বাইডেন প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ কী

চীন যেমন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, কারও দিকে বেশি ঝুঁকে যাওয়া বাংলাদেশ জন্য ফলপ্রসূ হবে না, বরং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য 'ভারসাম্য নীতি-ই' সর্বোৎকৃষ্ট এবং ফলপ্রসূ।

প্রকাশ | ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

জসীম উদ্দিন
স্বাধীনতার এক বছর পর, ৪ এপ্রিল, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যাত্রা শুরু। নানান সংকট ও চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে আজ এ সম্পর্কের বয়স ৫০ বছর পেরিয়ে। তবে এ সম্পর্কে সময়ে সময়ে পড়েছে অনেক জোয়ারভাটা- যেমন ওবামা প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অনেকটা গুরুত্ব দিলেও, সে তুলনায় গুরুত্ব দেয়নি ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু, বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশকে নিয়ে আবার নতুন করে ভাবছে। গত ২০ জানুয়ারি, ২০২১ সালে আমেরিকার ৪৬তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে 'মানবিক দৃষ্টিকোণ' থেকে সরে গিয়ে 'কৌশলগত মাপকাঠিতে' মূল্যায়ন করছে- যা স্পষ্টত ফুটে ওঠেছে বাইডেন প্রশাসনের সমসাময়িক কয়েকটি কৌশলগত পদক্ষেপে; বাংলাদেশে নতুন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়োগ দেওয়া, পরপর কয়েকজন মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে পাঠানো এবংর্ যাবসহ ছয় ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইত্যাদি। সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কতটুকু গুরুত্ব বহন করছে। বলতে গেলে অনেকটাই, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হঠাৎ বাংলাদেশ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ কী, তা আজকের আলোচনার মূল বিষয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পরিসংখ্যান মতে, ২০২২-এর জিডিপির আকারে বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে ৩৫তম সালে ছিল ৪১তমের ঘরে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টত, বাংলাদেশের এই অগ্রগতির পেছনে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাশিয়া বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগী। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার মূল্যের বিভিন্ন পণ্য রাশিয়ায় রপ্তানি করে এবং বিপরীতে আমদানি করে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলার মূল্যের পণ্য। এমনকি রাশিয়া মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) মাধ্যমে বাংলাদেশের ৭৬টি পণ্যকে তার অভ্যন্তরীণ বাজারে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার সুযোগ দিয়েছে। আরো বলতে গেলে, বাংলাদেশের বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতে রাশিয়ার বৈদেশিক বিনিয়োগ বেশ চমকপ্রদ। রাশিয়া ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয়ে ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশের পাবনার রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ঘোড়াশালে ৪৫০ মেগাওয়াটের আরো একটি বিদু্যৎকেন্দ্র স্থাপন করতে চায় রাশিয়া। অন্যদিকে, চীন বাংলাদেশের আরেকটি বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী দেশ- যার সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশের ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চলছে। উলেস্নখ্য, ২০১৬ সালে অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশে সফরে এসেছিলেন। সফর কালে সে বাংলাদেশের সঙ্গে ২৭টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন এবং অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, চীন বাংলাদেশের সঙ্গে ২৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করতে চায়। আর সে পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ-চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। বর্তমানে বাণিজ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশকে ৯৮ শতাংশ ডিউটি ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, উন্নয়ন প্রসঙ্গে চীন 'সিল্করোড ফান্ড' থেকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার গুরুত্বের তালিকায় শীর্ষে রেখেছে বাংলাদেশকে। এমনকি বর্তমানে বাংলাদেশে যে কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সবকটিতে চীনের ভূমিকা সবার ঊর্ধ্বে। অতএব, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যের দিক থেকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের এমন মাখামাখি সম্পর্ক মার্কিন নেতৃত্বের জন্য বড় হুমকি বলে মনে করছে মার্কিন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। ফলে, চীন ও রাশিয়ার প্রীতি বাংলাদেশকে মার্কিন নেতৃত্বের শামিয়ানায় আনার লক্ষ্যে এবং ওই দুই শক্তিকে ঠান্ডা লড়াইয়ে পরাস্ত করতে বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে। যার ফলশ্রম্নতিতে বাইডেন প্রশাসন পিটার হাসকে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়। যে পূর্বে ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের 'অর্থনীতি ও বাণিজ্য' বিষয়ক বিশ্লেষক। অধিকন্তু, গুরুত্ব দেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে- বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বলতে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর ঘেঁষে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দূরপ্রাচ্যের যে দেশগুলো রয়েছে তাদের বুঝায়। বিশ্বমানচিত্রে দেখবেন এই অঞ্চলের অনেকটা মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান এবং তার ঠিক উপরে চীন যে ২০১৩ সালে 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' (এক অঞ্চল, এক পথ) নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এই অঞ্চলে নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করে- যা বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন নেতৃত্ব পতনের বড় হুমকি। ফলে, এই উদীয়মান হুমকিকে পরাস্ত করতে আমেরিকা এই অঞ্চলে ২০১৭ সালে কোয়াড (ছটঅউ) এবং ২০২১ সালে অকাস (অটকটঝ) নামক দুটি রাজনৈতিক জোট গঠন করে এবং চীনের সঙ্গে ঠান্ডা লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। অতএব, বাংলাদেশ এই অঞ্চলের অনেকটা মাঝখানে হওয়ায় এবং একবিংশ শতাব্দী থেকে দ্রম্নতগতির অর্থনৈতিক উত্থান ঘটায়, বাংলাদেশ এই অঞ্চলে দুই ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তির (চীন ও আমেরিকা) বিরোধপূর্ণ রাজনীতির মধ্যমণি হয়ে ওঠবে- এটা স্বাভাবিক। উলেস্নখ্য যে, ২০১৬ সালের শি জিনপিংয়ের সফরের পর থেকে মার্কিন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, "চীন তার 'সহযোগিতা নীতির' মাধ্যমে বাংলাদেশকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) ধীরে ধীরে ভেড়াচ্ছে। সুতরাং, বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নজর রাখা জরুরি।" আর এমন দৃষ্টিকোণ থেকেই বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের ওপর গুরুত্বারোপ করছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখি গত বছরের ১৯ মার্চ আমেরিকার রাজনৈতিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডকে তিন দিনের সফরে ঢাকায় পাঠায়, যার আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বের জোরদারকরণ। সম্প্রতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু'র ২ দিনব্যাপী ঢাকা সফর বাইডেন প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বটা আরো একবার স্পষ্ট করে তুলেছে। মিডিয়া বা পত্রপত্রিকা তার সফরকালীন আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হিসেবে; বাংলাদেশের গণতন্ত্র, বিচারবহির্ভূত হত্যা, আগামীর অবাধ-সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও ডিজিটাল নিরাপত্তাকে উলেস্নখ করলেও তার আলোচনার মূল বিষয় দুটি যথা, এক) ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূ-রাজনীতিতে মার্কিন নেতৃত্বের পক্ষে বাংলাদেশের সমর্থন কামনা, দুই) বাণিজ্যিক সম্পর্কের সম্প্রসারণ। যে দুটিতে চীনকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে আমেরিকার স্বার্থের রূপরেখা আঁকলেও বাংলাদেশের জন্য তা বেশ লাভজনক। লু তার বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন, শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) পূর্ণ বহাল রাখবে, যেটি অনেক দেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে উঠিয়ে নিচ্ছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশ তাদের কাছে গুরুত্ব বহন করছে। কারণ হিসেবে বলা যায়, এর মাধ্যমে আমেরিকা বাংলাদেশের চীন প্রীতি হ্রাস করতে চায়। অন্যদিকে,র্ যাবের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা নিয়ে মোটেই আলোচনা করেননি ডোনাল্ড লু, এর অর্থ এটি এখনি প্রত্যাহার করবে না বাইডেন প্রশাসন। আমার মতে, এটিও বাংলাদেশের গুরুত্ব বহন করে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য বাইডেন প্রশাসনের একটি কৌশল ও রাজনৈতিক চাপ হলো র্'যাব নিষেধাজ্ঞা'। অতএব, সর্বশেষ এটিই বলতে চাই, চীন যেমন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, কারও দিকে বেশি ঝুঁকে যাওয়া বাংলাদেশ জন্য ফলপ্রসূ হবে না, বরং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য 'ভারসাম্য নীতি-ই' সর্বোৎকৃষ্ট এবং ফলপ্রসূ। জসীম উদ্দিন : কলাম লেখক