্তিদের। এ অরাজকতা থেকে পরিত্রাণের জন্য দেবতারা প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মার পরামর্শে সবাই মিলে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের যুগসন্ধিক্ষণে তারা সবাই বিষ্ণুর বন্দনা করেন। স্বয়ং ব্রহ্মা মগ্ন হন কঠোর তপস্যায়। ধরণির দুঃখ-দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে দেবতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি দেবতাদের অভয়বাণী শোনান এই বলে যে, তিনি অচিরেই মানবরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানরূপে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণ নামে। ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের নির্দেশ দিলেন এই ধরাধামে তার লীলার সহচর হওয়ার প্রয়োজনে ধরণিতে জন্ম নেওয়ার জন্য। ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশমতো দেবতারা ভগবানের কাঙ্ক্ষিত কর্মে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে যদুকুলের বিভিন্ন পরিবারে জন্ম নিতে থাকেন। এ সময় কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বের ত্রাণকর্তা শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের পিতা-মাতার নাম বসুদেব ও দেবকী। বসুদেব-দেবকী কারাগারে বন্দি হওয়ার নেপথ্যে কারণ আছে। কংসের বোন দেবকী। কংস বসুদেবের সঙ্গে দেবকীর বিয়ে দেন। বিয়ের পর বোন-ভগ্নিপতিকে নিয়ে রথে চড়ে ভ্রমণ করার সময় কংস দৈববাণী শুনতে পান যে, দেবকীর অষ্টমগর্ভের পুত্রসন্তানই তাকে বধ করবে। সেই থেকে কংস বসুদেব ও দেবকীকে তার কারাগারে বন্দি করে রাখে। একে একে দেবকীর গর্ভে সাতটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু অত্যাচারী কংস নির্মমভাবে তাদের হত্যা করে। চারদিকে আলোয় উদ্ভাসিত করে অষ্টমী তিথিতে অরাজকতার দিন অবসান করতে গভীর অন্ধকার রাতে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীকৃষ্ণ। বসুদেব দেখেন, শিশুটি চারহাতে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম ধারণ করে আছেন। নানা রকম মহামূল্য মনি-রত্নখচিত সমস্ত অলংকার তার দেহে শোভা পাচ্ছে। বসুদেবের বন্দনার পর দেবকী প্রার্থনা শুরু করেন এবং প্রার্থনা শেষে একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করতে বলেন। শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করে বলেন, 'আমাকে এখান থেকে গোকুলে নিয়ে নন্দ এবং যশোদার ঘরে রেখে আসুন এবং তাদের ঘরে একটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে তাকে এখানে নিয়ে আসুন।' গোকুলে নন্দ এবং যশোদার সন্তানরূপে যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি হলেন ভগবানের অন্তরঙ্গ শক্তি যোগমায়া। যোগমায়ার প্রভাবে কংসের প্রাসাদে প্রহরীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কারাগারের দরজা আপনা আপনি খুলে যায়। অন্ধকার রাত। প্রবল বৃষ্টি। বসুদেব যখন শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বৃষ্টির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তখন ভগবান শেষসর্প রূপ ধারণ করে বসুদেবের মাথার ওপরে ফণা বিস্তার করেন। যমুনা অপর পারে যাওয়ার জন্য পথ তৈরি করে দেন। বসুদেব যমুনা পার হয়ে গোকুলে নন্দ মহারাজের ঘরে গিয়ে দেখেন সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সেই সুযোগে যশোদার ঘরে শ্রীকৃষ্ণকে রেখে এবং যশোদার সদ্যজাত শিশুকন্যাকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে আসেন। নিজেকে নিজে শৃঙ্খলিত করেন যাতে কংস বুঝতে না পারে যে ইতোমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। 'মথুরায় তার জন্ম, গোকুলে নন্দালয়ে তার বেড়ে ওঠা, মথুরায় করেছেন কংস বধ, রাজ্যাধিকার, কুরুক্ষেত্রে পান্ডবদের কাছে তিনি সখা, দ্বারকায় রাজধানী স্থানান্তর ও অতপর লীলাবসান। মহাভারতের রচয়িতা বিশালবুদ্ধি ব্যাসদেব কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে কেবলমাত্র অবতার বলে অভিহিত করেননি। শৌর্য, বীর্য, ত্যাগ, প্রেম, অনাসক্তি এবং অন্যান্য দিব্যগুণে বিভূষিত কৃষ্ণকে 'কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং' বলে চিহ্নিত করেছেন। লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধরাধামে আবির্ভূত হয়ে আমাদের জন্য যে দিব্য জীবনের আদর্শ রচনা করে গেছেন, তার মূল রহস্য আত্মস্থ করে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়পরায়ণতায় ও অমৃতলোকের অন্বেষায় শুরু হোক আমাদের অভিযাত্রা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত শ্রীমদ্ভগবদ গীতাকে পাথেয় করে ফলের আশা, কর্তৃত্বাভিমান তথা সমস্ত মানবীয় সংকীর্ণতাকে পরিহার করে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও মানব কল্যাণব্রতে আমাদের অঙ্গীকার হোক 'শিব জ্ঞানে জীব সেবা'। তারাপদ আচার্য্য : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ