বায়োটেক ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
পৃথিবীতে ক্রমবধর্মান জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবাদি জমির পরিমাণ বাড়ছে না, বরং তাদের বসবাসসহ সংশ্লিষ্ট নানা কাজে ফসলি জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে কম জমি ব্যবহার করে কিভাবে অধিক পরিমাণ শস্য উৎপাদন করা যায়, এ বিষয়ে গবেষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই কাজ করছে। ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার অধেের্ক কমিয়ে আনা বিশ্ববাসীর জন্য কঠিনতম চ্যালেঞ্জ। মানুষের ক্ষুধা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার এই চ্যালেঞ্জ ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন বিশ্বের বায়োটেকবিদরা। বায়োটেকবিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় তৈরি হচ্ছে অধিক ফলনশীল জেনেটিক্যালি মডিফাইড (জিএম) শস্য। জেনেটিক্যালি মডিফাইড শস্য হলো কৌলিতাত্তি¡কভাবে রূপান্তরিত শস্য, যা কোনো সুনিদির্ষ্ট জিন প্রতিস্থাপন করে তৈরি করে। এগুলো বতর্মান বায়োটেক (ইঃ) ফসল নামে পরিচিত। ১৯৯৪ সালে শিল্পোন্নত দেশে প্রথম কৌলিতাত্তি¡কভাবে রূপান্তরিত খাদ্যশস্য হিসেবে ক্যালজিন্সের বিলম্বে পাকানো টমেটোর উৎপাদন এবং ব্যবহার শুরু হয়। বাণিজ্যিকভাবে জিএম শস্য উৎপাদন শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। বায়োটেক ফসলের ক্ষেত্রে কোনো জাতে একটি সুনিদির্ষ্ট জিন প্রবেশ করিয়ে শুধু সেই জিনের সুফল নেয়া হয় জাতটির বাকি সব বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ থাকে। বিআর-২৯ জাতের ভিটামিন ‘এ’-এর জিন দেয়া হয়েছে, যার নতুন নাম দেয়া হয়েছে ‘গোল্ডেন রাইস’, যা বাংলাদেশের মানুষের ভিটামিন ‘এ’ এবং লৌহের ঘাটতিজনিত রোগ; যেমনথÑ রাতকানা , অন্ধত্ব ও রক্তশূন্যতা দূরীকরণে কাযর্কর ভ‚মিকা পালন করে। বায়োটেক ফসলের বিভিন্ন সুফলের জন্য ১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, সরিষা জাতীয় ক্যানোলা, পেঁপে, স্কোয়াশ ইত্যাদি ফসলের চাষ হচ্ছে। ২০০৯ সালে পৃথিবীর ৬টি মহাদেশের ২৫টি দেশের ১৩৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বায়োটেক ফসলের চাষ হয়েছে, যার ফলভোগী হচ্ছে প্রান্তিক চাষী। আজেির্ন্টনার মোট তুলার ৯৮ ভাগই বায়োটেক তুলা। ব্রাজিল, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সয়াবিন, তুলা, ভুট্টা ও ক্যানোলার বেশিরভাগ জমিই বায়োটেক ফসলাধীন। বায়োটেক শস্য উৎপাদনে ভারত, উরুগুয়ে, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, আজেির্ন্টনা ও যুক্তরাষ্ট্র অগ্রাসী ভ‚মিকা পালন করছে। ২০০৪ সালে ভারতে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে ইঃ তুলা উৎপাদন করা হয় এবং প্রায় ৩ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক ইঃ তুলা থেকে সুবিধা ভোগ করে থাকেন। চীনে ৩.৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ইঃ তুলা উৎপাদন করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় বায়োটেক ভুট্টা, সয়াবিন ও তুলা এবং কানাডায় বায়োটেক ক্যানোলা, ভুট্টা ও সয়াবিন চাষ হচ্ছে। এছাড়া স্পেন ও জামাির্নতে ইঃ ভুট্টা চাষ হচ্ছে। ২০০৯ সালে বিশ্বের ২৫টি দেশে প্রায় ১৩৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বায়োটেক শস্যের উৎপাদন হচ্ছে। ২০০৬ সালে বিশ্বের প্রায় ৩৮.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বিভিন্ন শস্য উৎপাদিত হয়েছে। তার মধ্যে বায়োটেক শস্যের উৎপাদিত মূল্য প্রায় ৬.১৫ বিলিয়ন ডলার, যা সারা বিশ্বের উৎপাদিত শস্যমূল্যের প্রায় ১৬%। এছাড়া সারাবিশ্বে যে পরিমাণ বীজ উৎপাদিত হয়, তার মূল্য প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার এবং এর মধ্যে বায়োটেক প্রযুক্তিতে উৎপাদিত বীজের মূল্য মোট উৎপাদিত মূল্যের প্রায় ২১%। ২০০৭ সারাবিশ্বে ৬.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বায়োটেক শস্য উৎপাদিত হয়েছে। চীন কতৃর্ক বায়োটেক ধানের অনুমোদনের ফলে বায়োটেক খাদ্যশস্যের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের পুষ্টিহীনতা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূণর্ অবদান রাখবে। জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবের জিনোম পরিবতর্ন করে আমাদের দেশে লবণ অতিবৃষ্টি বা বন্যায় চাষ করা যায় এবং অতিরিক্ত ঠাÐা ধানের জাত, আলুর ঠাÐা সহিষ্ণু জাত এবং বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ প্রতিরোধকারী জাত, আলুর লেইট বøাইট প্রতিরোধী জাতসহ অন্যান্য ফসলের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। জিএম শস্যের একটি গুরুত্বপূণর্ পরিবেশগত সুবিধা হচ্ছে নিদির্ষ্ট বৈশিষ্ট্য পরিবতের্নর মাধ্যমে এটা কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে দেয়। আগাছা প্রতিরোধী জিএম সয়াবিন ও সরিষা বীজ, তুলা এবং ভুট্টার জাত ও কীট-পতঙ্গ প্রতিরোধী জিএম তুলা ব্যবহারের ফলে ২০০০ সালে বিশ্বের তালিকাভুক্ত পণ্যের ক্ষেত্রে ২২.৩ মিলিয়ন কেজি কীটনাশক প্রতিরোধী ইঃ জাতগুলোর সঠিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কীটনাশক ব্যবহার ১৪% কমিয়ে আনা যাবে। পশুখাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে জিএম শস্যের কাযর্কর ভ‚মিকা রয়েছে। পশুখাদ্যের সঙ্গে সম্পকির্ত জিএম ফসলের মধ্যে ভুট্টা, ক্যানোলা, তুলাবীজ, সয়াবিন এবং আলু অন্যতম। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গবাদিপশু থেকে প্রাপ্ত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকন্তু শহরায়নের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মাংস, দুধ এবং ডিমের মাথাপিছু ব্যবহার বেড়ে গিয়ে ২০২০ সালে প্রায় দ্বিগুণ হবে। বিশ্বে মাংসের চাহিদা বতর্মান ব্যবহারের চেয়ে ৫৫% বেশি হবে। সারা বিশ্বে উৎপাদিত ৯০ মিলিয়ন টন জিএম ভুট্টার ৭০% গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গবাদি পশুকে প্রচলিত খাদ্যের পরিবতের্ বায়োটেক খাদ্য প্রদানের ফলে উৎপাদন ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত জিএম শস্য প্রচলিত খাদ্যের মতোই নিরাপদ। জিএম শস্য থেকে প্রাপ্ত খাদ্য অন্য যেকোনো খাদ্যের তুলনায় বেশি পরীক্ষা করা হয়। ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৯.৩ বিলিয়ন হবে। অথার্ৎ ৫০ বছরের চেয়ে কম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৩ বিলিয়ন বৃদ্ধি পাবে। বিজ্ঞানী এবং গবেষকসহ সংশ্লিষ্টদের মতে, ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বে তাপমাত্রা ১.৪-৫.৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাবে, যা আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের পরিবতর্ন ঘটাবে। ফলে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যÑ সবের্ক্ষত্র প্রভাবিত হবে। এসব কারণে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে তৃণমূল মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রয়োজন, যা কেবল বায়োটেক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অজর্ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বায়োটেক ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সিরাজুস সালেকিন বাকৃবি, ময়মনসিংহ