দুনীির্তমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার

সমস্যা জজির্রত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে দেশব্যাপী চুরি-দুনীির্ত আর লুটপাটের বিপজ্জনক বিস্তার। এই বিস্তারের প্রধান প্রবণতা হচ্ছে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া। বিজয়ের ৪৭ বছর অতিক্রম করলাম আমরা। নানা প্রতিক‚লতা, বাধা-বিপত্তি, অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র সত্তে¡ও আমরা অনেক এগিয়েছি। কিন্তু চুরি-দুনীির্ত লুটপাট আমাদের অগ্রযাত্রাকে সব সময় পিছিয়ে দিতে চাচ্ছে। দুনীির্ত দমনের পূবর্শতর্ হলো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।

প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে গৌরবজনক এটি দেশ। এ গৌরবের অংশীদার প্রধানত এ দেশের খেটে খাওয়া জনগণ এবং সরকার। শেখ হাসিনা সরকারের নানা উন্নয়নমুখী উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এবার একঝঁাক নতুন মুখ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত হলো ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিসভার ৩১ জনই নতুন। সবাই অঙ্গীকার করেছেন দুনীির্তমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। এই ধরনের অঙ্গীকার আমাদের আশাবাদী করে তোলে। একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অজর্ন এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার নতুনভাবে পথ চলবে এ প্রত্যাশা দেশবাসীর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ‘দুনীির্তকে আমরা প্রশ্রয় দিই না। নিজেদের লোককেই কোনো ছাড় দিই না। এমনকি আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে যে কোনো সময় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি। আদালত থেকেও ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।’ প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি দুনীির্তর বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনবর্্যক্ত করেছেন। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং এর অজর্নগুলো সমুন্নত রাখতে দুনীির্তবিরোধী লড়াই অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রথম কমির্দবসে এই হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন । প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা দুনীির্তমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করবে। ভ‚মিমন্ত্রী তো ঘোষণাই দিয়েছেন, তিনি দুনীির্ত বরদাস্ত করবেন না। তিনি মন্ত্রণালয়ের কমর্কতাের্দর সম্পদের হিসাব দিতে বলেছেন। শপথ নেয়ার পর সব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীই বলেছেন তারা দুনীির্তকে প্রশ্রয় দেবেন না। আমরাও চাই দুনীির্তমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। এর জন্য চেষ্টা ও সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে দুনীির্তর বিপজ্জনক বিস্তারের কারণেই দেশ যতখানি এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, ঠিক ততখানি এগুতে পারছে না। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে বতর্মান সরকার দুনীির্ত নিমূের্ল এগিয়ে আসবে এবং প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে দুনীির্তমুক্ত করবে এমন প্রত্যাশা করা অসঙ্গত নয়। আমরা অতীতে দেখেছি, সরকারি অফিসের চতুথর্ শ্রেণির কমর্চারীও কোটিপতি বনে গেছে, এই ধরনের সচিত্র প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কী পরিমাণ দুনীির্ত করলে একজন কেরানি কিংবা পিয়ন কোটিপতি বনে যায় তা অনুমান করাও কঠিন। যে করেই হোক এই চিত্র বদলাতে হবে। সমস্যা জজির্রত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে দেশব্যাপী চুরি-দুনীির্ত আর লুটপাটের বিপজ্জনক বিস্তার। এই বিস্তারের প্রধান প্রবণতা হচ্ছে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া। বিজয়ের ৪৭ বছর অতিক্রম করলাম আমরা। নানা প্রতিক‚লতা, বাধা-বিপত্তি, অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র সত্তে¡ও আমরা অনেক এগিয়েছি। কিন্তু চুরি-দুনীির্ত লুটপাট আমাদের অগ্রযাত্রাকে সব সময় পিছিয়ে দিতে চাচ্ছে। দুনীির্ত দমনের পূবর্শতর্ হলো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের দুভার্গ্য, দেশে এখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে জনগণকে দুনীির্ত থেকে সুরক্ষা দিতে এবং জনপ্রত্যাশা পূরণে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। অগ্রগতির সূচক আরও ইতিবাচক করতে এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে দুনীির্তর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যিনি চোর-দুনীির্তবাজ লুটেরা তার মাত্রা ও ব্যাপকতা কত সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে এটা মারাত্মক অপরাধ। এই অপরাধের সাজা হওয়া উচিত। এটা সত্য, ব্যাংকিং খাতে, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় দুনীির্তর চিত্র ভয়াবহ। আশির দশক থেকেই এই দুনীির্ত ব্যাপকতা পেতে শুরু করে। ক্রমে অবস্থা এমন দঁাড়ায় যে দুনীির্তর জন্য লজ্জাবোধ তো দূরের কথা, সাধারণ ভয়ভীতিও অবশিষ্ট থাকেনি। বড় দুনীির্তর অভিযোগ আছে এমন অনেকেই পরবতীর্কালে বড় রাজনীতিবিদ বনে গেছেন। সমাজে একেকজন প্রভাবশালী হয়েছেন। উঠে আসতে থাকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের নাটকীয় সব ঘটনা। কেবল ব্যাকিং সেক্টরেই নয়, সরকারের প্রতিটি সেক্টরই ঘুষ দুনীির্ততে আক্রান্ত। মানুষ যদি সৎ নীতিবান না হয় তা হলে দুদক দুনীির্তর বিরুদ্ধে লড়াই করে কতটুকু জয়ী হবে? সমাজ ও রাষ্ট্রে দুনীির্তর পরিমাণ যে হারে বাড়ছে দুনীির্ত দমনের জনবল সে হারে বাড়েনি। এখনো প্রতিটি জেলা সদরের দুনীির্ত দমন কমিশনের পূণার্ঙ্গ অফিস নেই। জনবলও অপ্রতুল। এ ব্যাপারেও সরকারকে নজর দিতে হবে। বিচার করতে হবে ঘুষ দুনীির্ততে জড়িত অপরাধীদের। কেবল বেগম খালেদা জিয়ার বিচার কোনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না, যদি রাঘব-বোয়ালদের বিচার না হয়, তা হলে এই বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। জনমনে এই ধারণাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যে কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশে এই বিচার করা হয়েছে। দেশের দুনীির্ত নিরসন করতে হলে দুদককে আরও শক্তিশালী করা দরকার। দুদককেও সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। সব স্তরের কমীর্ নিয়োগসহ সব কমর্কাÐ বিচার বিভাগের মতো দুদক পরিচালিত করলে এই কমিশন আরও শক্তিশালী হবে। অভ্যন্তরীণ কমীর্র প্রমোশন দেয়া এবং প্রেষণে অন্য কোনো সরকারি দপ্তর থেকে এখানে কমীের্ক পদায়ন না করাটা উচিত। দুদকের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় অফিস থাকা দরকার। দুনীির্ত দমন কমিশন যদি প্রয়োজনীয় জনবল এবং স্বাধীনভাবে কাজ করে তাহলে দেশের দুনীির্ত নিরসন করা সম্ভব। তখন আর বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধার জন্য কাউকে খুঁজতে হবে না। অথর্-বিত্তের মালিক হয়ে ভোগবাদী জীবনযাপনের মাধ্যমে সুখের মুখ কে না দেখতে চায়। পাবলিক বাসে জীবনের ঝঁুকি নিয়ে চলাচলের চেয়ে এসি গাড়িতে চলাচল করতে কে না চায়। কে না চায় দামি পোশাক ও অলঙ্কার পরতে, দামি ও মুখরোচক খাবার খেতে। কে না চায় প্রাসাদোপম বাড়ির মালিক হতে। কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে থাকুক এটাও সবাই চায়। এ চাওয়া পূরণ করতে গেলে তো দেশের ষোল কোটিকেই ধনী হতে হবে। তখন দেশে আর ভুখা-নাঙ্গা, গরিব মানুষের দেখা পাওয়া যাবে না। এটা সবাই জানে, এ গরিব দেশে সৎ পথে উপাজের্নর মাধ্যমে ধনী হওয়া সম্ভব নয়। ব্যতিক্রম দুয়েকজন যে হয়েছে কঠিন সাধনা আর সংগ্রামের মাধ্যমে। হয়তো ভাগ্যও তাদের সুপ্রসন্ন করেছে। আর যারা উত্তরাধিকার সূত্রে বিত্তশালী তাদের কথা আলাদা। এ দেশে আবার কেউ কেউ চুরির মাধ্যমেও কোটিপতি হওয়ার চেষ্টা করছে। ভদ্রবেশি চোরদের পাশাপাশি সুড়ঙ্গ কাটা চোররাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। লুটেরা বা চোরদের উদ্দেশ্য একটাই ধনী হওয়া। রাতারাতি বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া। প্রবাদে আছেÑ চোরকে ফঁাসিতে ঝোলানো হয় না, যে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, তাকেই ফঁাসিতে ঝোলানো হয়। অথার্ৎ চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। চুরি করতে গেলে মেধার প্রয়োজন পড়ে, আর লুট বা ডাকাতি করতে গেলে প্রয়োজন পড়ে সাহসের। স্বাধীনতার পর রিলিফের কম্বল চুরির হিড়িক পড়লে এবং এই অভিযোগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কানে গেলে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেনÑ ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ এ দেশে ছোট চোর থেকে শুরু করে বড় চোর জনআক্রোশে পড়লে গণপিটুনিতে পড়ে। আবার যেসব চোর-দুনীির্তবাজকে রাঘব-বোয়াল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাদের গণপিটুনি দেয়া তো দূরের কথা, কেশাগ্র পযর্ন্ত কেউ স্পশর্ করতে পারে না। তারাই রাষ্ট্র-সমাজের দÐমুÐের কতার্। সমাজে তাদের সম্মান ও মযার্দাই সবচেয়ে বেশি। অবশ্য চুরির-দুনীির্তর প্রতিযোগিতায় জেতা কোনো গৌরবের বিষয় না। বেঁচে থাকার জন্য অথের্র প্রয়োজন, কিন্তু চুরি-দুনীির্ত-লুটপাটের টাকা কতটা প্রয়োজন তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কাস্টমসের অল্প শিক্ষিত কমর্চারী চুরি-দুনীির্ত ঘুষের টাকা দিয়ে সংসার চালানোসহ ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করেছে। ছেলে চাকরি জীবনে প্রবেশের আগে উপদেশ দিয়েছেন, দেখ বাবাÑ অভাবের কারণে আমি ওই পথ বেছে নিয়েছিলাম। আমি কম লেখাপড়া জানা মানুষ, সবকিছু বুঝতাম না। তুই যদি আমার মতো চুরির পথ ধরিস তবে তোর আর আমার মধ্যে কোনো পাথর্ক্য থাকলো না। যদি কখনো লোভের বশবতীর্ হয়ে ছেলের চুরির ইচ্ছা জাগে তখনই তার বাবার কথা মনে পড়ে। তাই সে সৎ পথেই জীবনযাপনের চেষ্টা করছে। এ দেশের বেশির ভাগ ব্যক্তিই চুরি-দুনীির্তর মাধ্যমে অথির্বত্তের মালিক হয়েছে। সুতরাং খানদানি, পেশাদার বা শৌখিন চোর-দুনীির্তবাজদের চেয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওইসব চোর-দুনীির্তবাজ বেশি ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকর। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এ দেশে চোর-দুনীির্তবাজ লালন-পালনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। চোর-দুনীির্তবাজদের কারণেই সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হচ্ছে। আমাদের দুভার্গ্য, আমরা কখনো প্রকৃত চোরদের চিহ্নিত করতে পারি না। প্রশ্ন উঠতে পারে, চুরি-দুনীির্ত বা লুটপাট থেকে মুক্তির উপায় কী। পরিস্থিতি এমন একপযাের্য় চলে গিয়েছে, দেশের চুরি-দুনীির্ত-লুটপাটেরর চিত্র পাল্টানো কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও দীঘের্ময়াদি পরিকল্পনা। আর তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সৎ, যোগ্য নেতৃত্ব। কারণ আমাদের চরিত্রের বদল এবং মানসিকতার পরিবতর্ন না হলে সমাজকে সুস্থ ও সুষ্ঠু ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় দেশকে চুরি-দুনীির্তমুক্ত করাও। দেশে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নৈরাজ্য ও চুরি-দুনীির্ত এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের কারণে এখনো স্থিতিশীল হয়নি। তবে আমরা আশাবাদী, দেশকে এগিয়ে নেয়ার যে প্রত্যয় দেশের সাধারণ মানুষের বুকে রয়েছে তা-ই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। শত বাধা-অপপ্রচার সত্তে¡ও বাংলাদেশ বিশ্বে টিকে থাকবে সফল ও কাযর্কর এবং দুনীির্তমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে। সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক