শীতের তীব্রতা ও অসহায় মানুষ

এক সময় তরুণরা সামষ্টিক উদ্যোগে কিংবা কোনো সংগঠনের ব্যানারে শীতে শীতবস্ত্র, বন্যায় বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত জনপদের মানুষের জন্য ত্রাণ কাজে তৎপর ছিল। সেই তৎপরতা এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না। তারুণ্য এখন বিপথগামী, নেশায় আসক্ত। আর্ত-মানবতার সেবার কথাটি তারা ভুলে গেছে। ভালো কাজ করার মানসিকতা তাদের নেই। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে। শীতার্ত মানুষের প্রতি সমাজের সামর্থ্যবান ও বিত্তশালীদের সাহায্য ও সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত পরিমাণে শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে সাধ্যমতো শীতার্তদের পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত। নিঃস্বার্থভাবে বিপদগ্রস্ত এসব মানুষের সাহায্য ও সেবা করা মানবধর্ম। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, এই সত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

প্রকাশ | ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
ঋতু পরিক্রমায় প্রতি বছরই ধীরে ধীরে শীতের আগমন ঘটে। তবে এবার শীত দ্রম্নত এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতু পরিবর্তনের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়েছে। শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা- এ তিন ঋতুরই প্রভাব অনেক বেশি। গ্রীষ্মে প্রচন্ড গরম, শীতে অতিমাত্রায় শীত ও বর্ষায় অতিবৃষ্টির প্রভাব বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং এর মাত্রা নিচে নেমে আসে। তাপমাত্রা যখন কমতে থাকে, তখনই শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ শীত অনেক সময় হাড় কাঁপানো শীতে পরিণত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সারাদেশে জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলায় চলছে এক ধরনের শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা। কনকনে শীতে জবুথবু দেশ। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত একটানা কুয়াশা ও শিরশির করে বইছে ঠান্ডা বাতাস। অজর ধারায় ঝরছে কুয়াশা বৃষ্টি। ঘন কুয়াশার কারণে সড়ক পথে দুর্ঘটনা ঘটেছে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারাদেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে। শীতজনিত রোগে মারা গেছে বেশ কজন, আগুন পোহাতে গিয়েও মারা গেছে অনেকেই। ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন শিশু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। \হবিমান চলাচল ও ফেরি চলাচলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পর পরই হাটবাজার সড়ক-মহাসড়ক ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে দেশের ছিন্নমূল মানুষ। যানবাহনগুলো চলছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। তীব্র শীতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ দেশে বিত্তবানরা শীতকে উদযাপন করে থাকে। কারণ তাদের খাদ্যখাবার শীতবস্ত্রের কোনো সমস্যা নেই। যত সমস্যা নিম্নবিত্ত বিত্তহীন ও পথশিশুদের জন্য। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য এই শীত নিয়ে আসে এক ভয়াবহ দুর্ভোগ ও দুর্যোগ। তারা প্রয়োজনীয় শীতের কাপড় না থাকার কারণে শীতে প্রচন্ড রকমের কষ্ট করে। বিশেষ করে গৃহহীন মানুষ, পথশিশুদের কষ্টের কোনো শেষ থাকে না এই শীতকালে। আমরা জানি, সরকার শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনে সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার কর্মীসহ নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বিদ্যমান থাকার পরেও শিশুদের সার্বিক অধিকার নিশ্চিতকরণে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের তেমন কোনো সমস্যা নেই। তারা মূলত শীতকে উদযাপন করে থাকে। কিন্তু নিম্নবিত্ত এবং সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য এই শীত নিয়ে আসে এক ভয়াবহ দুর্ভোগ। তারা প্রয়োজনীয় শীতের কাপড় না থাকার করণে শীতে প্রচন্ড রকমের কষ্ট করে। বিশেষ করে গৃহহীন মানুষ, পথশিশুদের কষ্টের কোনো শেষ থাকে না এই শীতকালে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য চেষ্টা করা। তাহলে হয়তো এই শীতার্ত মানুষের কষ্ট কিছুটা কমে আসবে। পথশিশুরা অবহেলিত, নির্যাতিত, সুবিধাবঞ্চিত ও শিক্ষার আলো থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। পথশিশুদের একটি বড় অংশের নেই অক্ষরজ্ঞান। বাকি যারা এনজিও কিংবা অন্য কোনো সহায়ক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা নেয়, তাদের অবস্থাও ভালো নয়। ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যখন পথশিশুদের চোখে পড়ে, তখন থমকে দাঁড়িয়ে যাই। তারা যখন খাবার কিংবা টাকা চায় তখনো মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবী আমাদের শিশুর সঙ্গে এদের কত পার্থক্য। পথশিশুদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা নেই বললেই চলে। তারা যাবতীয় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশের পথশিশুরা সারা পৃথিবীর ১২০ কোটি পথশিশুর একটি অংশ। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১২ লাখ। এর মধ্যে আড়াই থেকে তিন লক্ষাধিক পথশিশু রাজধানী ঢাকার পিচঢালা পথে বাঁধা পড়ে গেছে। \হজীবন আর জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নামা এই বিপুল সংখ্যক শিশুরা উপেক্ষার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে শিশুর হাতে বই খাতা থাকার কথা ছিল, মেতে ওঠার কথা ছিল খেলাধুলায়, তাদের একটি বড় অংশ আজ জীবন সংগ্রামে পর্যদস্তু। বেঁচে থাকাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাঞ্ছিত সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা দরকার। সমাজের আর ১০টা শিশুর মতো বেড়ে ওঠা ও বিকাশ লাভের সুযোগ করে দিতে হবে আমাদেরই। এ ক্ষেত্রে সরকারেরও যথেষ্ট করণীয় রয়েছে। সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগই পারে এদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিদেরও করণীয় রয়েছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য চেষ্টা করা। তাহলে হয়তো এই শীতার্ত মানুষের কষ্ট কিছুটা কমে আসবে। প্রশ্ন উঠতে পারে এই পার্থক্য কে সৃষ্টি করেছে। বৈষম্যমূলক সমাজই এই পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। যার কারণে মানুষ আজ ছিন্নমূল, নিরন্ন ও অধিকারবঞ্চিত। সমাজে যারা বিত্তবান ব্যক্তি, তারা চাইলেই পথশিশুসহ ছিন্নমূল মানুষের এই হাড় কাঁপানো শীতের সময় একটু সাহায্য করতে পারেন। আপনাদের একটু সহযোগিতার মাধ্যমেই সমাজে বসবাসরত গরিব অসহায় মানুষের মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারেন। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি একটু মানবতা প্রদর্শন করা আমাদের কর্তব্য। এই কনকনে শীতে ফুটপাত, রেলস্টেশন ও বস্তিতে বসবাস করা মানুষ নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হওয়ার কারণ সূর্যের আলো আড়াআড়িভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছানো এবং বাতাসের তীব্রতা বেশি থাকে। শীতের প্রকোপ শুরু হওয়ায় শিশু ও বৃদ্ধদের অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশি। এ সময় শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন বৃদ্ধরাও। এ জন্য সবাইকেই সুস্থতার জন্য সর্তক থাকতে হবে এবং ঠান্ডা লাগানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সরকারের পাশাপাশি আমরাও পারি শীতার্তদের জন্য আমাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে। শীতের সময় শহরাঞ্চলের মানুষের তুলনায় গ্রামের সাধারণ মানুষ বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। আশার কথা এবার শীতে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভান্ডার থেকে ৬৪ জেলায় ২৬ লাখ ৩৩ হাজার কম্বল পাঠানো হয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি শীতার্ত মানুষকে সহায়তায় প্রতিবছর নানা সংগঠন, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এগিয়ে এলেও এবার তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। এক সময় তরুণরা সামষ্টিক উদ্যোগে কিংবা কোনো সংগঠনের ব্যানারে শীতে শীতবস্ত্র, বন্যায় বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত জনপদের মানুষের জন্য ত্রাণ কাজে তৎপর ছিল। সেই তৎপরতা এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না। তারুণ্য এখন বিপথগামী, নেশায় আসক্ত। আর্ত-মানবতার সেবার কথাটি তারা ভুলে গেছে। ভালো কাজ করার মানসিকতা তাদের নেই। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে। শীতার্ত মানুষের প্রতি সমাজের সামর্থ্যবান ও বিত্তশালীদের সাহায্য ও সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত পরিমাণে শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে সাধ্যমতো শীতার্তদের পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত। নিঃস্বার্থভাবে বিপদগ্রস্ত এসব মানুষের সাহায্য ও সেবা করা মানবধর্ম। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, এই সত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে শীতার্তদের পাশে দাঁড়াই তাহলে শুধু উত্তবঙ্গ কেন পুরো দেশের শীতার্তরা একটু উষ্ণ ভালোবাসার পরশ পাবে। আসুন আমরা মানবিক হই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক