বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং তরুণ উদ্যোক্তা গঠনে ই-কমার্সের অবদান

যারা নিয়মিত কেনাকাটা করে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বয়সই ১৮ থেকে ৪০ বছর। করোনায় চাকরির বাজার মন্দা থাকার কারণে অনেক তরুণ কর্মহীন থাকার অভিশাপ থেকে বাঁচতে বিকল্প হিসেবে ফেসবুক পেজ এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে ভূমিকা রাখছে।

প্রকাশ | ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

গোলাম সাব্বির
বিশ্বায়নের এই যুগে এবং আইটি প্রযুক্তির বিপস্নবের কল্যাণে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক অগ্রগতিতে ই-কমার্সের দ্বারা ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, যাহা নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যবসাবাণিজ্যের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বিংশ শতকের শেষ অংশে উন্নত দেশগুলোতে ডিজিটাল বিপস্নব শুরু হলেও উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লেগে যায় একুশ শতক। অনলাইনে পণ্য কেনা-বেচা ধারণাটি এক যুগ পূর্বে হাস্যকর শোনালেও, বর্তমানে ই-কমার্স হয়ে উঠেছে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সহজ ও ভরসার মাধ্যম। ই-কমার্স বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি তা হলো: এটি একটি ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ক্রয় বা বিক্রয় প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়, যাহা সম্পন্ন হয় ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে। ই-কমার্সে সব অভ্যন্তরীণ কার্যাবলি যেমন: বিপণন, শনাক্তকরণ, পেমেন্ট এবং পণ্য ও পরিষেবা সরবরাহ ইত্যাদি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে কোম্পানিগুলো সংযোগ স্থাপন করে থাকে। পুরো প্রক্রিয়াটি একটি উচ্চ প্রযুক্তির ভার্চুয়াল সিস্টেম যার মাধ্যমে গ্রাহকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা পেয়ে থাকে এবং ওই প্রক্রিয়াটির দ্বারা ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। ই-কমার্সের জাদু স্পর্শ করে একজন ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে সংযুক্ত হয়ে তারা তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা ও নিজেদের চাহিদা মেটাতে পুরোপুরি সক্ষম। ২০০৯ সাল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তির এই ছোঁয়া শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার ফলে ই-কমার্সের সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ই-কমার্স সাইট অনলাইনে কেনাকাটার বিষয়টি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষও এখন ধীরে ধীরে এতে সম্পৃক্ত হতে শুরু করছে। পুরো দেশে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ যখন চরম পর্যায়ে, লকডাউনে থমকে যায় ব্যবসাবাণিজ্য, তখন ই-কমার্সের দ্বারা আলোর পথ দেখতে থাকে এ দেশের কিছু তরুণ উদ্যোক্তা। রাস্তায় যানজট, হুড়াহুড়ি, দৈনন্দিন ব্যস্তজীবনে শপিংমলে গিয়ে কেনাকাটার বিকল্প হিসেবে এখন অনেকেই তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য অনলাইনে সংগ্রহে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। মহামারি যখন সারা বিশ্বের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে নাজেহাল করে তুলেছিল, তখন আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে ই-কমার্স ও ডেলিভারি কোম্পানিগুলো। দুঃসময়ে গ্রাহকের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দেওয়ায় দেশে এই সেবার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায় তড়িৎ গতিতে। কোভিডের শুরুর বছর কেবল ২০২০ সালে অনলাইনে বেচাকেনা বেড়ে যায় প্রায় ৩০০ শতাংশ। ১ লাখ নতুন উদ্যোক্তার পাশাপাশি তৈরি হয়েছে ৫ লাখ কর্মসংস্থান। কোভিডের আগেও এই খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৪০-৪৫ শতাংশ। লেনদেন বৃদ্ধি পেয়ে খাতটির মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। শুধু বাণিজ্যিক ওয়েব পোর্টাল নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেও কোনো দোকান ছাড়াই অসংখ্য উদ্যোক্তা, এমনকি কৃষক সরাসরি নিজের পণ্য বিক্রি করছেন। অনেক তরুণদের দেখা গেছে তারা এই করোনা মহামারির মধ্যে তারা অনলাইনে ফেসবুকের লাইভের মাধ্যমে তারা মৌসুমি ফল আম, লিচুর মতো আরও অনেক ফলই এই ই-কমার্সের দ্বারা সরাসরি ভোক্তার কাছে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে মধ্যস্থ ব্যবসায়ী দ্বারস্থ ছাড়াই সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ কৃষকরা তাদের উৎপাদনকৃত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় না। মধ্যস্থ ব্যবসায়ীরা তাদের এই উৎপাদনকৃত পণ্য থেকে লভ্যাংশ গুনছে, অথচ আসল কৃষকরা এই লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ই-কমার্স এই সব তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। প্রয়োজনে ভিডিও কলের মাধ্যমে ক্রেতার সামনে তুলে ধরছেন তারা তাদের সরাসরি উৎপাদনকৃত পণ্য। ন্যায্যমূল্যে কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তথ্যপ্রযুক্তি। কৃষক ঘরে বসে কৃষিপণ্যের বাজার যাচাই ও পণ্য বিক্রি করতে পারছে। ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল পৌঁছে যাচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক পর্যন্ত। আজ মানুষের হাতে হাতে মোবাইল। প্রায় ১১ কোটির মতো মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে বর্তমানে। মোবাইলে আর্থিক সেবা, রাইড শেয়ারিং, ই-কমার্স, বাস-ট্রেন-বিমানের টিকিট ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি সেবা মিলছে। জমির ই-পর্চা, মিউটেশন, পাসপোর্ট ফরম পূরণ, ভিসা আবেদন, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ই-চালান, পেনশনভাতাসহ নানা সেবা মিলছে অনলাইনে। ই-টেন্ডার, ই-নথির কারণে দাপ্তরিক কর্মকান্ডে গতি ও স্বচ্ছতা এসেছে। এতে করোনা ঝুঁকি মোকাবিলা করে মানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা যেমন সচল রাখা সম্ভব হয়েছে, সেই সঙ্গে বেঁচে গেছে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সময় ও যাতায়াত খরচ। এ ব্যপারে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাদের ইন্টারনেট অবকাঠামো ও ই-কমার্স পস্ন্যাটফরম প্রস্তুত ছিল বলে করোনা পরিস্থিতিতে ই-কমার্সের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা সহজ হয়েছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বিক্রেতারা ঘরে গিয়ে পণ্য পৌঁছে দিয়েছে। যে পরিবর্তনটা ৫-১০ বছর পরে হতো, সেটা গত করোনার সময়ে হয়ে গেছে। প্রচুর মানুষ ই-কমার্সে ঢুকে গেছে। অনলাইনে কেনা-বেচা বেড়েছে প্রচুর। বর্তমানে ১৩ লাখের বেশি মুদি দোকান রয়েছে। তারাও অনলাইন পস্ন্যাটফরমে চলে আসছে। মানুষ এখন অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। সেক্ষেত্রে ই-কমার্স মানুষের স্বস্তির জায়গা হয়েছে। এ ছাড়া ঘরে ঘরে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। একজন গৃহিণীও তার হাতে তৈরি কোনো জিনিস দোকান ছাড়াই বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন। অসংখ্য নারী অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন। এই পস্ন্যাটফর্মে তিন লাখেরও বেশি উদ্যোক্তা কাজ করছে। এটা নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনে বড় অবদান রাখছে। ব্যস্ততা দিন দিন যতই বাড়ছে ততই জনপ্রিয় হচ্ছে ই-কমার্স। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মকে স্বাবলম্বী ও বেকারত্বমুক্ত করতে বর্তমানে ই-কমার্স হয়েছে আশীর্বাদ স্বরূপ। তরুণ উদ্যোগতাদের হাত ধরে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে এক বিশাল ই-কমার্সের বাজার। স্বাধীন পেশা হিসেবে তরুণদের মধ্যে অনেকেই আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছে ই-কমার্স। তারুণ্যের উদ্যমে সম্ভাবনার পথে এগোচ্ছে ই-কমার্স। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) তথ্যমতে, ই-কমার্স খাতে প্রতি মাসে এখন প্রায় ৭০০ কোটিরও বেশি টাকা লেনদেন হচ্ছে। অর্থাৎ বার্ষিক লেনদেন এখন আট হাজার কোটি টাকার বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারত্বের হার প্রায় ১১ শতাংশের কাছাকাছি- যা আমাদের চলমান অর্থনীতির জন্য অশুভ বার্তা। তবে ই-কমার্স বেকারত্বের হার হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে এ খাতে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ গড়ে উঠেছে। ই-ক্যাবের তথ্যমতে, ই-কমার্স খাতে গত কয়েক বছরে প্রায় ২০ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তরুণরা এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। যাহা দেশের অর্থনীতির অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখছে। ই-কমার্স এর কল্যাণে দেশের মধ্যেই শুধু তরুণরা নিজেদের প্রতিভা দেখাচ্ছে না, তারা এখন দেশের সীমানা অতিক্রম করে ফ্রিলান্সিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসে আয় করছে দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টাই। নতুন একটি প্রতিযোগিতামূলক এবং উদ্ভাবনী পেশা হিসেবে শ্রমবাজার তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা যারা বেশির ভাগই বাড়ি থেকে কাজ করেন। গত দুই দশকের তুলনায় গত বছরগুলোতে সংখ্যায় এ পেশায় মানুষের সম্পৃক্ততা বেড়েছে এবং এখনো প্রতিদিন দ্রম্নত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপনাকে এখন আর কাজের জন্য ভ্রমণ করতে হবে না। মানুষ বুঝতে পারছে যে 'নিরাপদ এবং সুরক্ষিত' কাজের ধারণাটি কেবল একটি স্বপ্ন- যা যে কোনো সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এখন একটি নির্দিষ্ট শহর বা শহরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসে কাজ করার আর কোনো প্রয়োজন নেই, আমরা সবাই এখন ইন্টারনেটের গেস্নাবাল ভিলেজে বাস করি। অনেক প্রদত্ত পস্ন্যাটফর্মে বিভিন্ন কাজের বিবরণ থেকে বেছে নেওয়ার বিকল্পসহ, ফ্রিল্যান্সিং কাজের সুযোগ থাকে যাদের ইন্টারনেট সংযোগ আছে এমন যে কেউ এই কাজ করতে পারে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের নমনীয়তা, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য এবং উপলব্ধি সুযোগের আধিক্যসহ অনেক কারণেই এই পেশা এখন বেশ জনপ্রিয়। ঘরে বসে বা যারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান তাদের জন্য একটি উপযোগী পেশা। গত এক দশকে, বাংলাদেশ একটি অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এবং অর্ধ মিলিয়ন সক্রিয় ফ্রিল্যান্সারসহ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অনলাইন শ্রম সরবরাহকারী দেশ। যারা নিয়মিত কেনাকাটা করে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বয়সই ১৮ থেকে ৪০ বছর। করোনায় চাকরির বাজার মন্দা থাকার কারণে অনেক তরুণ কর্মহীন থাকার অভিশাপ থেকে বাঁচতে বিকল্প হিসাবে ফেসবুক পেজ এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে ভূমিকা রাখছে। \হএটা এমন একটা সেক্টর, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই ব্যবসা হতে পারে। এখানে ক্রেতা-বিক্রেতার সিংহভাগই তরুণ প্রজন্ম। টাকা যত হাত বদলাবে, জিডিপি ততই বাড়বে। এ কারণে অর্থনীতির চাকা ২৪ ঘণ্টাই ঘুরাচ্ছে ই-কমার্স। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে আগামীতে দেশের অর্থনীতিতে আরো বড় ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। গোলাম সাব্বির : মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়